পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব একটা স্থিতিশীল নয়। এই অবস্থায় সেনাবাহিনীর সঙ্কট নতুন করে চিন্তা বাড়িয়েছে ইসলামাবাদের।
সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অবস্থান থেকে ২০১৪ সালে নতুন একটি অভিযানের কথা ঘোষণা করেছিল পাকিস্তানের সেনা। সেখানেই লুকিয়ে আছে ‘কাঁটা’। কারণ, সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে পাল্টা ‘পাটকেল’ ধেয়ে আসছে তাদের দিকেও।
অনেকে মনে করছেন, পাকিস্তানের সেনা এই মুহূর্তে যে সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে, ২০১৪ সালের পর থেকে সেই অবস্থা আর কখনও হয়নি। পরিস্থিতি সামাল দিতে অবিলম্বে আলোচনা এবং নীতি নির্ধারণ প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
২০১৪ সালে পাকিস্তানের সেনা সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যে অভিযান ঘোষণা করেছিল, তার নাম জ়ারব্-ই-আজ়ব। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে এটি পাক সেনার সব থেকে বড় অভিযান।
সম্প্রতি, পাক সেনার উপর পর পর কয়েকটি জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। যাতে প্রমাদ গুনছেন সেনাকর্তারা। সেনার বিরুদ্ধে ঘন ঘন জঙ্গি হামলাকে অনেকেই বিপদের সঙ্কেত বলে মনে করছেন।
গত সপ্তাহেই গ্বদরে পাক সেনার একটি কনভয়ে হামলা চালায় জঙ্গিরা। মোট ১৪ জন সেনা জওয়ানের মৃত্যু হয় সেই হামলায়। সেনার কনভয়টি বালুচিস্তানের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল।
একই ভাবে পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের মিয়ানওয়ালিতে পাক বায়ুসেনার ঘাঁটিতেও জঙ্গি হামলা হয় কিছু দিন আগে। আত্মঘাতী জঙ্গিরা রাতের অন্ধকারে দেওয়াল বেয়ে সেনাঘাঁটিতে ঢোকে এবং জওয়ানদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়।
পাক সেনার তরফে জানানো হয়েছে, মিয়ানওয়ালির হামলায় ন’জন জঙ্গিরই মৃত্যু হয়েছে। সেনার কয়েক জন সদস্য আহত হয়েছেন। ঘাঁটিতে থাকা তিনটি যুদ্ধবিমান জঙ্গিদের হামলায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
সেনাবাহিনীর উপর পর পর এই সন্ত্রাসবাদী হামলায় সিঁদুরে মেঘ দেখছেন অনেকে। বলা হচ্ছে, পাক সেনার গলায় এখন মূলত তিনটি ‘কাঁটা’ বিঁধে রয়েছে। জঙ্গিদের কার্যকলাপ সেই তিনের মধ্যে অন্যতম।
বালুচিস্তান প্রদেশে বাড়তে থাকা সমস্যা পাক বাহিনীর দ্বিতীয় ‘কাঁটা’। ওই এলাকায় সেনা-বিরোধী বিদ্রোহ দমন করা বাহিনীর সামনে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বালুচিস্তানে জঙ্গিগোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানের (টিটিপি) সঙ্গে পাক সেনার যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, ২০২২ সালে তার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়। এর পর থেকেই সেনার উপর হামলার পরিমাণ বেড়েছে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে চাপে রেখেছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও। এটি তাঁদের তৃতীয় ‘কাঁটা’। রাজনৈতিক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে চলতি বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে।
৯ মে প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান রেঞ্জার্স। আদালত চত্বর থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ।
ইমরানের এই গ্রেফতারি দেশের সাধারণ মানুষ ভাল চোখে দেখেননি। পাকিস্তানের কোনায় কোনায় সেনা-বিরোধী জনমত গড়ে ওঠে ওই ঘটনার পর থেকেই। দেশ জুড়ে দেখা দেয় বিক্ষোভ।
গত অগস্টে তোশাখানা মামলায় ইমরানের তিন বছরের জেলের সাজায় স্থগিতাদেশ দিয়েছিল ইসলামাবাদ হাই কোর্ট। তাঁর জামিনের আবেদনও মঞ্জুর করা হয়েছিল। কিন্তু অফিশিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট (ওএসএ) বা গোপন রাষ্ট্রীয় তথ্য ফাঁসের মামলায় অভিযুক্ত হওয়ায় জেল থেকে প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রী মুক্তি পাননি।
হেফাজতে থাকাকালীন পাক সেনার বিরুদ্ধে ইমরান শারীরিক নিগ্রহের অভিযোগ তুলেছেন। বার বার জানিয়েছেন, তাঁকে অন্যায় ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁকে খুন করা হতে পারে বলে আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন।
ইমরানের আইনজীবী উমায়ের নিয়াজি জানিয়েছেন, এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে ইমরানকে ফাঁসির সাজা শোনানো হতে পারে। ইমরান আগামী জানুয়ারি মাসের নির্বাচনেও অংশ নিতে পারবেন না। বৃহত্তর জনমতের বিচারে এ সবই সেনার বিরুদ্ধে গিয়েছে।
বস্তুত, পাকিস্তানে সরকারের চেয়ে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা বেশি। সরকারের মাথায় কে বসবেন, তিনি কী ভাবে কাজ করবেন, তার উপর সেনার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বরাবর।
কিন্তু ইমরানের গ্রেফতারির পর পাক সেনা দেশের মাটিতে গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। এই সঙ্কটের পরিস্থিতিতে তাই ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ করতে হবে সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে, তেমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের।