জমে উঠেছে ভারত-অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়। টান টান লড়াইয়ের সিরিজ়ে বার বার ঘুরে ফিরে আসছে একটাই নাম। তিনি রবিচন্দ্রন অশ্বিন। দু’দিন আগে পর্যন্ত উইকেটে যাঁর স্পিনের ভেলকি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। চলতি সিরিজ়ের মাঝেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে চিরতরে বিদায় জানিয়েছেন তিনি।
ক্রিকেট বোদ্ধাদের অনেকেই অসিদের বিরুদ্ধে অশ্বিনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। ১৪ বছরের আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে শুধুমাত্র টেস্টেই ৫৩৭ উইকেট পেয়েছেন তিনি। এক দিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চেন্নাইয়ের ডানহাতি ঘূর্ণি বোলারের শিকার ১৫৬ উইকেট।
২০১০ সালের ৫ জুন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় অশ্বিনের। জ়িম্বাবোয়ের হারারেতে এক দিনের ত্রিদেশীয় সিরিজে নীল জার্সিতে মাঠে নামেন তিনি। প্রথম ম্যাচে অশ্বিনের প্রতিপক্ষ ছিল শ্রীলঙ্কা। তাঁর সে দিনের সতীর্থদের বেশির ভাগই অবসর নিয়েছেন। কেউ কেউ আবার বাংলার রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এক দিনের আন্তর্জাতিকে অভিষেকের ম্যাচে সতীর্থ হিসাবে এক বাঙালি পেসারকেও পেয়েছিলেন অশ্বিন। আবার বর্তমান দলের তিন তারকা খেলোয়াড়ও ছিলেন ওই দলে। অশ্বিনের সঙ্গে ওই ম্যাচে অভিষেক হয়েছিল আরও দুই ক্রিকেটারের। কেমন ছিল সেই টিম? কী করছেন বর্তমানে অশ্বিনের সতীর্থেরা? আনন্দবাজার অনলাইনের এই প্রতিবেদনে রইল তার হদিস।
অভিষেক ম্যাচে সুরেশ রায়নার অধিনায়কত্বে মাঠে নামেন অশ্বিন। টসে জিতে ভারতকে ব্যাট করতে পাঠায় লঙ্কা বাহিনী। ছ’নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ১৮ বলে ১৯ রান করেন রায়না। দিলশনের বলে কাপুগেদেরার হাতে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফেরেন তিনি। ছোট্ট ইনিংসে দু’টি চার মারেন রায়না। তাঁর স্ট্রাইক রেট ছিল ১০৫-এর বেশি।
২০২০ সালের স্বাধীনতা দিবসের দিন (১৫ অগস্ট) আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান বিশ্বকাপজয়ী ভারত অধিনায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। ওই দিনই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন উত্তরপ্রদেশের রায়না। বর্তমানে রেস্তরাঁ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন তিনি। সম্প্রতি ইউরোপের বাঁধের দেশ নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে একটি রেস্তরাঁ খুলেছেন তিনি। নিজের নামেই এর নামকরণ করেছেন বাঁহাতি ব্যাটার সুরেশ।
অশ্বিনের অভিষেক ওডিআইতে অর্ধশতরানের ঝকঝকে ইনিংস খেলেন বিরাট কোহলি। ৯৫ বলে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ৬৮ রান। কিং কোহলির ইনিংস সাজানো ছিল পাঁচটি চারে। তুশারার বলে মেন্ডিসের হাতে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরতে হয় তাঁকে। ওই দিন বিরাটের স্ট্রাইক রেট ছিল প্রায় ৭২।
জীবনের শেষ টেস্টেও সতীর্থ হিসাবে বিরাটকে পাশে পেয়েছেন অশ্বিন। চলতি বছরে টি-২০ বিশ্বকাপ জেতার পর কুড়ি-বিশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে অবশ্য বিদায় জানিয়েছেন কোহলি। তবে এখনও চুটিয়ে টেস্ট এবং এক দিনের আন্তর্জাতিক খেলে চলেছেন ভারতীয় ব্যাটিংয়ের এই স্তম্ভ।
অশ্বিনের প্রথম ওডিআইতে বিরাটকে যোগ্য সঙ্গত দেন আর এক বিশ্বকাপজয়ী পিঞ্চহিটার ইউসুফ পাঠান। ৪১ বলে ৪৪ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। একটি ছক্কা এবং ছ’টি চারে সাজানো ইউসুফের ব্যাটিং লঙ্কা বাহিনীর মনে ভয় ধরিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত রণদীবের বলে পেরেরার হাতে তালুবন্দি হওয়ায় মাঠ ছাড়তে হয় তাঁকে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্রিকেট থেকে অবসর নেন ইউসুফ। এ বছর সদ্য রাজনীতির আঙিনায় পা রেখেছেন তিনি। শুরুটা অবশ্য ‘জায়ান্ট কিলার’ হিসাবেই করেছেন ২০০৭ সালের টি-২০ এবং ২০১১ সালের এক দিনের আন্তর্জাতিক বিশ্বকাপজয়ী পাঠান। তৃণমূলের টিকিটে বহরমপুর থেকে সাংসদ হয়েছেন সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার। নির্বাচনে কংগ্রেসের পোড়খাওয়া নেতা এবং দীর্ঘ দিনের সাংসদ অধীর চৌধুরীকে হারিয়েছেন তিনি।
প্রথম এক দিনের আন্তর্জাতিকে উইকেটরক্ষক হিসাবে দীনেশ কার্তিককে পেয়েছিলেন অশ্বিন। ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৩৪ বলে ২৭ রান করেন তিনি। দীনেশের স্ট্রাইক রেট ছিল প্রায় ৮০। পেরেরার বলে আউট হন তিনি। কোনও ছক্কা মারতে না পারলেও ইনিংসে মোট পাঁচটি চার মারেন দীনেশ।
এ বছরের ১ জুন ৩৯তম জন্মদিনে ক্রিকেটকে চিরতরে বিদায় জানিয়েছেন সাবেক ভারতীয় উইকেটরক্ষক দীনেশ কার্তিক। বর্তমানে ক্রিকেট প্রশিক্ষকের ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে তাঁকে। আইপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর ব্যাটিং কোচ এবং মেন্টর হয়েছেন তিনি।
অশ্বিনের সঙ্গে ওই ম্যাচে অভিষেক হয় নমন ওঝার। দীনেশের সঙ্গে প্রথমে ব্যাট করতে নামেন তিনি। ম্যাচে পুরোপুরি ব্যর্থ হন নমন। মাত্র এক রান করে সাজঘরে ফেরেন তিনি। পরবর্তী বছরগুলিতে ভারতীয় দলের জার্সিতে ধারাবাহিক ভাবে তাঁকে দেখা যায়নি।
২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান নমন। বর্তমানে বিভিন্ন ফ্যাঞ্চাইজ়ি লিগে খেলতে দেখা যায় তাঁকে। রোড সেফটি ওয়ার্ল্ড সিরিজে ইন্ডিয়া লিজেন্ডস টিমে ছিলেন তিনি। এতে মূলত প্রদর্শনীমূলক ম্যাচ খেলেন প্রাক্তন খেলোয়াড়েরা।
অশ্বিনের অভিষেক ম্যাচে বর্তমান ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা ব্যাট করতে নামেন পাঁচ নম্বরে। ৪০ বলে ৩২ রান করেন তিনি। রোহিতের স্ট্রাইক রেট ছিল ৮০। তবে তাঁর ইনিংসে ছিল না চার-ছক্কার ফুলঝুরি। মাত্র একটি বাউন্ডারি বেরিয়েছিল হিটম্যানের ব্যাট থেকে।
এ বছর টি-২০ বিশ্বকাপ জেতার পর কোহলির মতোই কুড়ি-বিশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন রোহিত। আইপিএলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে খেলবেন তিনি। জাতীয় দলের হয়ে আরও কয়েক বছর তাঁকে দেখা যাবে বলে জানিয়েছেন হিটম্যান।
অশ্বিনের অভিষেক ম্যাচে ২৬ বলে ১৯ রান করেন রবীন্দ্র জাডেজা। ইনিংসে থিতু হওয়ার আগেই রান আউট হওয়ায় সাজঘরের রাস্তা ধরতে হয়েছিল তাঁকে। গুজরাতের এই বাঁহাতি অলরাউন্ডারকে শেষ টেস্টেও সতীর্থ হিসাবে পেয়েছেন তামিলনাড়ুর ঘূর্ণি বোলার। এ বছরের টি-২০ বিশ্বকাপজয়ী টিমের সদস্য ছিলেন জাডেজা। জাতীয় দলের হয়ে সব ফরম্যাটের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন তিনি।
অশ্বিনের সঙ্গে প্রথম বার জাতীয় দলের জার্সিতে মাঠে নামেন পঙ্কজ সিংহ। তিন রান করে ম্যাচে অপরাজিত ছিলেন তিনি। সাত ওভার বল করে দেন ৪৫ রান। ইকোনমি রেট ছিল ৬.৪৫। প্রথম ম্যাচে কোনও উইকেট পাননি পঙ্কজ। খুব বেশি দিন ভারতের জার্সিতে খেলা হয়নি পঙ্কজের। ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি। বর্তমানে ক্রিকেট প্রশিক্ষকের কাজ করছেন এই সাবেক খেলোয়াড়।
অশ্বিনের অভিষেক ম্যাচে একমাত্র বাঙালি ক্রিকেটার ছিলেন অশোক ডিন্ডা। ৭.২ ওভারে ৪২ রান দিয়ে এক উইকেট নেন তিনি। ডিন্ডার বোলিং গড় ছিল ৫.৭২। ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ক্রিকেটকে বিদায় জানান ডিন্ডা। এর পর যোগ দেন বিজেপিতে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না থেকে পদ্ম চিহ্নে নির্বাচিত হন তিনি।
প্রথম খেলায় অশ্বিনের সতীর্থ প্রজ্ঞান ওঝাও বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত খেলোয়াড়। ক্রিকেটের উন্নতির জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। ২০২০ সালেই ব্যাট-বলের দুনিয়াকে চিরতরে বিদায় জানান প্রজ্ঞান। শ্রীলঙ্কা ম্যাচে ১০ ওভার বল করে ৪৩ রান দিয়ে একটি উইকেট নেন তিনি।
প্রথম খেলাতেই কিন্তু নিজের জাত চিনিয়েছিলেন অশ্বিন। আট নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ৩২ বলে ৩৮ রান করেন তিনি। ১০ ওভার বল করে ৫০ রান দিয়ে নেন দুই উইকেট। বোলিং গড় ছিল পাঁচ। ব্যাটিং স্ট্রাইক রেট ছিল ১১৯। ইনিংসে মোট চারটি চার এবং একটি ছক্কা মারেন তিনি।
তবে অভিষেক ওডিআইতে জয়ের মুখ দেখতে পারেননি অশ্বিন। ন’উইকেট খুইয়ে ওই ম্যাচে ভারত করেছিল ২৬৮ রান। জবাবে খেলতে নেমে মাত্র চার উইকেট খুইয়ে ৪৮.২ ওভারেই জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ২৭০ রান তুলে নেয় লঙ্কা ব্রিগেড।