লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন! যুগ যুগ ধরে এই প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে বাঙালিদের মধ্যে। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, দানধ্যানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন এই বিত্তশালী বাঙালি ব্যবসায়ী। কিন্তু সম্প্রতি আয়ারল্যান্ডেও দেখা মিলল ‘গৌরী’র।
নিজেদের অজান্তে এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও কয়েক ঘণ্টার জন্য ‘গৌরী সেন’ হয়ে উঠল সে দেশের অন্যতম ব্যাঙ্ক, ‘ব্যাঙ্ক অফ আয়ারল্যান্ড’। অ্যাকাউন্টে যে টাকা রয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি টাকা এটিএম থেকে তুলতে পারলেন ওই ব্যাঙ্কের গ্রাহকদের একাংশ। আর সেই টাকা তোলার জন্য মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেল রাস্তায় রাস্তায়।
গত মঙ্গলবার থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় দেড় দিন এটিএম থেকে ইচ্ছামতো টাকা তুলতে পারলেন ব্যাঙ্ক অফ আয়ারল্যান্ডের কয়েক জন গ্রাহক। অ্যাকাউন্টে যে পরিমাণ টাকা ছিল, তার থেকে অনেক বেশি টাকা তাঁরা তুলতে পেরেছেন। কিন্তু এ-ও কি সম্ভব! নিয়ম বলছে, অ্যাকাউন্টে থাকা টাকাই তুলতে পারেন গ্রাহকরা। তার থেকে বেশি টাকা তোলা যায় না। পৃথিবীর সব ব্যাঙ্কেই একই নিয়ম। তা হলে আয়ারল্যান্ডের কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যাতিক্রম কী ভাবে হল!
ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, এই টাকা বিলোনোর নেপথ্যে রয়েছে প্রযুক্তিগত ত্রুটি। এই প্রযুক্তিগত ত্রুটিই ব্যাঙ্ক অফ আয়ারল্যান্ডের অনেক গ্রাহককে কয়েক ঘণ্টার জন্য এটিএম থেকে ইচ্ছেমতো টাকা তোলার সুযোগ করে দিয়েছে।
মঙ্গলবার সারা দিনরাত এবং বুধবার সকালে এটিএম থেকে টাকা তোলার ভিড় নজরে পড়েছিল। জনে জনে উন্মাদনাও ছড়িয়ে পড়ে।
ব্যাঙ্ক দেদার টাকা বিলি করছে— এই কথা চাউর হতে অনেক গ্রাহকই নিজেদের ভাগ্যপরীক্ষা করতে এটিএমের বাইরে লাইন দেন। অনেকে নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরলেও অনেকেই অ্যাকাউন্টে থাকা টাকার থেকে অনেক বেশি টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
ব্যাঙ্ক থেকে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে মঙ্গলবারই টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। ব্যাঙ্কের তরফে অনলাইন পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ব্যাঙ্কের অনেক এটিএমে।
আয়ারল্যান্ডের বিভিন্ন এটিএমের বাইরে টাকা তোলার লম্বা লাইন এবং মানুষের হইহই করার বিভিন্ন ছবি এবং ভিডিয়ো ইতিমধ্যেই সমাজমাধ্যমে প্রকাশ্যে এসেছে। যদিও সেগুলির সত্যাসত্য যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন।
মঙ্গলবার বিভিন্ন জায়গায় এটিএমের বাইরে ভিড় সামলাতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে আয়ারল্যান্ডের উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক অ্যান গার্দা সিওচানা বলেন, ‘‘দেশ জুড়ে বিভিন্ন এটিএমের বাইরে এই অস্বাভাবিক ভিড় লক্ষ করা গিয়েছিল। তাই জননিরাপত্তা এবং জনশৃঙ্খলার কথা ভেবে রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়।’’
ব্যাঙ্ক অফ আয়ারল্যান্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে এই বিভ্রাট হয়েছিল। যার জন্য ব্যাঙ্কের অনেক গ্রাহক, জমানো টাকার থেকে বেশি টাকা তুলতে এবং এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন।
ব্যাঙ্ক আরও জানিয়েছে, সাধারণত ব্যাঙ্কের গ্রাহকরা ডেবিট কার্ড দিয়ে এক দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ ইউরো তুলতে পারেন (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪৫ হাজার টাকা)। এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে পাঠানো যায় সর্বোচ্চ ১০০০ ইউরো (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৯০ হাজার টাকা)। কিন্তু প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে কয়েক জন গ্রাহক এর থেকে অনেক বেশি টাকা তুলতে এবং অন্য অ্যাকাউন্টে পাঠাতে পেরেছেন বলেও ব্যাঙ্কের তরফে জানানো হয়েছে।
ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের তরফে মঙ্গল এবং বুধবার সাময়িক ভাবে অনলাইন পরিষেবা এবং মোবাইল অ্যাপ বন্ধ করে দেওয়ায় অসুবিধায় পড়েন সাধারণ মানুষ।
কয়েক জন গ্রাহক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা পাঠাতে না পারার অভিযোগ জানিয়েছেন। খাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার ক্ষেত্রেও অসুবিধার মুখে পড়েন অনেকে।
তবে কয়েক জন গ্রাহককে ‘কৃপা’ করার পর আবার সেই টাকা ফেরতও চেয়েছে আয়ারল্যান্ডের ‘গৌরী’। ব্যাঙ্ক অফ আয়ারল্যান্ড সতর্ক করেছে, যাঁরা অ্যাকাউন্ট থেকে অতিরিক্ত টাকা তুলেছেন, তাঁদের সেই টাকা ফেরত দিতে হবে। টাকা ফেরত না দিলে ভবিষ্যতে অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করলেই ব্যাঙ্ক ধীরে ধীরে সেই টাকা কেটে নেবে বলেও জানানো হয়েছে।
ব্যাঙ্ক একটি বিবৃতি জারি করে জানিয়েছে, যে সব গ্রাহক অতিরিক্ত টাকা তুলেছেন, তাঁরা যেন ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। না হলে ওই গ্রাহক পরবর্তী কালে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন বলেও সতর্ক করা হয়েছে।
এই ঘটনায় পাল্টা ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকেও চাপে রেখেছেন আয়ারল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী মাইকেল ম্যাকগ্রা। মাইকেল জানিয়েছেন, তিনি ‘সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ আয়ারল্যান্ড’কে নির্দেশ দিয়েছেন ‘ব্যাঙ্ক অফ আয়ারল্যান্ড’কে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য।
প্রযুক্তিগত ত্রুটি কী ভাবে হল, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন আয়ারল্যান্ডের অর্থমন্ত্রী। ভবিষ্যতে এই ধরনের সমস্যা যাতে না হয়, তার দিকেও নজর দেওয়ার নির্দেশ তিনি দিয়েছেন।
ত্রুটির জন্য বিশৃঙ্খলা তৈরি হওয়ায় এবং বহু সাধারণ মানুষ অসুবিধার মুখে পড়ায় দেশের বাসিন্দাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন ব্যাঙ্ক অফ আয়ারল্যান্ড কর্তৃপক্ষ। বুধবারের পর থেকে আর এই ধরনের ত্রুটি দেখা যায়নি বলেও ব্যাঙ্কের তরফে জানানো হয়েছে।