এত দিন যা একচেটিয়া ছিল ছেলেদের, এ বার সেটাই কেড়ে নিল মেয়েরা। রাইফেল হাতে শত্রু ব্যূহে ঢুকল মহিলা বাহিনী। ‘টার্গেট প্র্যাক্টিস’-এর ধাঁচে এক এক করে জঙ্গি নিকেশ করলেন দুঃসাহসিক লাস্যময়ীরা। তার পর চুপচাপ ফিরে গেলেন নিজেদের সেনাছাউনিতে।
না, কোনও হলিউড বা বলিউডের কোনও সিনেমার দৃশ্য নয়। বাস্তবে এই ঘটনাই ঘটিয়েছে ইজ়রায়েলি সেনাবাহিনীর প্রমীলা কম্যান্ডো বাহিনী। লেবাননে ঢুকে ‘হিজ়বুল্লা’র গোপন আস্তানায় হানা দেয় তারা। ইহুদি সুন্দরীদের সেই অতর্কিত হামলা সহ্য করতে পারেনি ইরান মদতপুষ্ট এই সশস্ত্র সংগঠন।
পশ্চিম এশিয়ায় জন্মলগ্ন থেকে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে যুদ্ধ করছে ইজ়রায়েল। কিন্তু, কোনও দিনই প্রমীলা বাহিনীকে এ ভাবে রণাঙ্গনে নামাননি ইহুদি জেনারেলরা। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, এ বার সেই প্রথা ভেঙেছেন মেজর জেনারেল ওরি গোর্ডিন। সুন্দরী সৈনিকদের উপর ভরসা করে তিনি যে কোনও ভুল করেননি, ফলাফল থেকেই তা স্পষ্ট।
চলতি বছরের অক্টোবর থেকে প্রতিবেশী দেশ লেবাননে ‘গ্রাউন্ড অপারেশন’ শুরু করেছে ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ। হিজ়বুল্লাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়াই যার মূল উদ্দেশ্য। সেই কাজে প্রমীলা বাহিনীকে কাজে লাগিয়েছেন মেজর জেনারেল গর্ডিন। তাদের সফল অপারেশনের ভিডিয়োও প্রকাশ করেছে ইহুদি সেনা।
ইজ়রায়েলি সংবাদ সংস্থা ‘দ্য টাইমস্ অফ ইজ়রায়েল’ এবং ‘দ্য জ়েরুজ়ালেম পোস্ট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইহুদি সুন্দরীদের ‘কমব্যাট ইনটেলিজেন্স ব্যাটালিয়ন’-এর একটি দলকে দক্ষিণ লেবাননে পাঠান মেজর জেনারেল গর্ডিন। শত্রুব্যূহে ঢুকে তাঁদের গতিবিধি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহই ছিল এই প্রমীলা বাহিনীর প্রাথমিক কাজ।
সেই তথ্য সংগ্রহের পর তা আইডিএফের সদর দফতরে পাঠায় প্রমীলা বাহিনী। এর পর হিজ়বুল্লার বেশ কয়েকটি গুপ্ত আস্তানায় হামলা চালায় তারা। বাকি জায়গাগুলিকে নিশানা করে ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স। গোটা অপারেশন শেষ হলে নিরাপদে ছাউনিতে ফিরে আসেন সকলেই।
সূত্রের খবর, দক্ষিণ লেবাননের অপারেশনে সাফল্যের পর তরুণী সৈনিকদের সিরিয়া সীমান্ত এবং মাউন্ট ডোভা এলাকায় মোতায়েন করেছে আইডিএফ। সিরিয়ার রণাঙ্গনে তাঁদের ব্যবহার করা হবে কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে এই নিয়ে সরকারি ভাবে কোনও বিবৃতি দেয়নি তেল আভিভ।
‘অপারশেন দক্ষিণ লেবানন’-এর অভিজ্ঞতা নিয়ে মুখ খুলেছেন ২১ বছরের তরুণী তেহিলা। ‘দ্য জ়েরুজ়ালেম পোস্ট’-কে তিনি বলেন, ‘‘আমরা হেঁটে জঙ্গিদের এলাকায় ঢুকে তাদের চিহ্নিত করেছি। সেটা একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার ছিল। এটা কোনও গুপ্তচরবৃত্তি নয়। দলের সবাই হাতিয়ার নিয়ে গিয়েছিলাম।’’
আইডিএফের ‘আইট’ ব্যাটালিয়নে কর্পোরাল পদে রয়েছেন তেহিলা। তাঁর সঙ্গে অভিজ্ঞতার কথা শোনান বছর কুড়ির শেনি। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা লেবাননের ভিতরে দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত ঢুকে যাই। আমাদের সৈনিকেরা যে এলাকাগুলির এখনও খোঁজ পাননি, সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমাদের।’’ তেহিলার মতো শেনিও কর্পোরাল পদে রয়েছেন।
ইহুদি ফৌজ সূত্রে খবর, হিজ়বুল্লার ট্যাঙ্ক ধ্বংসকারী ক্ষেপণাস্ত্র লুকিয়ে রাখার জায়গা এবং তাদের একাধিক গুপ্ত আস্তানার সঠিক ঠিকানার হদিস পেয়েছে তাদের প্রমীলা বাহিনী। সেই মতো এক এক করে এ বার সেখানে আক্রমণ শানানো হচ্ছে। স্কুল-হাসপাতালের পাশাপাশি বহু সাধারণ লেবানিজের বাড়িতে হিজ়বুল্লার যোদ্ধারা ঘাঁটি গেড়ে রয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
কর্পোরাল শেনি বলেছেন, ‘‘আমরা ট্যাঙ্ক থেকে নির্গত আগুনের ছবি তুলেছিলাম। এর পর যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়েই সেগুলিকে বিশ্লেষণ করি। তখনই শত্রুদের গতিবিধি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায়।’’ শহর ছেড়ে বর্তমানে হিজ়বুল্লার যোদ্ধারা লেবাননের গ্রামগুলিতে ঘাঁটি তৈরি করছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
নারী বাহিনীর সংগ্রহ করা এই তথ্য হাতে আসতেই সক্রিয় হয় আইডিএফ। হিজ়বুল্লার নতুন আস্তানাগুলিকে গুঁড়িয়ে দিতে ‘স্ট্রাইক’ কপ্টার নিয়ে আক্রমণ নামে ইহুদি ফৌজ। যদিও সেই হামলার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি।
আইডিএফের জারি করা ভিডিয়োয় প্রমীলা বাহিনীকে সাঁজোয়া গাড়িতে দক্ষিণ লেবাননে ঢুকতে দেখা গিয়েছে। এর পর সামরিক সরঞ্জামের ব্যাগ কাঁধে, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে একটি বাড়িতেও ঢুকতে দেখা গিয়েছে তাদের। পাশাপাশি, জঙ্গলের রাস্তাতেও মোতায়েন ছিলেন তরুণী যোদ্ধারা।
এ বছরের ১ অক্টোবর ইহুদি ভূমিতে প্রায় ২০০টি ‘হাইপারসনিক’ ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায় ইরান। তেহরানের ‘রেভোলিউশনারি গার্ডস অ্যারোস্পেস ফোর্স’ ওই ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল। এর ২৫ দিনের মাথায় প্রতিশোধ নেয় ইজ়রায়েল।
গত ২৬ অক্টোবর শিয়া মুলুকটির উপর শতাধিক যুদ্ধবিমানের সাহায্যে হামলা চালায় আইডিএফ বায়ুসেনা। মোট তিনটি পর্যায়ে ইরানের ‘ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কোর’-কে (আইআরজিসি) নিশানা করেন তাঁরা। পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই অভিযানে অংশ নেন মহিলা ইহুদি যোদ্ধা পাইলটেরা।
যুদ্ধবিমানের ককপিটে বসে থাকা সেই মহিলা পাইলটদের ছবি সম্প্রতি প্রকাশ্যে এনেছে ইহুদি ফৌজ। যদিও তার থেকে লেবাননের অভিযান অনেক বেশি কঠিন ছিল বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। কারণ, এখানে শত্রুব্যূহে ঢুকে তরুণী সৈনিকদের নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
ইজ়রায়েলের আইন অনুযায়ী দেশের প্রতিটি নাগরিককে সেনা প্রশিক্ষণ নিতে হয়। সেনাবাহিনীতে চাকরিও এখানে বাধ্যতামূলক। যদিও এত দিন মহিলা ফৌজিদের রিজার্ভে রাখার প্রথা ছিল ইহুদি সেনায়। সেখান থেকে অনেকটা এগিয়ে রণাঙ্গনে নিজেদের ক্ষমতা দেখালেন তাঁরা।