ভূমিকম্পের জেরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল প্রায় ২০০টি মন্দির। তবে মধ্যপ্রদেশের বটেশ্বর মন্দির চত্বরে আট বছর ধরে খননকাজ চালিয়ে অন্তত ৮০টিকে উদ্ধার করতে পেরেছিলেন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া বা এএসআই)-এর পুরাতত্ত্ববিদ কেকে মহম্মদ।
বটেশ্বর মন্দির চত্বরে মাটি চাপা পড়া ওই মন্দিরগুলির সংস্কারের কাজেও জড়িত ছিলেন তিনি। ওই খনন এবং সংস্কারের কাজে সাহায্য পেয়েছিলেন চম্বলের কুখ্যাত ডাকাতনেতা নির্ভয় সিংহ গুজ্জরের।
কী ভাবে এই অসাধ্যসাধন করলেন কেকে? নিজের এলাকায় দলবল নিয়ে ঢুকে কেকে যাতে খননকাজ করতে পারেন, সে জন্য তাঁর কাছে কোন শর্ত দিয়েছিলেন গুজ্জর?
উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশ— এই তিন রাজ্যের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে চম্বল উপত্যকা। ২০০৪ সালে সেখানকার বটেশ্বর মন্দির চত্বরে খননকাজ শুরু করেন কেকে। সে সময় ওই উপত্যকায় দলবল নিয়ে রাজত্ব করতেন কয়েক জন ডাকাতনেতা। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গুজ্জর।
অনেকের মতে, চম্বলের শেষ ডাকাত ছিলেন গুজ্জর। সে জন্য ‘চম্বলের শেষ সিংহ’ নামে পরিচিতি ছিল তাঁর। উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের কাছে ৩১ বছর ধরে ত্রাসের রাজত্ব ছিল গুজ্জরের।
চম্বল উপত্যকা থেকে বহু যোজন দূরে কেরলের কালিকটে বড় হয়েছিলেন কেকে। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য উত্তরপ্রদেশে পা রাখেন। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর করার পর সত্তরের দশকে নয়াদিল্লি পাড়ি দেন। সেখানকার এএসআই থেকে পুরাতত্ত্বে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা লাভ করেন।
কেকে-র কর্মজীবন শুরু হয়েছিল আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে। গোড়ায় সেখানকার ইতিহাস বিভাগে টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ শুরু করেছিলেন। পরে সহকারী পুরাতত্ত্ববিদ হিসাবেও দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। এর পর এএসআইয়ের ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদে যোগ দেন। এএসআইয়ে আঞ্চলিক অধিকর্তা (উত্তর) হিসাবেও কাজ করেছেন তিনি।
দেশের নানা রাজ্যে কাজ করেছেন কেকে। তবে ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময় মধ্যপ্রদেশে তাঁর বদলির পর এমন বহু খননকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যা তাঁর কর্মজীবনের উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে রয়েছে। তাঁর মধ্যে অন্যতম বটেশ্বর মন্দির চত্বরের খননকাজ।
তবে চম্বল উপত্যকায় ওই পরিত্যক্ত মন্দির চত্বর খননকাজ শুরু করার ক্ষেত্রে একাধিক বাধা ছিল। তার মধ্যে অন্যতম ছিল, গুজ্জর-সহ চম্বলের ডাকাতদের হামলার ভীতি। ছিল খনি মাফিয়াদের দাপট। তবে মূলত ডাকাতদের ভয়ে ওই এলাকায় পা রাখতে চাইতেন না কেউ। ২০০৪ সালে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে সেখানে খননকাজ শুরু করেছিলেন কেকে।
গোয়ালিয়র থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে চম্বলের ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া বটেশ্বর মন্দিরগুলি অষ্টম থেকে দশম শতকের মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল। সে সময় উত্তর ভারতের অনেকাংশ জুড়ে গুর্জরা-প্রতিহরা বংশের রাজত্ব।
খাজুরাহোর মন্দির তৈরির দু’শো বছর আগে বটেশ্বরের মন্দিরগুলি নির্মাণ করেছিলেন গুর্জরা-প্রতিহরা অধিপতিরা। তবে ডাকাতদের ভয়ে পর্যটকদের মতোই এএসআইয়ের বহু আধিকারিক নাকি সেখানে যেতে রাজি ছিলেন না। যদিও ১৯২৪ সালে বটেশ্বরের শিব এবং বিষ্ণুর মন্দিরগুলিকে সংরক্ষিত বলে ঘোষণা করেছিল এএসআই।
খননকাজের আগে বটেশ্বর মন্দির চত্বরের ধ্বংসস্তূপে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল মোটে দু’টি মন্দির। তবে কেকে-র অভিজ্ঞ নজর জানিয়েছিল, ওই চত্বরে খননকাজ চালিয়ে বাকি মন্দিরগুলি উদ্ধার করা যেতে পারে। কিন্তু গুজ্জরের মতো ডাকাতনেতার ত্রাস এড়িয়ে সেখানে কী ভাবে ঢোকা যাবে?
কেকে-র দাবি, চম্বলে ঢুকে গুজ্জরকে আশ্বস্ত করতে পেরেছিলেন তিনি। গুজ্জরকে বুঝিয়েছিলেন, প্রাচীন মন্দিরগুলির উদ্ধার এবং সংস্কার করাই এএসআইয়ের লক্ষ্য। পরিবর্তে একটি শর্তপূরণ করা হলে খননকাজ চলাকালীন চম্বলের ওই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র সরে যেতে রাজি হয়েছিলেন গুজ্জর।
‘চম্বলের শেষ সিংহের’ সঙ্গে কী ভাবে সাক্ষাৎ হল কেকে-র? এক সভায় নিজের ভাষণে সে অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন কেকে। সে সময় বটেশ্বর মন্দির চত্বরে সবেমাত্র খননকাজ শুরু হয়েছে। কেকে-র কানে এসেছিল, ছদ্মবেশ ধরে মন্দির চত্বরে কাজ দেখে যাচ্ছেন গুজ্জর।
এক সন্ধ্যায় বটেশ্বরের একটি মন্দিরের বাইরে এক ব্যক্তিকে বসে থাকতে দেখেন কেকে। আলুথালু বেশ। বিড়িতে সুখটান দিচ্ছেন। মন্দির চত্বরে বসে বিড়ি খাচ্ছেন কেন? এতে কি এখানকার বিগ্রহের অসম্মান করা হয় না? খানিকটা ধমকের সুরেই ওই ব্যক্তিকে বলেছিলেন কেকে।
তা দেখে ছুটে আসেন খননকাজের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় এক বাসিন্দা। মুখ বন্ধ রাখতে অনুরোধ করেন কেকে-কে। স্থানীয় বাসিন্দার ওই পরামর্শ শুনেই কেকে বুঝতে পারেন, চম্বলের ডাকাতনেতা খোদ গুজ্জরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে নাকি তাঁর পায়ের কাছে বসে পড়েন।
সেই সন্ধ্যায় গুজ্জরের সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথন হয়েছিল কেকে-র। তাঁর আর্জি ছিল, মন্দিরের খননকাজ এখনও বাকি। তাতে যেন বাধা সৃষ্টি না করা হয়। ওই কাজের গুরুত্ব সম্পর্কেও বুঝিয়েছিলেন গুজ্জরকে। সে সন্ধ্যায় নাকি গুর্জরা-প্রতিহরা বংশের বীরত্বের কাহিনি কেকে-কে শুনিয়েছিলেন ওই ডাকাতনেতা।
কেকে-র মতে, সেই সন্ধ্যায় গুজ্জরের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন ছিল ওই প্রকল্পের মোড়ঘোরানো দিক। কারণ, খননকাজের জন্য দলবল নিয়ে সাময়িক ভাবে এলাকা থেকে অন্যত্র সরে যেতে রাজি হয়েছিলেন ওই ডাকাতনেতা। বদলে একটি শর্ত ছিল গুজ্জরের। তাতে রাজি হয়েছিলেন কেকে।
গুজ্জরের শর্ত ছিল, ওই এলাকার হনুমান মন্দিরে প্রার্থনা করতে দিতে হবে তাঁকে। বছরের পর বছর ধরে ‘কাজে’ বেরোনোর আগে যে প্রথা মেনে এসেছেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে তাতে রাজি হয়ে যান কেকে। কথা দেন, সন্ধ্যা ৬টার পর তো এমনিও তাঁরা কাজ গুটিয়ে নেন। ফলে তাঁদের খননকাজের জন্য গুজ্জরের প্রার্থনায় ব্যাঘাত ঘটবে না।
এই এক শর্তে ‘প্রাণ’ ফিরে পায় বটেশ্বর মন্দির চত্বর। ২০০৫ সালে মৃত্যু হয় নির্ভয় সিংহ গুজ্জরের।