বয়স পেরিয়েছে আশি। এ বয়সে এসে অধিকাংশরাই যখন নিশ্চিন্ত ঘুমে দিন কাটান, তখন ইচ্ছা হলেও সে উপায় নেই ভিয়েতনামের এক বৃদ্ধের। ঘুমই যে উড়ে গিয়েছে তাঁর! এক-আধ দিন নয়, গত পাঁচ দশক ধরে তিনি নাকি কখনও ঘুমোননি।
না! কোনও জাগতিক দুশ্চিন্তায় নয়। পাঁচ দশকে দিনে বা রাতে কোনও সময়ই নাকি চোখের পাতা এক করতে পারেননি ৮১ বছরের তাই নিয়প।
শান্তির ঘুম উড়ে যাওয়ায় রাতের বেলাও ক্ষেতে গিয়ে হয় চাষবাস করেন, না হলে আকাশপানে চেয়ে বসে থাকেন। মর্জি হলে কখনও বা নিজের বাগানের পরিচর্যায় লেগে পড়েন নিয়প।
বছরের পর বছর ধরে ঘুমে চোখ জড়িয়ে না এলেও দিব্যি সুস্থসবল তিনি। ব্যামো বাসা বাঁধা তো দূরের কথা, পাড়াপড়শিদের অনেকের থেকেই নাকি বেশ সক্ষম এই ছিপছিপে বৃদ্ধ।
নিয়পের নিদ্রাহীনতার কারণ কী? সে কারণ জানতে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছেন দেশ-বিদেশের চিকিৎসকেরা। তবে তাঁর নিদ্রাহীনতার ‘রহস্যভেদ’ করতে পারেননি।
১৮,৬৬৫ দিনের বেশি ঘুমোননি এক অশীতিপর! এ কখনও হতে পারে? নিয়প যাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেন, সে জন্য তাঁকে ঘুমপাড়ানি গান শোনানো হয়েছে। লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে অন্য কোথাও তিনি ঘুমিয়ে কাটান কি না, তার সন্ধানে নজরদারিও করা হয়েছে। তবে পরিবার থেকে পাড়াপড়শি সকলেরই দাবি, নিয়প কখনও ঘুমোন না!
ভিয়েতনামের কুয়াং নাম প্রদেশের এই বাসিন্দাকে নিয়ে তোলপাড় হয়েছে সমাজমাধ্যম। শিরোনাম ছেয়ে ফেলা অশীতিপরকে নিয়ে কৌতূহল বেড়েছে বই কমেনি। ১৯৪২ সালে কুয়ো সন জেলায় তাঁর জন্ম। নিয়প জানিয়েছেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় থেকেই ঘুমের ব্যাঘাত হত তাঁর।
যুদ্ধকালে রাজনৈতিক বা আর্থ-সামাজিক অস্থিরতায় ঘুম উড়ে যাওয়াটা অনেকের মতেই বিরল নয়। ফলে কিশোর বয়সে অনিদ্রা নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না নিয়পের। তবে ১৯৭৩ সালের কোনও এক দিন থেকে নাকি তাঁর দু’চোখ থেকে চিরতরে হারিয়ে যায় ঘুম।
সংবাদমাধ্যমের কাছে নিয়পের দাবি, ৩১ বছর বয়সে তাঁর এক বার প্রবল জ্বর হয়েছিল। জ্বরে অচৈতন্য হয়ে গিয়েছিলেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত আর ঘুমোতে পারেননি।
নিয়পের কথায়, ‘‘সেই জ্বরের পর থেকে ঘুমোনোর ইচ্ছাই হত না। জ্বর সেরে উঠলে চোখের পাতা এক করার চেষ্টা করেছিলাম। সেই থেকে পরের পর রাত জেগে কাটিয়েছি। তবে আজ পর্যন্ত ঘুমের দেখা পাইনি। ৫০ বছর ধরে ঘুমোইনি।’’
নিয়প বলেন, ‘‘গোড়ার দিকে ঘুমোতে না পেলে বেশ অস্বস্তি হত। তবে এখন সব সয়ে গিয়েছে। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতে পারি। শরীরও বেশ সুস্থসবল। আজকাল আর ঘুমের স্বপ্ন দেখি না!’’
রাতে বেশির ভাগ পড়শি যখন ঘুমে ডুবে থাকেন, সে সময় নিয়প কী করেন? তিনি বলেন, ‘‘শোয়ার ঘরে বসে ঘুমন্ত স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকতে খুবই বিরক্ত লাগে।’’ ফলে প্রায় প্রতি রাতেই নাকি তিনি ক্ষেতে চলে যান। পেশায় দিনমজুর নিয়পের চাষের জমিও রয়েছে তাঁর। রাতে কোদাল হাতে সেখানে গিয়ে চাষের কাজ সেরে রাখেন। নিজের বাগানে হরেক গাছগাছালিও পুঁতেছেন।
রাতে নিয়পকে চাষবাস করতে দেখে পাড়াপড়শিদের অনেকেরই নাকি মনে হয়েছে, তাঁর মধ্যে ‘আত্মা’ প্রবেশ করেছে। তবে ধীরে ধীরে তাঁর অনিদ্রার কথা চাউর হতে বিষয়টি তাঁদের কাছেও সহজ হয়ে গিয়েছে।
অনিদ্রার জেরে কার্যত ২৪ ঘণ্টাই নাকি কর্মক্ষম থাকেন নিয়প। নিয়পের এ হেন কাণ্ডের জেরে তাঁর উপর নানা মেডিক্যাল পরীক্ষা চলেছে। তবে নিয়প বলেন, ‘‘প্রতি বার হাসপাতালে গেলে চিকিৎসকেরা জানান, আমার কোনও রোগবালাই নেই। কখনও অসুস্থ হই না। ৫০ বছর ধরে এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমোইনি।’’
শিরোনামে নজর কাড়লেও নিয়পের জীবন বেশ সাদামাটা। চারতলা বাড়ি হলেও ঘরে বিশেষ আসবাবপত্র নেই। শোয়ার ঘরে আসবাব বলতে কয়েকটি প্লাস্টিকের চেয়ার, কাঠের টেবিল আর একটি বিছানা।
কম বয়সে গ্রামেরই একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল নিয়পের। তবে প্রথম সন্তানের জন্মের সময় মৃত্যু হয় স্ত্রীর। বছর ছয়েক পর আবার বিয়ে করেন তিনি। দুই ছেলে এবং তিন মেয়েকে নিয়ে দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গেই ঘরসংসার করছেন।
অনিদ্রা নিত্যসঙ্গী হওয়ার জেরে শিরোনামে উঠে এলেও এই পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট নন নিয়প। তিনি বলেন, ‘‘কী অদ্ভুত রোগ! খুব রাগ হয়। রাতের বেলা আকাশ পরিষ্কার থাকলে প্রায়শই ক্ষেতে গিয়ে কোদাল চালিয়ে বীজ ছড়ানোর কাজ করি। আর পাঁচটা সাধারণ লোকের থেকে দ্বিগুণ কাজ করি। তবে তা-ও জীবন ঠিকঠাক চলছে না।’’
চোখের ঘুম আনতে রাতের পর রাত মদ্যপান করে বা ঘুমের ওষুধ খেয়েও দেখেছেন বলে জানিয়েছেন নিয়প। তাতেই ঘুমে ঢুলে পড়েননি। চিকিৎসকেরা বলেন, অনিদ্রার জেরে স্নায়ুর সমস্যা দেখা দিতে পারে অথবা নিত্যদিনের কাজকর্মে প্রভাব পড়ে। তবে নিয়পের ক্ষেত্রে তা হয়নি।
দিনের পর দিন এ ভাবেই কাটানো নিয়পকে এক বার ভিয়েতনামের দা ন্যাং সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। তবে সেখানে পরীক্ষানিরীক্ষায় তাঁর মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েনি।
নিয়প বলেন, ‘‘কখনই ঘুমোতে পারি না বটে। তবে এখনও সুস্থ রয়েছি।’’ তাঁর দাবি, এ বয়সেও প্রতি দিন ৫০ কেজি ওজন তুলতে পারেন। বাড়ি থেকে ৩ কিলোমিটার হেঁটে ক্ষেতে যান। তাঁকে শুধু বার বার ফাঁকি দেয় ঘুম!