কার মনের গভীরে কী কথা লুকিয়ে রয়েছে, কে বলতে পারে? কবিরা বলতে পারেন, চোখের ভাষায় তো তা ফুটে ওঠে। তবে সে ভাষা তো কবির কল্পনা। এমন বলতে পারেন যুক্তিবাদীরা। মনের কথা জানা কি আদৌ সম্ভব?
মস্তিষ্কের গহন কোণে কার কী চিন্তা-ভাবনা চলছে, তার মর্মোদ্ধার করা সম্ভব। এককালে এ দাবি ছিল সার্বিয়ান-আমেরিকান উদ্ভাবক নিকোলা টেসলার। ওই দাবি করেই থেমে থাকেননি। আরও পিলে চমকানো কথা জানিয়েছেন টেসলা।
মনে মনে এক আর মুখে অন্য কথা। এমন তো হামেশাই শোনা। এমন যন্ত্রও নেই যে যার সাহায্যে অন্যের মনের কথা জেনে ফেলা যাবে। তবে টেসলার দাবি ছিল যে মানবমস্তিষ্কে চিন্তা-ভাবনার কী খেলা চলছে, তা পড়ে ফেলা যায়। এমনকি, সেই চিন্তা-ভাবনার ছবিও তুলে ফেলা সম্ভব।
মস্তিষ্কের ভাবনাকে পড়ে ফেলাই শুধু নয়, তা নাকি ‘দেখা’-ও সম্ভব। কী ভাবে? দীর্ঘকাল আগে আপাতঅবিশ্বাস্য দাবির কথা শুনিয়েছিলেন টেসলা। তাঁর দাবি ছিল, আমাদের চিন্তা-ভাবনার ছবিও তোলা যেতে পারে।
টেসলার উদ্ভাবন দিনের আলো দেখেনি বটে। তবে তা নিয়ে কম গবেষণা হয়নি। বিজ্ঞানের উৎসাহীদের কাছে টেসলার ‘থট ক্যামেরা’ নিয়ে আজও অপার কৌতূহল।
যুক্তিবাদীরা টেসলার দাবিকে বিশ্বাস করতে রাজি নন। তাঁদের দাবি, চিন্তা-ভাবনার তো কোনও অবয়ব নেই। তা হলে ক্যামেরায় কী ভাবে সেই ছবি তোলা যাবে? একটি সাক্ষাৎকারে সে প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন টেসলা।
শোনা যায়, ১৮৯৩ সালে নিজের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষানিরীক্ষা করার সময় ‘থট ক্যামেরা’-র তৈরির কথা ভেবেছিলেন টেসলা। যদিও তার দীর্ঘকাল পরে এ নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করেন তিনি। ওই সাক্ষাৎকারে টেসলা বলেন, ‘‘আমি নিশ্চিত যে আমাদের চিন্তা-ভাবনার ছবি চোখের মণিতে ফুটে ওঠে।’’
তর্কের খাতিরে টেসলার কথায় বিশ্বাস করা গেল। তবে সে ছবি কী ভাবে ক্যামেরাবন্দি করা যাবে? সে উত্তরও দিয়েছেন টেসলা। তাঁর কথায়, ‘‘প্রতিবর্ত ক্রিয়ার দ্বারাই আমাদের চিন্তা-ভাবনার ছবি মণিতে দেখা যায়। যথাযথ যন্ত্রের সাহায্য সেই ছবি দেখা সম্ভব।’’
কী সেই যন্ত্র? এখানেই ‘থট ক্যামেরা’র প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন টেসলা। তিনি জানিয়েছেন, চোখের মণিতে ভেসে ওঠা মনের ভাবনার প্রতিচ্ছবি একটি কৃত্রিম অক্ষিপটে (রেটিনায়) ফেলে তার ছবি তোলা যায়। এবং সেই ছবি কোনও পর্দায় ভাসিয়ে দিলে ওই মানুষটির মনের কথা জেনে ফেলা সম্ভব।
‘থট ক্যামেরা’ প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে টেসলা বলেছেন, ‘‘যদি মনের ছবি এ ভাবে পর্দায় ভাসিয়ে তোলা যায়, তবে ওই মানুষটি কী চিন্তা-ভাবনা করছেন তা সহজেই জেনে ফেলা যাবে।’’
অনেকের দাবি, ১৮৯৩ সালে নয়, গত শতকের তিরিশের দশকে ‘থট ক্যামেরা’-র কথা ভেবেছিলেন টেসলা। ওই ক্যামেরার সাহায্যে মানবমনের চিন্তা-ভাবনার ছবিও স্লাইডশোয়ের মতো দেখা যাবে। সাল-তারিখ নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে। তবে টেসলার এই উদ্ভাবনী চিন্তা যে অভূতপূর্ব, তা নিয়ে দ্বিমত ছিল না।
টেসলার কথায়, ‘‘এ ধরনের ক্যামেরার সাহায্যে প্রতিটি মানুষের মনের কথা পড়ে ফেলা যাবে। এবং তা করা গেলে আমাদের মন আক্ষরিক অর্থেই খোলা বইয়ের আকার নেবে। যা সকলেই পড়তে পারবেন।’’ যদিও টেসলার এই ভাবনা সাফল্য পায়নি।
টেসলার উদ্ভাবনী ভাবনাকে কাজে লাগিয়েই একবিংশ শতকে ‘মাইন্ড-রিডিং মেশিন’ তৈরির দাবি করেছিলেন আমেরিকার ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। গত বছর সে দাবি নিয়ে বিস্তর হইচই হয়েছিল। ওই গবেষকদের দাবি ছিল, তাঁরা এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন যার সাহায্যে মস্তিষ্কের একাধিক স্ক্যান করে মানুষের চিন্তা-ভাবনার রূপ ফুটিয়ে তুলতে পারেন। যদিও এ নিয়ে আরও গবেষণা চলছে।
শুধুমাত্র ‘থট ক্যামেরা’-ই নয়। আরও একাধিক চমকপ্রদ উদ্ভাবনের পিছনেও টেসলার হাত রয়েছে। তবে বিদ্যুৎ পরিবহণ ব্যবস্থায় এসি বা অল্টারনেটিং কারেন্ট-র ডিজাইন তৈরির পিছনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
কী ভাবে উদ্ভাবক হয়ে উঠলেন টেসলা? মধ্য-পূর্ব ইউরোপের অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যে ১৮৫৬ সালে জন্ম টেসলার। আধুনিককালে যা ক্রোয়েশিয়া নামে পরিচিত। স্কুলের শিক্ষা শেষে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পদার্থবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন তিনি। তবে তাতে প্রথাগত ডিগ্রি ছিল না তাঁর। স্নাতকস্তরের চার বছরের শিক্ষা শেষ করেছিলেন তিন বছরে।
স্কলারশিপ অর্থে গ্রাজ শহরের ইম্পেরিয়্যাল-রয়্যাল টেকনিক্যাল কলেজে ভর্তি হলেও তৃতীয় বছরেই তা ছেড়ে দেন। যদিও তার আগেই অধ্যাপকদের প্রশংসা কুড়িয়ে নিয়েছেন টেসলা। ১৮৭৮ সালে গ্রাজ শহরও ছেড়ে দেন তিনি। তাঁর একাধিক জীবনীকারের দাবি, পড়াশোনার বদলে ওই শহরে চরম উশৃঙ্খল জীবনযাপন করেছিলেন টেসলা।
এক সময় হাতেকলমে কাজ শেখার তাগিদে টেলিযোগাযোগ সংস্থায় কাজ শুরু করেন টেসলা। ১৮৮৪ সালে আমেরিকায় পাড়ি দেওয়ার পর সেখানকার নাগরিকত্ব লাভ করেছিলেন তিনি। আমেরিকায় গিয়ে চাকরি শুরু করলেও বেশি দিন টেকেননি। এর পর টাকাপয়সা জোগাড় করে নিজেই ল্যাবরেটরি খুলে বসেন। তাতেই চলত একের পর এক চিন্তা-ভাবনার রূপায়ণ।