এ যেন ‘স্বার্থপর দৈত্য’র বাগানের বিরাট উঁচু পাঁচিল! দুর্ভেদ্য সেই দেওয়াল টপকে ভিতর ঢোকা তো দূরে থাক, উঁকিঝুঁকি মারার জো পর্যন্ত ছিল না! এ বার সীমান্তে ওই ধাঁচেরই প্রাচীর তোলার পরিকল্পনা করেছে নয়াদিল্লি। ‘কাজ শেষ’ হলে বিমান-কামান-ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন তো বটেই, ‘মাছি’ পর্যন্ত যে গলার সাহস পাবে না, তা বলাই বাহুল্য।
নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরে দেশের আকাশকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলতে ফের এক বার ‘চিরকালীন বন্ধু’ রাশিয়ার শরণাপন্ন হয়েছে ভারত। মস্কোর থেকে দূরপাল্লার (লং রেঞ্জ) ‘ভোরোনেজ়’ রাডার ব্যবস্থা পেতে চূড়ান্ত পর্যায়ের কথাবার্তা চালাচ্ছে নয়াদিল্লি। শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত মিললে ৪০০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তিতে সই করবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার।
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ হোক বা পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েল-হামাস-হিজ়বুল্লা-ইরানের সংঘাত। আধুনিক লড়াইয়ে ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) যে কতটা জরুরি, তা এই সমস্ত রণাঙ্গনের দিকে তাকিয়ে হাড়ে হাড়ে বুঝেছে ভারতীয় সেনা। সেই জায়গা থেকেই রুশ ফৌজের অতি শক্তিশালী দূরপাল্লার ‘ভোরোনেজ়’ রাডার ব্যবস্থাকে পাখির চোখ করেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
চলতি বছরের ১০ ডিসেম্বর তিন দিনের রুশ সফরে যান প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। মস্কোয় প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। দু’জনের মধ্যে লম্বা সময় ধরে চলে বৈঠক। তার পরই ‘ভোরোনেজ়’ রাডার ব্যবস্থা কেনার ব্যাপারে নয়াদিল্লির আগ্রহের কথা প্রকাশ্যে আসে। এ ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে বলেও সূত্র মারফত মিলেছে খবর।
দূরপাল্লার এই রাডার ব্যবস্থার নির্মাণকারী সংস্থা হল ‘আলমাজ়-অ্যান্টে কর্পোরেশন’। ভোরোনেজ় সিরিজের একাধিক রাডার দীর্ঘ দিন ধরেই ব্যবহার করে আসছে পুতিন ফৌজ। এর নজর এড়িয়ে আকাশপথে আক্রমণ শানানো যে একরকম অসম্ভব, তা একবাক্যে মানেন দুনিয়ার দুঁদে জেনারেলরা।
রুশ সংবাদ সংস্থাগুলির দাবি, ‘ভোরোনেজ়’ রাডারের পাল্লা আনুমানিক আট হাজার কিলোমিটার। একসঙ্গে ৫০০-র বেশি বস্তুকে শনাক্ত করতে পারে অত্যাধুনিক এই রাডার। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হল ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘স্টেলথ’ যুদ্ধবিমানের চিহ্নিতকরণ। বিশ্বের অধিকাংশ রাডারই এই কাজ করতে ব্যর্থ।
২০১২ সাল থেকে ‘ভোরোনেজ়’ রাডার ব্যবস্থা ব্যবহার করা শুরু করে রুশ সেনা। ওই বছর থেকে ধীরে ধীরে সোভিয়েত আমলের সমস্ত রাডার বাতিল করে মস্কো। এই রাডার ব্যবস্থার কোন সংস্করণের জন্য ভারত আগ্রহ প্রকাশ করেছে, তা অবশ্য এখনও জানা যায়নি।
এই রাডার ব্যবস্থার ক্ষমতা নিয়ে মুখ খুলেছেন রুশ সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘স্পুটনিক ইন্ডিয়া’র সামরিক-রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান আলেকজ়ান্ডার মিখাইলভ। তাঁর কথায়, বর্তমানে এটিকে নতুন উপাদানের সঙ্গে আরও উন্নত করা হচ্ছে। আগামী দিনে মিটার থেকে সেন্টিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিভিন্ন কম্পাঙ্কের ব্যান্ড জুড়ে এটি কাজ করতে পারবে।
মিখাইলভ দাবি করেছেন, ভূপৃষ্ঠের কিছুটা উপরে তো বটেই, পৃথিবীর নিকটবর্তী মহাশূন্যের পরিবেশের উপর নজর রাখতে সক্ষম এই ‘ভোরোনেজ়’ রাডার। ফলে সেখান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে এটি তা চিহ্নিত করতে পারবে। অতি ক্ষুদ্র ড্রোনের উপরে নজরদারিতেও এর জুড়ি মেলা ভার।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে চলা ইউক্রেনে সঙ্গে যুদ্ধে সীমান্তবর্তী অন্তত ১০ জায়গায় এই রাডার মোতায়েন করেছে রুশ সেনা। ‘ভোরোনেজ়’-এর চোখ দিয়েই শত্রু যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোনের উপর নজর রাখছেন তাঁরা। এই রাডারের সাহায্যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করতে সক্ষম হয়েছে মস্কো।
ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা ‘দ্য সানডে গার্ডিয়ান’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের নভেম্বরে ভারতে আসেন ভোরোনেজ় রাডার ব্যবস্থার নির্মাণকারী রুশ সংস্থার ডেপুটি চেয়ারম্যান ভ্লাদিমির মেদোভনিকভ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সংস্থার পদস্থ কর্তাদের আরও ন’জন। রাডার ব্যবস্থাটি নিয়ে নয়াদিল্লির সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি হলে অফসেট অংশীদারি কারা পাবেন, তা নিয়ে আলোচনা সেরেছেন তাঁরা।
সূত্রের খবর, এই রাডার ব্যবস্থাকেও দেশের মাটিতে নির্মাণের উপর জোর দিচ্ছে কেন্দ্র। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পে গোটা ব্যবস্থাটির ৬০ শতাংশ এ দেশের প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলিকে দিয়ে তৈরি করতে হবে বলে শর্ত রেখেছে কেন্দ্র। আর তাই ‘আলমাজ়-অ্যান্টে কর্পোরেশন’-এর পদস্থ কর্তারা দিল্লি ও বেঙ্গালুরুর বিভিন্ন এলাকায় সফর করেছেন বলে জানা গিয়েছে।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের কথায়, ভোরোনেজ় রাডার ব্যবস্থা ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও বেশি শক্তিশালী করবে। চিন ও পাকিস্তানের পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরীয় এলাকা থেকে আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষেত্রে এটিকে ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির। যুদ্ধের সময়ে এই দিক থেকেও ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান হামলা হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
‘স্পুটনিক ইন্ডিয়া’ জানিয়েছে, আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাপক উৎক্ষেপণের মতো হুমকির উপস্থিতি যাচাই করতে ‘ভোরোনেজ়’ সিদ্ধহস্ত। এ ব্যাপারে দ্রুত তথ্য সরবরাহ করতে পারবে এই রাডার। ফলে শত্রুর পরিকল্পনা বানচাল করতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না এ দেশের সেনাকর্তাদের।
রুশ গুপ্তচর কৃত্রিম উপগ্রহর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করে ‘ভোরোনেজ়’। ফলে এটি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ভারতেও সেই ধরনের উপগ্রহ অন্তরীক্ষে পাঠাতে হবে। অর্থাৎ, মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’র বড় ভূমিকা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও এ ব্যাপারে সরকারি স্তরে কোনও তথ্য প্রকাশ্যে আসেনি।
এ দেশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করার ব্যাপারে স্পুটনিকের কাছে মুখ খুলেছেন ভারতীয় বায়ুসেনার অবসরপ্রাপ্ত উপপ্রধান এয়ার মার্শাল অনিল খোসলা। ক্রমবর্ধমান ক্ষেপণাস্ত্র হুমকির মধ্যে কৌশলগত স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এই ধরনের রাডারের অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন তিনি।
সাবেক এয়ার মার্শাল অনিল খোসলা বলেছেন, ‘‘দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণ, শত্রুসেনার হাতে লম্বা দূরত্বের ক্ষেপণাস্ত্র থাকা। কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ শহর বা এলাকাকে নিশানা করে সেগুলি মোতায়েনও করছে তারা। কোনও সন্দেহ নেই, এই অবস্থায় ভোরোনেজ়ের মতো রাডার হাতে পেলে আমাদের সেনার শক্তি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে।’’
সবচেয়ে বড় কথা হল, মহাকাশ নজরদারিতেও এই রাডার ব্যবহার করতে পারবে ভারত। অর্থাৎ, সামরিক এবং অসামরিক দু’টি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে ‘ভোরোনেজ়’। সেনার পাশাপাশি এতে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’ উপকৃত হবে বলেও মনে করা হচ্ছে।