World War II

স্ক্র্যাপবুক থেকে মেলে হারানো ইতিহাস! প্রকাশ্যে আসেন শয়ে শয়ে শিশুকে বাঁচানো ‘ইহুদিদের দেবদূত’

প্রায় ৬৬০ জন শিশুকে নিরাপদে চেক প্রজাতন্ত্র থেকে ব্রিটেন পৌঁছে দেন ব্রিটিশ যুবক নিকোলাস উইন্টন। দীর্ঘ ৫০ বছর আগের অতীত সম্পর্কে কাউকেই জানতে দেননি নিকোলাস। এমনকি তাঁর অর্ধাঙ্গিনী গ্রেটেকেও নয়।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:৫২
Share:
০১ ২৩

সালটা ছিল ১৯৮৮। চিলেকোঠার ঘর সাফাই করতে করতে এক মহিলা তাঁর স্বামীর একটি স্ক্র্যাপবুক খুঁজে পান। তাতে চোখ বোলাতেই ৫০ বছরের এক গুপ্ত ইতিহাস উঠে আসে দিনের আলোয়। অর্ধশত বছর ধরে সেই ইতিহাস লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে গিয়েছিল। কাকপক্ষীতেও টের পায়নি সেই খবর।

০২ ২৩

ফাইলটিতে ছিল প্রায় ৬০০ শিশুর ছবি, তাদের নাম, তাদের বাবামায়ের কাছ থেকে পাওয়া চিঠি, তাদের ব্রিটেনে পাঠানোর পরিকল্পনা এবং কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। সেই ফাইল নিয়ে সোজা হলোকাস্ট বিশেষজ্ঞ এলিজাবেথ ম্যাক্সওয়েলের দ্বারস্থ হন ওই মহিলা। সেখানেই উদ্ঘাটিত হয় তাঁর স্বামী নিকোলাস উইন্টনের লুকিয়ে রাখা রহস্যের।

Advertisement
০৩ ২৩

১৯৩৯ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবে শুরু। পৃথিবী জুড়ে চলছে হিটলারের ইহুদি নিধন যজ্ঞ। সেই যজ্ঞের বলি হতে যাওয়া প্রায় ৬৬০ জন শিশুকে নিরাপদে নাজ়ি অধিকৃত চেকোস্লোভাকিয়া (অধুনা চেক প্রজাতন্ত্র) থেকে ব্রিটেন পৌঁছে দেন ব্রিটিশ যুবক নিকোলাস উইন্টন। দীর্ঘ ৫০ বছর আগের অতীত সম্পর্কে কাউকেই জানতে দেননি নিকোলাস। এমনকি তাঁর অর্ধাঙ্গিনী গ্রেটেকেও নয়।

০৪ ২৩

১৯০৯ সালে ১৯ মে ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট হ্যাম্পস্টেডে এক পরিবারে জন্ম নিকোলাসের। তাঁর পরিবার জার্মান ইহুদি ছিল। পরে তাঁরা ইংল্যান্ডে এসে ধর্ম পরিবর্তন করেন। স্কুল ও কলেজ শেষ করে ইংল্যান্ডের স্টক এক্সচেঞ্জের এক জন স্টক ব্রোকার হিসাবে কাজ শুরু করেন তিনি।

০৫ ২৩

সব ঠিকই ছিল। ১৯৩৮ সালে ছুটি কাটানোর জন্য এবং স্কি করার উদ্দেশ্যে সুইৎজ়ারল্যান্ড যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। কিন্তু সেই পরিকল্পনায় ইতি টানতে বাধ্য হন নিকোলাস। বন্ধু মার্টিন ব্লেকের একটি অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি তিনি। ব্লেক সে সময় ব্রিটিশ কমিটির সহযোগী হিসাবে নাজ়ি অধিকৃত চেক প্রজাতন্ত্রের শরণার্থী শিবিরে কাজ করছিলেন।

০৬ ২৩

ব্লেক নিকোলাসকেও এই কাজে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেন। বন্ধুর আহ্বানকে অগ্রাহ্য করতে পারেননি নিকোলাস। ছুটি কাটানো বাতিল করে তিনি পৌঁছে যান চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগে। সেখানে এসে আমূল বদলে যায় নিকোলাসের আগামী কয়েক মাসের রোজনামচা।

০৭ ২৩

১৯৩৮-এর অক্টোবরে জার্মানি ও অন্য ইউরোপীয় পরাশক্তিদের মধ্যে ‘মিউনিখ চুক্তি’ হওয়ার পর নাজ়িরা চেকোস্লোভাকিয়ার পশ্চিম দিকের একটা অংশ নিজেদের দখলে নেওয়ার জন্য হামলা চালায়। প্রাগ থেকে চেকের সুডেটেনল্যান্ডের শিবিরে এসে পৌঁছে নিকোলাস দেখেন সেখানকার ইহুদিরা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দিন কাটাচ্ছেন। বিশেষ করে শিশুরা।

০৮ ২৩

জার্মানির আগ্রাসী মনোভাব দেখে গোটা বিশ্ব আন্দাজ করে নিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়ের অপেক্ষা। প্রতিটি আশ্রয় শিবিরে দেখা দিয়েছিল খাদ্যের হাহাকার। কারও কাছে খাবার কেনার সামর্থ্য ছিল না। শিবিরে থাকা বাচ্চাদের নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছিলেন মায়েরা। তাঁরা মনে প্রাণ চাইছিলেন যে কোনও ভাবে সন্তানদের অন্য দেশে নিরাপদে পৌঁছে দিতে।

০৯ ২৩

এই অবস্থায় নিকোলাসের দেশ ব্রিটেন ইহুদি শরণার্থী ও শিশুদের সুরক্ষা দিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ১৯৩৯ সালের শেষের দিকে শুরু হয় ‘কিন্ডারট্রান্সপোর্ট’। এখানে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত অভিভাবকহীন ইহুদি শিশুদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। শর্ত ছিল ব্রিটেনে আশ্রয়দাতা পরিবার থাকতে হবে ও ৫০ ডলার করে জমা রাখতে হবে সরকারের কাছে।

১০ ২৩

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১০ হাজার ইহুদি শিশুকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও চেকোস্লোভাকিয়ার ক্ষেত্রে এই উদ্ধারকাজ তেমন এগোচ্ছিল না। অগণিত পরিবার আশ্রয়হীন ভাবে ঘুরে বেড়াতে থাকে রাস্তায়। উইন্টন চুপ করে থাকতে পারলেন না এমন বিপর্যয় দেখে। সুডেটেনল্যান্ডের শিবিরে হাত গুটিয়ে বসে না থেকে নিজের উদ্যোগে এখানকার শিশুদের ব্রিটেনে পাঠানোর জন্য উঠেপড়ে লাগেন।

১১ ২৩

সরকারি অনুমোদন ব্যতীত হোটেলের ঘরেই খুলে বসেন একটি অস্থায়ী অফিস। নিরাপদ ভবিষ্যতের আশায় বেশির ভাগ বিপর্যস্ত ইহুদি পরিবার তাঁদের সন্তানদের ছেড়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। উইন্টনের অফিসে হাজার হাজার আবেদন জমা পড়ত প্রতি দিন।

১২ ২৩

হাজার হাজার ছিন্নমূল ইহুদির কাছে নিকোলাসই ছিলেন শেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু একসঙ্গে এত শিশুকে সুরক্ষিত পরিবারে নিরাপদ জীবনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া নিকোলাসের পক্ষে অসাধ্য ছিল।

১৩ ২৩

এই শিশুদের ব্রিটেনে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন ছিল বিপুল অর্থের। সেই তহবিল সংগ্রহের জন্য লন্ডনে ফিরে আসেন উইন্টন। বিভিন্ন দেশ থেকে সহায়তা চেয়ে যোগাযোগ শুরু করেন তিনি। পাহাড়প্রমাণ দায়িত্ব চাপে উইন্টনের কাঁধে। সকালে স্টক মার্কেটে সময় দিতে হত রুজিরুটির জন্য। এর পরের অবসর সময়টুকু তিনি শিশুদের উদ্ধারের কাজে ব্যয় করতে লাগলেন।

১৪ ২৩

অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও ভাগ্য খুব একটা সহায় হল না নিকোলাসের। ছোটাছুটিই সার হল। ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে তেমন একটা সাহায্যের মনোভাব দেখা গেল না। ফলে নিজেই কোমর বেঁধে নামলেন তিনি। তাঁর শিবিরে আশ্রয়ে থাকা বাচ্চাদের ছবি তুলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আটকে দিতে শুরু করলেন। নিকোলাসের আশা ছিল, ছবি দেখে যদি কোনও সহৃদয় পরিবারের মন গলে ও সেই বাচ্চাকে আশ্রয় দিতে তাঁরা রাজি হয়ে যান।

১৫ ২৩

অবশেষে ভাগ্যদেবতা সুপ্রসন্ন হলেন নিকোলাসের প্রতি। ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে উইন্টনের উদ্যোগে বাচ্চাদের নিয়ে প্রথম বিমানটি প্রাগ থেকে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা দেয়। ঠিক তার পর দিনই হিটলার তাঁর বাহিনী নিয়ে প্রাগের দিকে যাত্রা শুরু করেন। এই ঘটনার পর অবশ্য আরও সাত বার শিশুদের নিয়ে রেলপথে ও পরে জাহাজে ব্রিটেনে নিয়ে আসেন তিনি।

১৬ ২৩

জার্মানরা বোহেমিয়া এবং মোরাভিয়া দখল করার পর উইন্টন আরও সাতটি পরিবহণের ব্যবস্থা করেন যা প্রাগ থেকে প্রথমে রেলপথে আটলান্টিক উপকূলে এসে পৌঁছয়। তার পর জাহাজে করে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ব্রিটেনে চলে যায় শিশুরা।

১৭ ২৩

১৯৩৯ সালের ২ অগস্ট শিশুদের নিয়ে শেষ ট্রেনটি প্রাগ ছেড়ে আসে। জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে এবং সেই বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুতে ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে উদ্ধার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। হতাশা এবং আফসোস উইন্টনকে ঘিরে ধরেছিল সেই সময়।

১৮ ২৩

ফিরে আসা যাক ১৯৮৮ সালে। নিকোলাসের কীর্তি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতেই আলোড়ন পড়ে যায় দেশ জুড়ে। চিরকাল প্রচারের আলো থেকে দূরে থাকা এই মহান ব্যক্তিত্বকে সম্মান জানিয়ে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল বিবিসি।

১৯ ২৩

হলরুম কানায় কানায় ভর্তি দর্শকে। সেই অনুষ্ঠানেই একটি চমক অপেক্ষা করছিল নিকোলাসের জন্য, যা তাঁর কাছে ছিল সম্পূর্ণ অজানা। বৃদ্ধ মানুষটি জানতেনই না, তাঁর চারপাশে যাঁরা বসে আছেন, এক সময় তাঁদেরই বাঁচিয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ অনুষ্ঠানের সঞ্চালিকা এক জনের নাম ঘোষণা করেন। সেই মহিলা বসেছিলেন বৃদ্ধ নিকোলাসের পাশেই। তিনি হঠাৎই বৃদ্ধকে জড়িয়ে ধরেন।

২০ ২৩

মহিলা আর কেউ নন, যে সব শিশুর প্রাণ নিকোলাস বাঁচিয়েছিলেন, তিনি তাঁদেরই এক জন। আবেগের বশে তিনি প্রাণদাতাকে জড়িয়ে ধরেন। সেই ঘটনায় আবেগকে চাপা দিতে পারেননি নিকোলাসও। অতীতের পর্দা সরে গিয়ে ভেসে আসে উদ্ধারের স্মৃতি। আনন্দাশ্রুতে চোখের কোল ভিজে যায় তাঁরও।

২১ ২৩

নিকোলাসের অভূতপূর্ব অবদানের জন্য ২০০৩ সালে তাঁকে ‘নাইট’ উপাধি দেন ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ। স্যর নিকোলাস উইন্টন নামে সারা বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত হন তিনি।

২২ ২৩

২০১০ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘হলোকাস্টের ব্রিটিশ নায়ক’ উপাধি প্রদান করে। ২০১৪-এর ২৮ অক্টোবর চেক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট নিকোলাসকে সে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘অর্ডার অফ দ্য হোয়াইট লায়ন’ প্রদান করেন। প্রাগের যে স্টেশন থেকে শেষ বারের মতো তিনি শিশুদের নিয়ে যাত্রা করেন সেখানে তাঁর একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়।

২৩ ২৩

২০১৫ সালের ১ জুলাই, ১০৬ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের ওয়েকসাম পার্ক হসপিটালে ঘুমন্ত অবস্থায় মারা যান বহু ইহুদি বাবা-মায়ের দেবদূত নিকোলাস উইন্টন।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement