শুধুমাত্র পড়ার জন্য খবরের কাগজ বিক্রির কাজ করবেন? ছোট এক কামরার ঘরে সাত ভাইবোনের মাঝে বসে পড়াশোনাতে মন দেওয়ার কথা ভাবা যায়? আর তার উপর যদি থাকে মত্ত বাবা! ভাবতে অসুবিধা হচ্ছে নিশ্চয়ই। এ রকম পরিবেশের মধ্যে থেকেই কিন্তু পড়াশোনা করে আইএফএস অফিসার হয়েছেন পি বালামুরুগান।
পি বালামুরুগানের জন্ম চেন্নাইয়ে। পাঁচ বোন এবং দু’ভাই তাঁরা। ছোট থেকেই বাবা পরিবারের কোনও দায়িত্ব নিতেন না। উল্টে মদ্যপানের অভ্যাসের জন্য অতিরিক্ত খরচ করতেন। পুরোটাই তাঁদের মা দেখভাল করতেন।
তার উপর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ফেলে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন বাবা। তার পর থেকে ঘরে-বাইরের সমস্ত দায়িত্বই মায়ের ঘাড়ে এসে পড়েছিল। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর মায়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। শিক্ষিত না হওয়ায় কাজ পেতেও খুব সমস্যায় পড়তে হয়েছিল তাঁকে। তাই প্রথম থেকে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনাতে নজর দিয়েছিলেন তিনি।
নিজের পায়ে দাঁড়াতে গেলে, পায়ের তলার জমি শক্ত করতে গেলে যে শিক্ষার বিকল্প নেই, তা সব সময় বালামুরুগানদের বোঝাতেন।
সন্তানদের শিক্ষার জন্য তিনি নিজের নামে থাকা ১২০০ বর্গ ফুটের একটি জমি বেচে দিয়েছিলেন এক লক্ষ ২৫ হাজার টাকায়। সেই টাকা শুধুমাত্র সন্তানদের পড়াশোনায় কাজে লাগাতেন।
এমন একটা সময় ছিল, যখন বালামুরুগানদের প্রতি মুহূর্তে ভাবতে হত, কী ভাবে পরের দিনটা তাঁরা কাটাবেন। পড়াশোনায় মেধাবী ছিলেন তিনি। খবরের কাগজ পড়ার খুব ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু পকেটে টাকা ছিল না। তাই এক দিন সাহস করে এক খবরের কাগজ বিক্রেতাকে একটি তামিল সংবাদপত্র পড়ার অনুরোধ জানান।
ওই ব্যক্তি এর জন্য তাঁর কাছে মাসে ৯০ টাকা করে জমা রাখতে বলেন। সরল বালামুরুগান নিজের নিরুপায় হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। তারপর ওই কাগজ বিক্রেতাই তাঁকে ৩০০ টাকা মাইনের কাজ দিয়েছিলেন। মাত্র ন’বছর বয়সে বাড়ি বাড়ি কাগজ দিয়ে আসতে হত তাঁকে। তার ফাঁকেই কাগজগুলি পড়েও ফেলতেন তিনি।
না খেয়ে দিন কাটাতেন তাঁরা অনেক সময়। কিন্তু এমন একটা দিনও ছিল না, যে দিন পড়তে বসতেন না। ২০১১ সালে মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ইলেকট্রনিক্স এবং কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেস (টিসিএস)-এ চাকরি পেয়ে যান।
২০১২ সাল থেকেই পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করেছিল। বালামুরুগানের পাশাপাশি তাঁর বড় বোনও একটি চাকরি পেয়ে গিয়েছিলেন। চেন্নাইয়ের পাঁচ কামরার একটি বাড়িতে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেছিলেন তিনি।
সব ঠিকঠাক চলছিল, টিসিএস-এ ভাল মাইনেও পাচ্ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন সরকারি কর্মচারী হওয়ার স্বপ্ন দেখলেন বালামুরুগান? এর পিছনেও একটি ঘটনা রয়েছে। পাঁচ কামরার ওই বাড়িতে থাকাকালীন প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক নেতা তাঁদের জমির অধিকাংশই দখল করে নিয়েছিলেন। বালামুরুগান বিষয়টি এক মহিলা আইএএস অফিসারকে জানিয়েছিলেন। এর যে কোনও প্রতিকার হতে পারে, তা কল্পনাতেও আনেননি তিনি।
কিন্তু প্রায় মাস খানেক পর পুলিশ তাঁর বাড়িতে এসে হাজির হয়। সমস্ত নথি যাচাই করে জমি ফিরিয়ে দেয় তাঁকে। আমলাদের ক্ষমতা কতখানি, সে দিন উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। এর পরের বছর লন্ডন গিয়ে কাজের সুযোগ পান বালামুরুগান। লন্ডনে কাজ করে যে বিপুল উপার্জন করেছিলেন, তার বেশিরভাগ জমিয়ে রেখেছিলেন ভবিষ্যতের জন্য। বালামুরুগান আসলে মনস্থির করে ফেলেছিলেন, কাজ ছেড়ে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেবেন। তার জন্যই টাকা জমিয়েছিলেন তিনি, যাতে সেই সময়ে অর্থকষ্টে তাঁকে না ভুগতে হয়।
২০১৫ সালে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। তার তিন বছর পর ২০১৮ সালে তিনি আইএফএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। রাজস্থানের দুংগারপুর ফরেস্ট ডিভিশনে প্রবেশনারি অফিসার হিসাবে কাজে যোগ দেন তিনি।
জঙ্গলের জীবন যেমন রোমাঞ্চকর, পি বালামুরুগানও নিজের জীবনকে সে ভাবেই দেখেন। যার প্রতি ছত্রে ছত্রে রোমাঞ্চে ভরপুর।