এক দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পরমাণু বোমা আবিষ্কার এবং তার গায়ে মাখা ধূসর রং। অন্য দিকে গোলাপি রঙে লেপটে থাকা ‘বার্বি ওয়ার্ল্ড’। এক দিকে পরমাণু বোমার জনকজে রবার্ট ওপেনহাইমারের চরিত্রে অভিনয় করা কিলিয়ান মার্ফির কণ্ঠে গীতার শ্লোক, ‘‘নাউ আই অ্যাম বিকাম ডেথ, দ্য ডেস্ট্রয়ার অফ ওয়ার্লডস।’’ অন্য দিকে কানে ভেসে আসছে ‘অ্যাকোয়া’ ব্যান্ডের গান,‘‘আই অ্যাম অ্যা বার্বি গার্ল, ইন দ্য বার্বি ওয়ার্লড।’’ ২১ জুলাই নিজের অজান্তেই ইতিহাস রচনা করল হলিউড। ‘ওপেনহাইমার’ এবং ‘বার্বি’ মিলেমিশে একাকার হয়ে জন্ম দিল ‘বার্বেনহাইমার’-এর।
শুক্রবার ক্রিস্টোফার এডওয়ার্ড নোলানের পরিচালনায় মুক্তি পেয়েছে ‘ওপেনহাইমার’। আদ্যোপান্ত গুরুগম্ভীর ঘরানার ছবি। একই সঙ্গে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে গ্রেটা গারউইগ পরিচালিত ‘বার্বি’।ছবিটিতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, নারীবাদী মনোভাবের ভাল এবং খারাপ দু’রকম দিকই ফুটে উঠেছে। তা নিয়ে আলোচনার চেয়ে সমালোচনাই হয়েছে বেশি। এমনকি টেসলার অধিকর্তা ইলন মাস্কও মন্তব্য করার সুযোগ ছাড়েননি ‘বার্বি’ ছবিটি নিয়ে।
ইলনের মন্তব্য, ‘‘এই ছবিতে এত বার প্যাট্রিয়ার্কি (পিতৃতন্ত্র) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে যে, ছবিটি শেষ হওয়ার আগেই দর্শক শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে বাধ্য।’’ হাজারো বিতর্ক সত্ত্বেও প্রশংসা কুড়িয়েছে এই ছবিটি। বার্বির চরিত্রাভিনেত্রী মার্গট রবি এবং কেনের চরিত্রাভিনেতা রায়ান গসলিং যেমন দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন তেমনই ক্ষণিকের উপস্থিতিতে কৌতূহল তৈরি করেছে রুথ হ্যান্ডলারের চরিত্র, বার্বির নির্মাতাকে ঘিরে।
‘বার্বি’ ছবিতে রুথ জানিয়েছেন, তিনি তাঁর কন্যার জন্য বার্বি তৈরি করেছিলেন। নামটিও ধার করা। কন্যার নাম ভেঙেচুড়ে বার্বির নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু এই কাহিনির কতটা সত্যি? বাচ্চাদের এই পুতুল কী করে হঠাৎ নারীবাদের প্রতীক হয়ে উঠল, কী-ই বা ছিল বার্বির নেপথ্যকাহিনি?
বার্বি পুতুলের স্রষ্টার নাম আসলে রুথ হ্যান্ডলার। তিনি নিজের মেয়ের জন্যই বার্বি পুতুল তৈরির কথা ভেবেছিলেন। রুথ বেশির ভাগ সময় দেখতেন, তাঁর মেয়ে বারবারা কাগজের তৈরি অদ্ভুত ধরনের পুতুল নিয়ে খেলছে। দিনের বেশির ভাগ সময় যে পুতুলের সঙ্গে সময় কাটানো, তার প্রভাব কোনও না কোনও ভাবে শিশুমনে পড়বে তা নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন রুথ। সেখান থেকেই নয়া পরিকল্পনা জাগে তাঁর।
রুথ ভাবেন, বিশেষত বাচ্চা মেয়েদের জন্য তিনি এমন পুতুল তৈরি করবেন যা দেখতে সুন্দর, গোলাপি রঙে তৈরি ‘বার্বি ওয়ার্ল্ড’-এ থাকে সে। মনে মনে শিশুদের জন্য এক রূপকথা সাজিয়ে ফেলেছিলেন রুথ।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। ১৯৪৫ সালে রুথ তাঁর স্বামী এলিয়ট হ্যান্ডলারের সঙ্গে ‘ম্যাটেল’ নামের সংস্থা তৈরি করেন। শুরুর দিকে ফোটো ফ্রেম তৈরির কাজ করলেও পরের দিকে খেলনা প্রস্তুতকারী সংস্থায় পরিণত হয় ম্যাটেল। পুতুল নিয়ে রুথ যা যা ভেবেছেন তা নিয়ে ম্যাটেলের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনা করেন তিনি। কিন্তু রুথের প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়।
ম্যাটেলের আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনার কয়েক দিন পর ইউরোপ সফরে যান রুথ। সেখানে গিয়ে বিল্ড লিলি নামে এক ধরনের জার্মান পুতুল নজরে পড়ে রুথের। এই পুতুল শিশুদের জন্য না হলেও পুতুলের সাজপোশাক নজর কাড়ে রুথের। বাচ্চাদের জন্য কী ধরনের পুতুল বানাবেন তা স্থির করে ফেলেন।
ম্যাটেল সংস্থার তরফেই পুতুল বানানো হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পুতুলের গড়ন ঠিক হলেও তাদের নাম রাখবেন কী? মেয়ে বারবারার নাম থেকেই তৈরি হল বার্বি। এমনকি কেন নামটির নেপথ্যকাহিনিও খানিকটা এ রকম।
রুথের এক পুত্রসন্তানও ছিল। তাঁর নাম কেনেথ। কেনেথের নাম থেকেই পুতুলের জন্য কেন নামটি ঠিক করেন রুথ। তার পরেই ‘বার্বি ওয়ার্ল্ড’-এ জুটি বেঁধে ফেলে বার্বি এবং কেন।
১৯৫৯ সালে প্রথম বার্বি পুতুল প্রকাশ্যে আনেন রুথ। পরিণত শরীরী গঠনের এই পুতুল বাচ্চাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি। বার্বির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকলেও সময়ের চাকা উল্টো দিকে ঘুরতে কত ক্ষণ?
নারীবাদের দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠা বার্বি পুতুলের ধারণা আপাদমস্তক ভুল, এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। বার্বি যেন নারীদের অবাস্তব প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছে। ঘন চুল, নীল চোখ, মেদহীন শরীরী গঠন নিয়ে প্রশ্ন ছোড়েন নারীরাও।
১৯৬৮ সালে ম্যাটেল সংস্থার তরফে একটি নতুন পুতুল তৈরি করা হয়। ক্রিস্টি নামের এক আফ্রিকান-আমেরিকান তরুণীকে বার্বির বন্ধুর পরিচয়ে প্রকাশ্যে আনল ম্যাটেল।
তার পর এক এক ধরনের শরীরী গঠন, বর্ণের উপর নির্ভর করে ‘বার্বি ওয়ার্লড’-এর এক একটি পুতুল তৈরি করে ম্যাটেল।
১৯৯৭ সালে ‘অ্যাকোয়া’ ব্যান্ডের তরফে ‘বার্বি গার্ল’ গানটি প্রকাশিত হয়। প্লাস্টিকের বাক্সে মোড়া বার্বি পুতুল নিয়ে গানের সংলাপে এমন কিছু মন্তব্য করা হয় যা নিয়ে ম্যাটেল সংস্থা ওই ব্যান্ডের প্রতি ক্ষুব্ধ হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। যদিও গানটি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, তা ছোট থেকে বড় সকলের মুখে মুখে ঘুরতে শুরু করে।
২০১৯ সাল থেকে ম্যাটেল সংস্থা ‘বার্বি ড্রিম গ্যাপ প্রজেক্ট’ নামে একটি প্রকল্প চালু করেছে যা নারী শিক্ষার উদ্দেশ্যে কাজ করবে। তাই কি গ্রেটা তাঁর ছবির মাধ্যমে বার্তা দিলেন, ‘‘বিকস বার্বি ক্যান বি এনিথিং, উওমেন ক্যান বি এনিথিং।’
‘বার্বি’ ছবিতে রুথের চরিত্রে কি তবে বাস্তবের রুথ-কন্যা বারবারাকে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে?তা নিয়েও দর্শকের মনে কৌতূহল জেগেছে। এই ছবিতে রুথের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অ্যান রথ। অস্কারজয়ী পোশাকশিল্পী অ্যান আসলে পরিচালক গ্রেটার বান্ধবী।
শত শত আলোচনা এবং বিতর্কের মাঝে ‘বার্বি’ ছবিটি যে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছে তার উদ্যাপন চলছে গুগলেও। গুগলে গিয়ে ‘বার্বি’র খোঁজ করলেই গোলাপি রঙের বুদবুদে ভেসে উঠছে স্ক্রিন। এই বুদবুদ উদ্যাপনের। আপাদমস্তক ‘বার্বি’র উদ্যাপন।