আয়নার আবির্ভাব হয়েছিল চার হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তবে, কাচের তৈরি আয়না তৈরি হয় এর বহু বছর পর।
প্রথম দিকে কাচ নয়, বরং ধাতুর তৈরি আয়না ব্যবহার করা হত। হাতল দেওয়া ছোট আকারের আয়না তৈরি করা হত।
এই আয়নার মধ্যেও লুকিয়ে আছে রহস্য। এই রহস্যের সূত্রপাত কেরলের প্রাচীন ইতিহাসের পাতায়। ঘটনার সময়কাল প্রসঙ্গে স্পষ্ট ধারণা অবশ্য পাওয়া যায় না।
তবে, লোকমুখে আজও এই কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। দক্ষিণ ভারতের সবচেয়ে পুরনো মন্দিরের মধ্যে অরনমুলা পার্থসারথি মন্দির অন্যতম।
ভগবান বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণকে এই মন্দিরে পুজো করা হয়। শোনা যায়, বহু বছর আগে এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত দেবতার মাথার মুকুটে ফাটল লক্ষ করেন।
রাজার কঠোর নির্দেশ ছিল, যে করেই হোক তিন দিনের মধ্যেই এই মুকুট সারাতে হবে। কিন্তু এত কম সময়ের মধ্যে মুকুট তৈরির জন্য কাঁচামাল বা পাওয়া যাবে কী করে?
এর ফলে কারিগরদের সকলেই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন।এই সময়ই নাকি প্রধান কারিগরের স্ত্রীর সঙ্গে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে।
মন্দিরের দেবতা তাঁর স্বপ্নে দেখা দিয়ে নিজেই নাকি মুকুট তৈরির পদ্ধতি বলে দেন। তিনি এমন এক সংকর ধাতুর কথা বলেন যা দেখতে অবিকল আয়নার মতো।
পরের দিন সকালে কারিগর-প্রধানের স্ত্রী কারিগর সম্প্রদায়ের সকলকে জড়ো করে এই স্বপ্নাদেশের কথা বলেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত মহিলারা তাঁদের কাছে যত সোনার গয়না ছিল, সব কারিগরদের কাছে জমা দেন।
কারিগররা সেই গয়না বিক্রি করে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কিনে মুকুট তৈরি করেন এবং তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তৈরি হয়েছিল। কারিগরেরা এই মুকুটের একটি বিশেষ নাম দিয়েছিলেন— ‘কন্নড়ি ভিম্বম’।
রাজা যারপরনাই সন্তুষ্ট হন। কারিগররা ওই বিশেষ সংকর ধাতু দিয়ে শুধুমাত্র দেবতার মুকুটই তৈরি করেননি, তাঁরা রাজাকেও ‘ভাল কন্নড়ি’(একটি হাতলবিশিষ্ট আয়না) উপহার দিয়েছিলেন।
রাজা এর পরই এই আয়নাকে ‘অষ্টমঙ্গলম’ প্রথার অংশ হিসাবে ঘোষণা করেন। বিয়ের কনে প্রবেশ করার সময় একটি পিতলের থালায় আটটি জিনিস রেখে তা দিয়ে কিছু ধর্মীয় প্রথা পালন করা হয়। এই আটটি জিনিসের মধ্যে হাতলবিশিষ্ট আয়নাটিও রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন রাজা।
পরে এই ধাতু দিয়ে বিভিন্ন আকৃতির আয়না তৈরি হত। কিন্তু একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকেরাই এই ধাতু তৈরি করার পদ্ধতি জানতেন। বংশ পরম্পরায় তাঁদের উত্তরাধিকারীদের ওই ধাতু তৈরির বিশেষ পদ্ধতি জানিয়ে যেতেন। ফলে, সেই সম্প্রদায়ের মধ্যেই ধাতু তৈরির এই রহস্য সীমাবদ্ধ থাকত।
কেরলের পম্বা নদীর তীরে অবস্থিত অরনমুলা গ্রামটি এই কারণেই বিখ্যাত। ওই গ্রামের বিশ্বকর্মা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত সকলেই এই বিশেষ ধাতু তৈরিতে সক্ষম। অরনমুলা পার্থসারথি মন্দিরে তাঁরা কর্মরত।
তাঁরা এমন ভাবে আয়নাটি তৈরি করতেন যাতে প্রতিবিম্ব আয়নার সামনের স্তর থেকে আসে, পিছনের স্তর থেকে নয়। বিজ্ঞানের ভাষায় এই ঘটনাটি ‘বিকৃতি’ হিসাবে ধরা হয়। তবে, এই বিশেষ ধাতু দিয়ে তৈরি আয়নার বৈশিষ্ট্য অবিকল কাচের আয়নার মতোই।
প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষকদের মধ্যে সে কারণেই কৌতূহল বাড়তে থাকে। বিশ্বকর্মা সম্প্রদায়ের সকলেই এই বিষয়ে ভীষণ সংরক্ষিত ছিলেন। এই আয়না কোন ধাতু দিয়ে তৈরি, বহু বছর ধরে তা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজের অধ্যাপক শারদ শ্রীনিবাসন।
তিনি জানান, তামা ও টিনকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে মিশিয়ে এই ধাতু তৈরি করা হয়। তবে, এর পিছনে সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব রয়েছে কারিগরদেরই। তাঁরা যে পরিবেশে, যে পদ্ধতিতে এই আয়না বানান, তার কোনও বিকল্প নেই।
খড়ের তৈরি ছাদের তলায় ধাতু তৈরির এই কাজ চালান কারিগরেরা। ওই বিশেষ ঘরেই ওয়ার্কশপ তৈরি করেছেন তাঁরা। উচ্চ তাপমাত্রায় টিন ও তামা নির্দিষ্ট পরিমাণে উচ্চ তাপমাত্রায় একটি ছাঁচ তৈরি করা হয়। তার পর সেই ছাঁচকে আগুনে পোড়ানোর পর ঠান্ডা করা হয়।
পিতলের ফ্রেমের উপর বসিয়ে এই ছাঁচটি ফেলে ইচ্ছেমতো নকশা কাটা হয়। তার পর পালিশ করেন কারিগররা। এই পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ করতে প্রচুর সময় লাগে। যদিও এই আয়না তৈরিতে কোনও বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশিত হয় না। বরং, বেঁচে যাওয়া কাঁচামাল আবার ব্যবহার করা যায়।
কেরলের বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে অথবা গৃহপ্রবেশের সময় এই আয়নাটি উপহার দেওয়া হয়। অনেকের ধারণা, এই আয়না শুভ শক্তির প্রতীক। বাড়িতে এই আয়না রাখলে তা সুখসমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনে।
তিন ইঞ্চি আকারের আয়নার দাম ৫০ আমেরিকান ডলার। ভারতীয় মুদ্রা অনুযায়ী যার মূল্য চার হাজার টাকার কাছাকাছি। এর সর্বোচ্চ মূল্য এক লক্ষ টাকা।
যদিও গত ১৫ বছরে এর উৎপাদন অনেকটাই কমে এসেছে। ২০১৮ সালে কেরলে বন্যা হওয়ার কারণে তাঁদের ওয়ার্কশপের জন্য তৈরি বিশেষ ঘরগুলি নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি, ধানের জমি ভেসে যাওয়ার কারণেও তাঁদের ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ধানের জমি থেকে সংগ্রহ করা কাদা এই ধাতু উৎপাদনে ব্যবহার করতেন কারিগররা।
সংবাদমাধ্যমের নজর এই শিল্পের উপর পড়লে কারিগরদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন অনেকেই। তবে, এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাজারে এই নামের প্রচুর নকল আয়নাও বিক্রি হয়েছে। খালি চোখে দেখলে কোনও পার্থক্যও ধরা পড়বে না।
শুধুমাত্র টিনের পাত দিয়ে এই নকল আয়না তৈরি করা হয়। এর বিশুদ্ধতা বোঝার উপায় একটাই। তবে তা খানিকটা অদ্ভুতও বটে। এই আয়না বিশুদ্ধ পদ্ধতিতে বানানো হলে তা সাধারণ কাচের আয়নার মতোই ভেঙে যাবে। কিন্তু হাজার চেষ্টা করলেও নকল আয়নাটি ভাঙবে না।