ভয় ছিল, তাঁকে খুন করা হতে পারে। ঘনিষ্ঠ মহলে নাকি তেমন আশঙ্কাই করতেন দক্ষিণ আফ্রিকার নামজাদা রূপটানশিল্পী মায়া ইয়ানেস্কা। শেষমেশ কি তাঁর সে আশঙ্কাই সত্যি হল?
শোয়ার ঘরে মায়ার নিথর দেহ দেখতে পান তাঁর সঙ্গী কাইল ফিলিপস। তার পর থেকে ৩৯ বছরের মায়ার রহস্যমৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।
ডিসেম্বরের গোড়ায় মায়ার বিলাসবহুল বাংলোয় তাঁর গুলিবিদ্ধ দেহ দেখেন কাইল। দক্ষিণ আফ্রিকার তামাক ব্যবসায়ী কাইলের দাবি, সে সময় তিনি দাঁত মাজছিলেন। তখনই তাঁদের শোয়ার ঘর থেকে একটি গুলির আওয়াজ কানে আসে।
পুলিশের কাছে কাইলের দাবি, গুলির আওয়াজ শুনে ছুটে শোয়ার ঘরে যান। দেখেন, তাঁদের বিছানায় পড়ে রয়েছে মায়ার নিথর দেহ। মাথায় গুলির ক্ষত। এর পর পুলিশে খবর দেন তিনি।
মায়ার অকালমৃত্যুতে সমাজমাধ্যমে তো বটেই, বিশ্বের নানা সংবাদমাধ্যমে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। কে বা কারা মায়াকে গুলি করলেন? না কি এটি নিছকই আত্মহত্যার ঘটনা।
মায়ার মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে অবশ্য এখনই কিছু বলতে নারাজ তদন্তকারীরা। তাঁরা জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে রহস্যমৃত্যু নিয়ে কিছু প্রকাশ করলে তাতে তদন্ত ব্যাহত হতে পারে।
জোহানেসবার্গের বাসোনিয়া এস্টেটে মায়ার বিলাসী বাংলো থেকে তাঁর দেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাভেলা মাসোন্ডো সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘‘খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখা যায়, বেডরুমে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এক মহিলার দেহ পড়ে রয়েছে। মাথায় গুলির ক্ষত। তাঁর পাশেই একটি আগ্নেয়াস্ত্র পড়েছিল। প্যারামেডিকস ওই মহিলাকে মৃত হলে ঘোষণা করেছেন।’’
রূপটানশিল্পী এবং স্টাইলিস্ট হওয়ার পাশাপাশি সমাজমাধ্যমে প্রভাবী হিসাবেও বেশ নামডাক কুড়িয়েছিলেন মায়া। শুধু ইনস্টাগ্রামেই তাঁর অনুরাগীর সংখ্যা ১২ লক্ষ। সেই সঙ্গে অনলাইনে নানা বিধ কনটেন্ট তৈরি করেও কম প্রচার পাননি তিনি। অনেকের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘মায়া মিয়া’ নামে।
দক্ষিণ আফ্রিকার অভিজাত মহলের পাশাপাশি জন্মভূমি নর্থ ম্যাসেডোনিয়ার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গেও দহরম মহরম ছিল মায়ার। তাঁর রহস্যমৃত্যুর পর নানা জনেই সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলেছেন।
ঘনিষ্ঠদের দাবি, জোহানেসবার্গের তামাক উৎপাদনকারী সংস্থা ‘কার্নিলিনক্স’-এর সহ অধিকর্তা কাইলের সঙ্গে ডেটিং করছিলেন মায়া। মায়ার বাংলোতেই থাকতেন ‘সিগারেট-টাইকুন’ কাইল। বস্তুত, ঘটনার দিনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন তিনি।
সংবাদমাধ্যমের দাবি, মায়ার অকালমৃত্যুতে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছেন কাইল। এই রহস্যমৃত্যু নিয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। তদন্তকারীদের কথায়, ‘‘এই মুহূর্তে রহস্যমৃত্যুতে কোনও সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি।’’
জোহানেসবার্গ পুলিশের পাশাপাশি মায়ার মৃত্যু নিয়ে নিজের মতো করে তদন্তে নেমেছেন কাইল। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের দাবি, পুলিশের প্যাথোলজিস্টকে দিয়ে মায়ার দেহের ময়নাতদন্তে আপত্তি তুলেছেন তিনি। কাইল জানিয়েছেন, মায়ার ময়নাতদন্তের জন্য এক জন প্যাথোলজিস্টকে ভাড়া করেছেন তিনি। যদিও কবে মায়ার ময়নাতদন্ত করা হবে, তা নিয়ে বিশেষ কিছু জানাননি কাইল।
মায়ার অকালমৃত্যুর খবরে স্বাভাবিক ভাবেই ভেঙে পড়েছেন তাঁর পরিবারের সদস্য-সহ আত্মীয়-পরিজনেরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আত্মীয় সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘‘খবরটা পাওয়ার পর থেকে আমাদের মোবাইল বেজেই চলেছে। এই মুহূর্তে ইউরোপে রয়েছি। ভিসা সংক্রান্ত সমস্যায় দক্ষিণ আফ্রিকার যেতে পারছি না। ফলে আমাদের হাত-পা বাঁধা। মায়ার দেহ মর্গে পড়ে রয়েছে আর আমাদের কোনও ধারণাই নেই, ওখানে ঠিক কী হচ্ছে!’’
ওই আত্মীয় জানিয়েছেন, কাইলের এক প্রাক্তন সহযোগীর মারফত মায়ার মৃত্যুর খবর জানতে পারেন তাঁরা। সেই সহযোগীর দাবি, কাইল আত্মঘাতী হয়েছেন।
যদিও মায়ার ওই আত্মীয়ের দাবি, ‘‘মায়া আত্মহত্যা করতে পারেন, তা আমার কখনই মনে হয়নি। উনি খুব খোলা মনের মানুষ ছিলেন।’’ মায়া এবং কাইলের সম্পর্ক নিয়েও মুখ খুলেছেন ওই আত্মীয়। তাঁর মতে, ‘‘পরস্পরের প্রতি অগাধ ভালবাসা ছিল। ওঁদের মধ্যে এমন কিছু সমস্যা ছিল না যাতে মায়া নিজেকে শেষ করে দিতে পারেন। তেমন কোনও ইঙ্গিতও পাইনি। ফলে এটা খুবই আশ্চর্যের!’’
ওই আত্মীয়ের আরও দাবি, ‘‘অনেক সময়ই মৃত্যুভয়ে সিঁটিয়ে থাকতেন মায়া। ওঁর প্রেমিকের সঙ্গে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁদেরও ভয় পেতেন। আমরা সত্যিই জানি না, কী করা উচিত।’’
মায়ার মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কট্টর দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল ইকোনমিক ফ্রিডম ফাইটার্স-এর নেতা তথা মায়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জুলিয়াস মালেমা। সাংবাদিকদের সম্মেলন করে তিনি বলেন, ‘‘কাইলের সঙ্গে এখনও কথা হয়নি। তবে মায়া আর আমি বন্ধু ছিলাম। অত্যন্ত উদারমনস্ক ছিলেন মায়া। দেশের জন্য নানা পরিকল্পনাও ছিল তাঁর।’’
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, মৃত্যুর ৯ দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের একটি অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে গিয়েছিলেন মায়া। সেখানে তিনি জানিয়েছিলেন, ১৯ বছর বয়সে চাকরির সন্ধানের তানজানিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন।
তানজানিয়ায় থাকাকালীন সে দেশের একটি হোটেলে কাজ করতেন মায়া। সে সময় থেকে সোয়াহিলি ভাষা রপ্ত করেছিলেন। এক সময় রূপটানশিল্পী এবং স্টাইলিস্ট হিসাবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
ইনস্টাগ্রামে মায়ার শেষ পোস্টটি ছিল ২২ নভেম্বর। ওই পোস্টে উত্তর ম্যাসেডোনিয়ার বিদেশমন্ত্রী বুয়ার ওসমানির সঙ্গে দেখা গিয়েছিল মায়াকে। ওই পোস্টে মায়া জানিয়েছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে জন্মভূমির কূটনৈতিক সুসম্পর্ক গড়ে তোলাই তাঁর লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই ওসমানির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন তিনি। যদিও সে লক্ষ্যপূরণের অনেক আগেই থেমে গেলেন মায়া।