ধুঁকছে পাকিস্তানের অর্থনীতি। বেকারত্ব, খাদ্যাভাব চরমে। এই পরিস্থিতিতে ঠিক কী করা উচিত সে দেশের সরকারের? তা নিয়ে নিদান দিলেন নতুন নিযুক্ত সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির। যা শুনে সমালোচকরা বলছেন, ভূতের মুখে রাম নাম!
করাচিতে পাকিস্তানের নৌসেনা অ্যাকাডেমিতে একটি কর্মসূচিতে গিয়ে মুনির জানান, দেশ অদ্ভুত এক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলেছে। তাই তিনি সকলকেই আর্জি জানিয়েছেন যে, পরিস্থিতি সামাল দিতে অর্থনীতির পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
পাকিস্তান সেনা বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, ‘‘সেনাবাহিনীর প্রধান মনে করেন পাকিস্তান দারুণ সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলেছে। অর্থনীতি এবং সন্ত্রাসবাদ নিয়ে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তার মোকাবিলার জন্য দেশের সমস্ত পক্ষকে একমত হতে হবে।’’
এর পর মুনির পাকিস্তান নৌবাহিনী এবং নৌসেনার প্রশংসা করেন। তরুণ অফিসারদের আরও বেশি করে দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেন।
মুনিরের মুখে এই কথা শুনে অনেকেই চমকে গিয়েছেন। কারণ মুনির ছিলেন পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগ আইএসআই প্রধান। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামায় সিআরপিএফ কনভয় লক্ষ্য করে হামলা করে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠী। মারা গিয়েছিলেন অন্তত ৪০ জন জওয়ান। গোয়েন্দাদের দাবি, সে সময় পাকিস্তানে বসে সেই হামলার উপর নজর রেখেছিলেন তিনি।
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য তিলক দেবাশের বলেন, ‘‘মুনিরের পর্যবেক্ষণেই পুলওয়ামায় সন্ত্রাস হামলা হয়েছিল। ২০১৮ সালের নভেম্বর আইএসআইয়ের ডিজি হয়েছিলেন তিনি। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামায় হামলা হয়। কাশ্মীরের সঙ্গে সরাসরি যোগ রয়েছে পাকিস্তানের যে সব এলাকার, সেখানেই খবর সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন মুনির। ফলে কাশ্মীরকে খুব ভাল করে চেনেন তিনি।’’
এ হেন মুনিরই এখন বলছেন সন্ত্রাস মোকাবিলার কথা। তবে এই মন্তব্যের কারণও রয়েছে। কারণ পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সঙ্কট। কোভিড অতিমারি পরবর্তী সময়ে ক্রমেই নিম্নমুখী হয়েছে পাকিস্তানের অর্থনীতির গ্রাফ। বেড়েছে বেকারত্ব। মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার সাধারণ মানুষ। চলতি বছর বন্যায় বিধ্বস্ত হয় পাকিস্তান। হাজার খানেক মানুষের মৃত্যু হয় সেই বন্যায়। তার পর পাকিস্তানের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। দেশে বিদ্যুতের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কারখানায় উৎপাদন থমকে গিয়েছে।
এর মধ্যে সম্প্রতি পাকিস্তানে এক ভয়ানক দৃশ্য ভাইরাল হয়েছে। সিলিন্ডারের অভাবে প্লাস্টিকের ব্যাগে রান্নার গ্যাস ভরে বিক্রি করা হচ্ছে সে দেশে। সম্প্রতি একটি ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে। সেখানে দেখা গিয়েছে, বিশাল বড় প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা হচ্ছে রান্নার গ্যাস। আর সেই প্লাস্টিকের ব্যাগেই গ্যাস নিয়ে যাচ্ছেন গ্রাহকরা! যদিও ভিডিয়োটির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, প্লাস্টিকের ব্যাগে রান্নার গ্যাস ভরার দৃশ্যটি আসলে খাইবার পাখতুনখোয়ায়। এই প্রদেশের কারাক জেলায় ২০০৭ সাল থেকে রান্নার গ্যাস দেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। গত দু’বছর ধরে গ্যাসের পাইপলাইন খারাপ। সে জন্য হাঙ্গু শহরে বাসিন্দারা রান্নার গ্যাস থেকে বঞ্চিত। এই ছবি দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীরা।
অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, শ্রীলঙ্কার মতো তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট হতে পারে পাকিস্তানেও। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুনের শেষে পাকিস্তানের ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ২০০ কোটি পাকিস্তানি টাকা। এই পরিস্থিতিতে দেশের সেনাপ্রধান হিসাবে আর কী বলতে পারতেন মুনির! সেই প্রশ্নও উঠছে।
এই তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যেই পাকিস্তানে রাজনৈতিক চাপান-উতোরও কম হয়নি। ক্ষমতার রদবদল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রিত্ব গিয়েছে ইমরান খানের। নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শাহবাজ শরিফ।
এ রকম টালমাটাল পরিস্থিতিতে ২০২২ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের নতুন সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন মুনির। তার আগে ছ’বছর পাকিস্তানের সেনাপ্রধান পদে ছিলেন কমর বাজওয়া।
মুনির ছিলেন পাকিস্তানের গুপ্তচর বিভাগের (আইএসআই) প্রধান। সে দেশের নিরাপত্তার বিষয়টি হাতের তালুর মতোই চেনেন তিনি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোথায় কোন জঙ্গিদল সক্রিয়, তা-ও খুব ভালই জানেন তিনি। এ হেন মুনির এখন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান। সেনাবাহিনীর আড়বহরের নিরিখে গোটা বিশ্বে পাকিস্তান পঞ্চম।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাকিস্তানের সব থেকে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হলেন সে দেশের সেনাপ্রধান। সেনাপ্রধানই আমেরিকা-সহ বেশ কয়েকটি বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। পাকিস্তানে অতীতে বার বার সেনা অভ্যুত্থানের ইতিহাস রয়েছে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে মুনির এখন পাকিস্তানের সব থেকে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি।
পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা মনে করেন, ইমরান ক্ষমতায় থাকলে মুনিরকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করতেন না। তিনি এমন কাউকে করতেন, যিনি তাঁকে সমর্থন করবেন। মুনিরকে আইএসআই প্রধানের পদ থেকে ২০১৯ সালে সরিয়েছিলেন খোদ ইমরান।
ইমরান ক্ষমতা হারাতেই মুনিরকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসান নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ। এ বার মুনিরের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ যে, তিনি আদৌ পূর্বসুরিদের মতো ক্ষমতার দিকে ঝুঁকবেন, রাষ্ট্রপ্রধানকে নিজের মতো চালনা করার চেষ্টা করবেন, না কি সমালোচনাকে ভুল প্রমাণ করে সেনাবাহিনীকে জনদরদী হিসাবে গড়ে তুলবেন । মনে করা হচ্ছে, তা করার জন্যই সন্ত্রাসবাদ নিয়ে মুখ খুলেছেন।
২০২৩ সালের শেষ দিকে পাকিস্তানে নির্বাচন। তখন মুনিরের সামনে লম্বা চ্যালেঞ্জ। ২০১৮ সালে সেনা যেমন ইমরানকে ক্ষমতায় এনেছিল, সে ভাবেই কি তাঁকে সমর্থন করবে সেনা? না কি শাহবাজের পাশে থাকবে? না কি নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে দেশবাসীর আস্থা অর্জন করবে?
সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণের ডাক দিয়ে ইতিমধ্যে তিনি সাধারণ মানুষের মন জয় করেছেন। তাকিয়ে রয়েছে ভারতও। সেনাপ্রধান হয়ে কি পাল্টে গেলেন মুনির! তবে কি এ বার সন্ত্রাসবাদকে কড়া হাতে দমন করবে পাকিস্তান?
যদিও মুনিরের ইতিহাস সে রকম কিছু বলছে না। প্রাক্তন সেনাপ্রধান বাজওয়া বরং অনেক বেশি ‘ভারত-দরদী’ ছিলেন। নিয়ন্ত্রণরেখায় সংঘর্ষবিরতি জারি করার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যও ফের চালু করতে চেয়েছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত ইমরান খান তাতে সবুজ সঙ্কেত দেননি।
কিন্তু মুনির কোনও কালেই সে রকম লোক নন। তিনি বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি ভারতের বিরোধিতা করেছেন।। বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, মুনির চাইলেও ভারতের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে পারবেন না। সেনাবাহিনীই তা বরদাস্ত করবে না। পাকিস্তানের এই চরম সঙ্কটে তাঁর উপর এই নিয়ে আরও বেশি চাপ থাকবে। তার পরেও মুনিরের সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণের ডাক অবশ্যই আশা জাগাচ্ছে অনেকের মনে।