পকেটে তখন মাত্র ২৪ টাকা। চোখে একরাশ স্বপ্ন। উপার্জন করবেন বলে স্কুলে পড়ার সময় পড়াশোনা ছেড়ে দেন। বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে চলে আসেন স্বপ্ননগরীতে। খবরের কাগজ বিক্রি করে উপার্জন করা শুরু। এখন প্রতি বছর ২৫ লক্ষ টাকা উপার্জন করেন মুন্না ঠাকুর। মুন্না পেশায় আলোকচিত্রী। অমিতাভ বচ্চন, তাপসী পান্নু, সুনীল শেট্টি, ইরফান খান, সলমন খানের মতো তারকাদের ছবি তোলেন তিনি।
৪৭ বছর বয়সি মুন্নার জন্ম মহারাষ্ট্রের আকোলায়। বাবা-মা এবং দুই ভাইকে নিয়ে এক ছাদের তলায় থাকতেন তিনি। মুন্নার বাবা তুলোর কারখানায় কাজ করতেন। নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর মতো অবস্থা ছিল তাঁদের। কম বয়সেই দারিদ্র দেখেছিলেন মুন্না।
সংসারের খরচ কী ভাবে সামলানো যায়, সেই চিন্তাতেই মগ্ন থাকতেন মুন্না। খরচের জন্য স্কুলের গণ্ডিও পার করতে পারেননি তিনি। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে স্কুল ছেড়ে দেন মুন্না।
আকোলাতেই ছোটখাটো কাজে হাত লাগিয়েছিলেন মুন্না। সৎপথে যে কোনও কাজ করে উপার্জন করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। ১৪ বছর বয়সে কাজ শুরু করেন তিনি। স্কুল ছাড়ার পরেও অন্যান্য কাজের খোঁজে এ দিক-ও দিক ঘুরে বেড়াতেন মুন্না।
উপার্জনের জন্য দিনমজুরি, রংমিস্ত্রির কাজ থেকে ছুতোরের কাজও করেছেন তিনি। আয়ের জন্য তাঁর কাছে যে কাজই আসত, তিনি করতেন।
১৯৯১ সালে ১৫ বছর বয়সে চার বন্ধুর সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে মুম্বই পাড়ি দেন মুন্না। এক সাক্ষাৎকারে মুন্না জানিয়েছেন যে, পকেটে মাত্র ২৪ টাকা নিয়ে মুম্বই শহরে পা রেখেছিলেন তিনি। মুন্নার ধারণা ছিল, মুম্বইয়ের মতো বড় শহরে কাজ পাওয়া খুব একটা মুশকিল হবে না। কিন্তু মুম্বইয়ে এসে তাঁর এই ধারণা ভেঙে যায়।
সাক্ষাৎকারে মুন্না জানান, মুম্বই শহর তাঁকে আপন করে নেয়নি। পড়াশোনা বেশি দূর করেননি বলে ছোটখাটো কাজই পাচ্ছিলেন তিনি। হিরে কাটা, হিরে পালিশ করা থেকে শুরু করে ওয়েল্ডিংয়ের দোকানেও কাজ করেছেন মুন্না। প্রায় এক বছর এই ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।
তার পর খবরের কাগজ বিক্রির কাজ শুরু করেন মুন্না। সকালে খবরের কাগজ বিক্রির কাজ শেষ করে দিনের বাকি সময়টুকু অন্যান্য কাজ করতেন তিনি। ১৯৯৩ সালে একটি স্টুডিয়োয় খবরের কাগজ বিক্রি করা শুরু করেন মুন্না। সেই স্টুডিয়োয় বলিপাড়ার তারকাদের ছবি তোলা হত।
স্টুডিয়োয় কাজ করার জন্য সেখানকার কর্মীদের কাছে অনুরোধ করেন মুন্না। প্রায় পাঁচ বছর স্টুডিয়োয় খবরের কাগজ বিক্রির পর সেখানে ইন্টার্ন হিসাবে যুক্ত হন তিনি। কাশ্মীরের বাসিন্দা বিলালের হাত ধরে ছবি তোলার ‘অ আ ক খ’ শেখেন মুন্না।
সাক্ষাৎকারে মুন্না জানান, দামি ক্যামেরা সামলাতে পারবেন না বলে স্টুডিয়োতে ক্যামেরায় হাত দিতে দেওয়া হত না মুন্নাকে। কী ভাবে ক্যামেরায় ছবি তোলা হয়, তা মুন্নাকে প্রথম শেখান ওই স্টুডিয়োর কর্মী বিলাল। বিলালের সঙ্গে বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানে ছবিও তুলতে যেতেন মুন্না।
এমনকি, বিলালের বিয়ের অনুষ্ঠানে ফোটোগ্রাফির দায়িত্বেও ছিলেন মুন্না। ছবি তোলার প্রাথমিক বিষয় জানার পর নামী এক আলোকচিত্রীর সহকারী হিসাবে কাজ শুরু করেন তিনি। কিন্তু পাশাপাশি খবরের কাগজ বিক্রির কাজও চালিয়ে যান মুন্না।
বলি অভিনেতা অর্জুন রামপালের বাড়িতে খবরের কাগজ পৌঁছে দিতে যেতেন মুন্না। অর্জুনের ফোটোশুট করার কথা মাথায় আসে তাঁর। অভিনেতার বাড়ির এক ভৃত্যের সঙ্গে ভাব জমিয়ে অর্জুনের বাড়িতে ঢুকে পড়েন মুন্না।
অর্জুনের কাছে ফোটোশুটের ইচ্ছা প্রকাশ করেন মুন্না। কিন্তু তাঁর কাছে টাকা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। মুন্নার সঙ্গে বিনা পারিশ্রমিকে ফোটোশুট করান অর্জুন। তার পরেই বলিপাড়ায় ধীরে ধীরে যোগাযোগ তৈরি করতে শুরু করেন মুন্না।
মুন্না এক সাক্ষাৎকারে জানান, সলমন খান এবং সুনীল শেট্টির মতো বলি তারকারা তাঁর কেরিয়ার তৈরিতে সাহায্য করেছেন। ইন্ডাস্ট্রিতে নবাগত তারকাদের কাছে ফোটোশুটের জন্য মুন্নার নাম উল্লেখ করতেন তাঁরা।
সোনু সুদের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতেন মুন্না। সোনু যখন ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথম এসেছিলেন সেই সময় আর্থিক পরিস্থিতি খুব একটা ভাল ছিল না তাঁর। মুম্বইয়ের ওশিয়ারার একটি বাড়িতে সোনুর সঙ্গে থাকতেন মুন্না।
মুন্না বলেন, ‘‘অতিমারির সময়ে লোকজন সোনুকে ‘মসিহা’ বলে জানতে পারেন। কিন্তু সোনুর স্বভাব বরাবরই এ রকম। আমার মাথা গোঁজার কোনও ঠাঁই ছিল না জেনে আমাকে ওর সঙ্গে থাকতে বলেছিল সোনু। ওর সঙ্গে এখনও আমার ভাল বন্ধুত্ব রয়েছে।’’
আলোকচিত্রী মুন্নার মতে, তিনি যদি অর্থাভাবের মুখে না পড়তেন তা হলে এত দূর আসতে পারতেন না। তিনি বলেন, ‘‘আমি বড়লোক হওয়ার আশায় মুম্বইয়ে আসিনি। সংসার চালানোর মতো রোজগার করলেই হয়ে যেত। কিন্তু আমি কখনও কোনও কাজে আপত্তি জানাইনি। কোনও কাজ করতে ভয় পাই না আমি। আমার প্যাশন নিয়েই আমি এখন কাজ করি।’’