আলোর রোশনাই থেকে সরে গিয়েছেন দু’দশক আগে। আর কোনও দিন অভিনয়জগতে ফিরতে চান না। সম্প্রতি প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভমেলায় গিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছেন মমতা কুলকার্নি। এ কথা বিবৃতি জারি করে জানিয়েছে খোদ উত্তরপ্রদেশ সরকার।
জানা গিয়েছে, নিজের পূর্বাশ্রমের যাবতীয় স্মৃতি বিসর্জন দিয়ে পিণ্ডদান করেছেন মমতা। কিন্নর আখড়ার অধীনে ‘মাই মমতা নন্দগিরি’ নাম গ্রহণ করেছেন তিনি। আখড়ার তরফ থেকে তাঁর ‘পট্টাভিষেক’ও হয়েছে।
মহাকুম্ভের মেলা প্রতি ১২ বছর অন্তর বসে ভারতের চারটি স্থানে— হরিদ্বার, নাসিক, উজ্জয়িনী এবং প্রয়াগরাজে (পূর্বতন ইলাহাবাদ)। এর আগে ২০১৩ সালে প্রয়াগরাজের কুম্ভমেলায় গিয়েছিলেন মমতা। তার আগের বছর গঙ্গাস্নান সেরেছিলেন হরিদ্বারে, জানিয়েছিলেন নিজেই। চলতি মাসে প্রয়াগরাজের কুম্ভমেলায় সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন তিনি।
১৯৭২ সালে মুম্বইয়ে একটি মরাঠি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম মমতার। তাঁর বাবা মহারাষ্ট্র পুলিশে কাজ করতেন। মমতার মা ছিলেন গৃহবধূ। বাবা-মা এবং দুই বোনকে নিয়ে মুম্বইয়ে থাকতেন মমতা।
অভিনয়জগতের প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না মমতার। অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর মায়ের। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি তিনি। তাই মমতার চোখ দিয়ে সেই স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। মায়ের স্বপ্ন বাস্তব করতে মডেলিং পেশায় নেমেছিলেন মমতা। সুন্দরী হওয়ার সুবাদে মডেলিংজগতে কম সময়ের মধ্যে নামডাক হয়ে যায় তাঁর।
মডেলিংয়ের সূত্রে ১৯৯১ সালে ‘নানবারগাল’ নামে একটি তামিল ছবিতে প্রথম অভিনয় করেছিলেন মমতা। কেরিয়ারের প্রথম ছবি হিট হওয়ার পর ‘মেরা দিল তেরে লিয়ে’ এবং ‘তিরঙ্গা’ ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলেন তিনি। তার পর মমতাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নব্বইয়ের দশকে ‘করণ অর্জুন’, ‘ঘাতক’-এর মতো একের পর এক হিন্দি ছবিতে অভিনয় করে গিয়েছিলেন তিনি।
কখনও শুধুমাত্র নাচের দৃশ্যে, কখনও বা নায়কের প্রেমিকার চরিত্রে, কখনও মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মমতা। হিন্দি ছবির পাশাপাশি তামিল, তেলুগু, মালয়ালম এবং কন্নড় ভাষার ছবিতে কাজ করেছিলেন তিনি। মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে ‘ভাগ্য দেবতা’ নামের একটি বাংলা ছবিতে অতিথিশিল্পী হিসাবে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করতেন মমতা।
কানাঘুষো শোনা যায়, এক রাজনৈতিক নেতার আমন্ত্রণে রাঁচীতে অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলেন মমতা। সেখানে অনুষ্ঠান করে সওয়া কোটি টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন তিনি। কোনও হিন্দি ছবিতে কাজ করেও সেই সময় বলিউড অভিনেতারা এত পারিশ্রমিক পেতেন না, যা মমতা একটি অনুষ্ঠানে পারফর্ম করে পেয়েছিলেন। বলিপাড়ার গুঞ্জন, পরে নাকি ওই নেতার সঙ্গে পটনায় কিছুটা সময় কাটিয়েছিলেন মমতা।
কেরিয়ারে সাফল্যের সিঁড়ি চড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিতর্কের সঙ্গেও মমতার নাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। সাফল্যের সিঁড়িতে তড়তড়িয়ে ওঠার খিদে জেগে উঠেছিল তাঁর। তিনি ভেবেছিলেন যে, তাঁর কোনও সাহসী ছবি প্রকাশ পেলে ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর চাহিদা বেড়ে যাবে।
সেই সময়ের এক নামী পত্রিকার প্রচ্ছদের জন্য নিজের একটি সাহসী ছবি তুলেছিলেন মমতা। নায়িকার সাহসী ছবি পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ার পর তাঁর উপর ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিলেন বলিপাড়ার অধিকাংশ। তাঁর উদ্দেশে কুমন্তব্যও করেছিলেন অনেকে।
পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে জনসমক্ষে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন মমতা। এমনকি, আদালতে ১৬ হাজার টাকা জরিমানাও দিয়েছিলেন তিনি। কটাক্ষের শিকার হলেও মমতার ছবি প্রকাশ পাওয়ায় পত্রিকাটি বেশি দামে বিক্রি হতে থাকে। অভিনেত্রী জনসমক্ষে ক্ষমা চাওয়ায় সকলে তাঁকে ক্ষমাও করে দিয়েছিলেন। এই ঘটনার পর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আবার চুটিয়ে কাজ করতে শুরু করেছিলেন তিনি।
১৯৯৯ সালে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল ‘চায়না গেট’ নামের একটি হিন্দি ছবি। ছবির শুটিং চলাকালীন পরিচালক রাজকুমার সন্তোষীর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ তুলেছিলেন মমতা। কিন্তু পরিচালক সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন।
রাজকুমারের দাবি ছিল, মমতা মিথ্যা বলছেন। সকলে রাজকুমারের কথাই বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু এই ঘটনার পর ইন্ডাস্ট্রিতে মমতা সম্পর্কে ধারণা বদলে গিয়েছিল।‘চায়না গেট’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর মমতা দাবি করেছিলেন যে, তাঁর অভিনীত দৃশ্যগুলির উপর কাঁচি চালিয়ে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছবিতে যেন বেশি গুরুত্ব পেয়ে যায় ঊর্মিলা মাতন্ডকরের ‘ছম্মা ছম্মা’ নাচটি। তাই এই ছবি মুক্তির পর মমতার চেয়ে ঊর্মিলার জনপ্রিয়তা বেড়ে গিয়েছিল।
‘চায়না গেট’ ছবির পর ইন্ডাস্ট্রিতে মমতার চাহিদাও কমে যেতে শুরু করেছিল। এই ছবির শুটিংয়ের সময় অ্যাকশন ডিরেক্টর তিনু বর্মার সঙ্গে মমতার আলাপ হয়েছিল। তিনু তখন বিবাহিত ছিলেন, দুই সন্তানের বাবাও। তিনুর সঙ্গে মমতার বন্ধুত্ব গভীর হতে থাকে। বলিপাড়ার অধিকাংশের দাবি, তিনু এবং মমতা গোপনে বিয়ে করেছিলেন।
কিন্তু মমতা এবং তিনুর সম্পর্কে হঠাৎ চিড় ধরে। নিত্য অশান্তি হত দু’জনের। তিনুর স্ত্রী তাঁদের সম্পর্কের কথা জানতে পারলে মমতার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন তিনুও। তিনুর সঙ্গে সম্পর্কের কথা কোনও দিন স্বীকার করেননি মমতা। কিন্তু তিনু পুরনো এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে, মমতার জন্য তিনি নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে খুব ভুল করেছিলেন।
২০০২ সালে ‘কভি তুম কভি হম’ ছবিতে শেষ বারের মতো অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল মমতাকে। তার পর ইন্ডাস্ট্রি থেকে একেবারে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। চার বছর পর মমতার নাম উঠে আসে মাদক পাচারকাণ্ডে।
ভিকি গোস্বামী নামে এক মাদক পাচারকারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন মমতা। দু’হাজার কোটি টাকার মাদক পাচারকাণ্ডের তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে যে, এই পরিকল্পনার সময় মমতাকে অন্য অভিযুক্তদের সঙ্গে একই হোটেলে দেখা গিয়েছিল।
মমতার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হলে তিনি জানিয়েছিলেন যে, তাঁকে ফাঁসানো হচ্ছে। এমনকি, ভিকির সঙ্গে সম্পর্কের কথাও অস্বীকার করেছিলেন তিনি। এর পর মুম্বই ছেড়ে ভিকি এবং মমতা দু’জনেই দুবাই চলে গিয়েছিলেন। ভিকির পাঁচ বছরের জেলের সাজা হয়। জেল থেকে ফিরে মমতাকে নিয়ে কেনিয়া চলে যান ভিকি।
বলিপাড়ার জনশ্রুতি, ২০১৩ সালে মমতাকে বিয়ে করেছিলেন ভিকি। যদিও বিয়ের কথা কখনও স্বীকার করেননি মমতা। ড্রাগ পাচারের অভিযোগে ২০১৪ সালে দুবাই থেকে ভিকিকে গ্রেফতার করেছিল কেনিয়া পুলিশ। পরে অবশ্য তিনি জামিনে ছাড়া পেয়েছিলেন।
বলিপাড়া থেকে উধাও হওয়ার পর ২০২২ সালে আবার ক্যামেরার সামনে আসেন মমতা। কিন্তু বড় বা ছোট পর্দায় নয়, ফোনের ক্যামেরার সামনে এসে একটি ভিডিয়ো পোস্ট করেছিলেন তিনি। এই ভিডিয়োটি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় আবার তাঁকে নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছিল। ভিডিয়োয় সন্ন্যাসিনীর বেশে দেখা গিয়েছিল মমতাকে।
ভিডিয়োয় মমতা জানিয়েছিলেন যে, মাদক পাচারের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক ছিল না। ভিকিকেও তিনি বিয়ে করেননি। তাঁরা দু’জন শুধু ভাল বন্ধু ছিলেন। সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে তিনি ধ্যানে মন দিয়েছেন বলেও দাবি করেছিলেন মমতা।
মমতা বলেছিলেন, ‘‘১২ বছর ধরে ধ্যান করছি আমি। এখন আমার সামনে কোনও পুরুষ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেও আমার কিছু যায়-আসে না। আমি অন্তর থেকে পবিত্র হয়ে গিয়েছি।’’ তিনি একটি বই লিখেছেন বলেও জানিয়েছিলেন সেই ভিডিয়োয়। এই ভিডিয়োটি পোস্ট করার পর তিনি আবার নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন।
বলিপাড়া সূত্রে খবর, মমতার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৮৫ কোটি টাকা। সম্প্রতি কুম্ভমেলায় সন্ন্যাস গ্রহণ করে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, অভিনয় আর কখনও করবেন না তিনি।