দু’জনের মধ্যে অটুট ‘বন্ধুত্ব’। কিন্তু প্রতিরক্ষা চুক্তিকে কেন্দ্র করে এ বার সেখানেও কি দেখা দিল স্বার্থের সংঘাত? সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বিকল্প পথের সন্ধান শুরু করেছে এক ‘বন্ধু’। তার এ হেন পদক্ষেপ পশ্চিম এশিয়ার রাজনৈতিক অঙ্কে ভবিষ্যতে বড় বদল আনতে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
আমেরিকা এবং সৌদি আরব। ঐতিহ্যগত ভাবে দুই গোলার্ধের দুই দেশকে ‘পরম মিত্র’ বলেই জানে গোটা দুনিয়া। অথচ যুদ্ধবিমান সংক্রান্ত প্রতিরক্ষা চুক্তিকে কেন্দ্র করে ওয়াশিংটনের সঙ্গে রিয়াধের সম্পর্কে সাম্প্রতিক অতীতে দেখা গিয়েছে ভাটার টান! এই নিয়ে প্রকাশ্যেই যুক্তরাষ্ট্রকে কড়া কথা শুনিয়েছে আরব প্রশাসন। পাল্টা জবাব দিয়েছে ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’র দেশ।
সমস্যার সূত্রপাত ২০১৭ সালে। ওই বছর আমেরিকা থেকে পঞ্চম প্রজন্মের অত্যাধুনিক ‘এফ-৩৫ লাইটনিং টু’ যুদ্ধবিমান কেনার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে সৌদি সরকার। রিয়াধের অভিযোগ, এ ব্যাপারে কথাবার্তা অনেকটা এগিয়েও শেষ পর্যন্ত চুক্তিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। ফলে প্রশ্নের মুখে পড়ছে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা। ‘বন্ধু’র এ হেন মনোভাবে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ মক্কা-মদিনার দেশ।
ওয়াশিংটনের এই মনোভাবের নেপথ্যে দ্বিমুখী কারণ খুঁজে পেয়েছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। প্রথমত, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে নাক গলানোর অভিযোগ উঠেছে সৌদির বিরুদ্ধে। শুধু তা-ই নয়, রিয়াধের বিমানহানায় সেখানে প্রাণ হারিয়েছেন অগুনতি অসামরিক নাগরিক। ‘এফ-৩৫ লাইটনিং টু’-এর মতো অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান আরব মুলুকটির বায়ুসেনার অস্ত্রাগারে যুক্ত হলে এই সংখ্যা যে আরও বৃদ্ধি পাবে, তা বলাই বাহুল্য। এর দায় নিতে নারাজ যুক্তরাষ্ট্র।
দ্বিতীয়ত, পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে ইজ়রায়েলকে নিয়ে সব সময়েই নরম মনোভাব নিয়ে থাকে আমেরিকা। ইহুদি দেশটির নিরাপত্তার ব্যাপারে নিজেদের দায়বদ্ধতা বরাবরই স্বীকার করে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। আর সেই কারণেই ইজ়রায়েলকে দেওয়া হাতিয়ার কখনওই তার কোনও প্রতিবেশীকে বিক্রি করে না ওয়াশিংটন।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের কথায়, মূলত ইহুদি ভূমির নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই সৌদি আরবকে ‘এফ-৩৫ লাইটনিং টু’র চুক্তিতে অনীহা দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিম এশিয়ায় একমাত্র ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) কাছে রয়েছে এই অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান। গত এক বছর ধরে চলা ইরানের মদতপুষ্ট হামাস এবং হিজ়বুল্লার মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধে এই লড়াকু জেটের শক্তির উপর পুরোপুরি আস্থা রেখেছে ইহুদি বায়ুসেনা।
চলতি বছরের মে মাসে আমেরিকার প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগনে পৌঁছেছিল সৌদির যুদ্ধবিমান কেনার প্রতিরক্ষা চুক্তির খসড়া ফাইল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা নাকচ হয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে অতিরিক্ত আশাবাদী ছিলেন রিয়াধের সেনাকর্তারা। তবে এই চুক্তি আপাতত সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে পেন্টাগন।
বর্তমানে বিশ্বের মাত্র তিনটি দেশের বায়ুসেনার হাতে রয়েছে পঞ্চম প্রজন্মের অত্যাধুনিক ‘স্টেলথ’ যুদ্ধবিমান। আমেরিকা বাদে বাকি দু’টি রাষ্ট্র হল রাশিয়া এবং চিন। এই পরিস্থিতিতে সৌদির কাছে কী কী বিকল্প থাকছে, তা নিয়ে দুনিয়া জুড়ে চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। এ ব্যাপারে মস্কো এবং বেজিংয়ের দিকে রিয়াধ ঝুঁকে পড়লে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে বড় ফাটল ধরবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
ফলে ‘এফ ৩৫ লাইটনিং টু’-এর বিকল্প হিসাবে চতুর্থ বা সাড়ে চার প্রজন্মের যুদ্ধবিমান কেনার ব্যাপারে সৌদির সামরিক কর্তারা আগ্রহ দেখাবেন বলে মনে করা হচ্ছে। আর সেই তালিকায় প্রথমেই আসছে ফরাসি লড়াকু জেট ‘রাফাল’-এর নাম। এ ছাড়া ইউরোপের একাধিক দেশের তৈরি ‘ইউরোফাইটার টাইফুন’কেও পছন্দ করতে পারে তারা। ব্রিটেন, জার্মানি, ইটালি ও স্পেনের বিমানবাহিনী ব্যবহার করে দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট এই যুদ্ধবিমান।
এই দুই লড়াকু বিমানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যাও রয়েছে। প্রথমত, একাধিক দেশের থেকে ‘রাফাল’-এর বরাত পেয়েছে ফ্রান্স। ফলে এর সরবরাহ শুরু হওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে রিয়াধকে। অন্য দিকে একাধিক দেশ মিলে ‘ইউরোফাইটার’ তৈরি করায় এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচসাপেক্ষ।
ফলে বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন চিনের থেকে ‘জে-২০ মাইটি ড্রাগন’ বা ‘জে-৩৫’ যুদ্ধবিমান কিনবেন সৌদির সেনাকর্তারা। অতীতে বেজিং থেকে হামলাকারী ড্রোন কিনেছে রিয়াধ। তবে সূত্রের খবর, পাকিস্তানের সঙ্গে ‘জে-২০ মাইটি ড্রাগন’ নিয়ে চিনের বড় চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ‘রাফাল’-এর মতোই এই লড়াকু জেট হাত পাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতার মুখে পড়বে আরব মুলুকের বায়ুসেনা।
পঞ্চম প্রজন্মের ‘এসইউ-৫৭ ফেলন’ রফতানির ব্যাপারে প্রবল আগ্রহ রয়েছে রাশিয়ার। পাশাপাশি, ‘এসইউ-৭৫ চেকমেট’ নিয়েও ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে মস্কো। এই দুই যুদ্ধবিমানের উপর সৌদির নজর পড়লে পশ্চিম এশিয়ায় হাতিয়ারের বাজারের ‘পুরনো খেলোয়াড়’ পূর্ব এশিয়ার দেশটির প্রবেশ ঘটবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিমানের চুক্তিতে মূল বাধা হল নিষেধাজ্ঞা। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে মস্কো। আর ওই সময় থেকেই পূর্ব ইউরোপের দেশটির উপর বিপুল নিধেষাজ্ঞা চাপিয়ে রেখেছে আমেরিকা। ফলে ‘এসইউ-৫৭’ কিনলে সৌদি প্রশাসনের পক্ষে এর দাম মেটানো যথেষ্ট কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্য দিকে তুরস্কের স্থানীয় সংবাদ সংস্থাগুলি জানিয়েছে, আঙ্কারার থেকে ১০০টি পঞ্চম প্রজন্মের ‘কান’ লড়াকু জেট কিনতে চলেছে রিয়াধ। খুব দ্রুত এই সংক্রান্ত প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পন্ন হবে বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও সরকারি ভাবে এই নিয়ে এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
সম্প্রতি, তুরস্কের ইস্তানবুলে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন দুই দেশের প্রতিরক্ষার শীর্ষকর্তারা। সেখানে ছিলেন সৌদি বায়ুসেনার কম্যান্ডার তুর্কি বিন বান্দর আল সৌদ এবং প্রতিরক্ষা দফতরের উপমন্ত্রী খালেদ বিন হুসেইন আল বিয়ারি। তিন দিনের ওই বৈঠকে ‘কান’ যুদ্ধবিমান কেনার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে সূত্র মারফত খবর মিলেছে।
পঞ্চম প্রজন্মের ‘কান’ স্টেলথ যুদ্ধবিমান তৈরি করেছে ‘তুর্কি অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ়’। চলতি বছরের মে মাসে আঙ্কারা ঘোষণা করে ২০২৮ সালের মধ্যে বিমানবাহিনীর হাতে অন্তত ২০টি এই লড়াকু জেট তুলে দেওয়া হবে। ‘কান’-এর শক্তি ‘এফ-৩৫’-এর সমতুল্য বলে দাবি করেছে ইউরোপের ‘রুগ্ন মানুষ’। যদিও এই নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করেছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
গত কয়েক বছরে হামলাকারী ড্রোন নির্মাণে যথেষ্ট মুনশিয়ানা দেখিয়েছে তুরস্ক। রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়ার আর্মেনিয়া-আজ়ারবাইজান যুদ্ধের রং বদলাতে বড় ভূমিকা নিয়েছে আঙ্কারা নির্মিত ‘বের্যাকটার’ নামের মানববিহীন উড়ুক্কু যান।
যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি তুরস্কের থেকে এই ড্রোন বড় সংখ্যায় সৌদি সরকার কিনতে চলেছে বলে সূত্র মারফত খবর মিলেছে। আঙ্কারার সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, মোট ৩০ থেকে ৪০টি মানববিহীন উড়ুক্কু যান নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হতে পারে। আগামী বছরের গোড়াতেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে বলে মনে করা হচ্ছে।