Abu Mohammad al-Julani

লাদেনের সঙ্গে পদে পদে মিল, কাজ ফুরিয়ে গেলে সিরিয়ার বিদ্রোহী নেতার ‘মাথা কাটবে’ আমেরিকা?

বাশার অল-আসাদ সরকারের পতন ঘটানো বিদ্রোহীদের নেতা আবু মহম্মদ আল-জুলানির সঙ্গে কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন আল কায়দার প্রধান ওসামা বিন লাদেনের আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে। ফলে তাঁর পরিণতিও লাদেনের মতো হতে পারে বলে জল্পনা তুঙ্গে উঠেছে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:০০
Share:
০১ ২০

বাংলায় নামের বর্ণ সংখ্যা থেকে শুরু করে জন্মস্থান। ঝটিতি অপারেশনে শত্রুকে নাস্তানাবুদ করে ফেলা। কিংবা মেঘনাদের মতো আড়ালে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা। দু’জনের মধ্যে রয়েছে পরতে পরতে মিল। পার্থক্য শুধু একটা জায়গায়। ‘পরম বন্ধু’র স্বীকৃতি পাওয়া প্রথম জনকে অচিরেই ‘পয়লা নম্বর দুশমন’ ঘোষণা করে আমেরিকা। আর দ্বিতীয় জনের ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। একটা সময়ে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’-এর তালিকায় নাম থাকা তাঁর প্রশংসাতেই এখন পঞ্চমুখ ওয়াশিংটনের তাবড় সংবাদ সংস্থা।

০২ ২০

প্রথম জন কুখ্যাত সন্ত্রাসী সংগঠন আল কায়দার নেতা ওসামা বিন লাদেন। দ্বিতীয় জনের নাম আবু মহম্মদ আল-জুলানি। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিদ্রোহী ‘হায়াত তাহরির আল-শাম’ (এইচটিএস) বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। দামাস্কাসে বাশার অল-আসাদ সরকারের পতনের পর খবরের শিরোনামে এসেছেন জুলানি। আর তখনই চোখে পড়েছে লাদেনের সঙ্গে তাঁর আশ্চর্য মিলের দিকটি। ফলে ‘কাজ মিটে গেলে’ আল কায়দার শীর্ষনেতাটির মতো তাঁরও ভবলীলা যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী সাঙ্গ করতে পারে বলে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।

Advertisement
০৩ ২০

লাদেন এবং জুলানি— বাংলায় দু’জনের নামেই রয়েছে তিনটি করে বর্ণ। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াধে জন্ম তাঁদের। ১৯৫৭ সালের ১০ মার্চ পৃথিবীর আলো দেখেন লাদেন। অন্য দিকে জুলানির জন্ম হয় ১৯৮২ সালে। মা-বাবা অবশ্য তাঁর নাম রাখেন আহমেদ হুসেন আল-সারা। পরবর্তী কালে আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লে নাম বদল করে জুলানি হয়ে যান তিনি।

০৪ ২০

প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে লাদেন এবং জুলানি— দু’জনেরই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান দখল করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। হিন্দুকুশ পাহাড়ের কোলে পুতুল সরকার বসায় মস্কো। তাদের আগ্রাসী মনোভাব দেখে প্রমাদ গনে আমেরিকা। আমুদরিয়ার তীর থেকে রাশিয়াকে তাড়াতে পাল্টা ছক কষা শুরু করে ওয়াশিংটন।

০৫ ২০

আফগানিস্তানকে সোভিয়েত-মুক্ত করতে ‘মুজাহিদিন’ বা ধর্মযোদ্ধা নামের একটি গোষ্ঠী তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ। সেখানেই কাজে লাগানো হয় কট্টরপন্থী বিন লাদেনকে। তাঁর প্রাথমিক কাজ ছিল পাক গুপ্তচর বাহিনী আইএসআইয়ের সাহায্যে মুজাহিদদের হাতে হাতিয়ার ও যুদ্ধের অন্যান্য সরঞ্জাম পৌঁছে দেওয়া। ১৯৭৯ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে ১,২০০ কোটি ডলারের অস্ত্রশস্ত্র আফগান-ভূমিতে পাঠিয়েছিল আমেরিকা। এর বেশির ভাগটাই গিয়েছিল বিন লাদেনের হাত ঘুরে।

০৬ ২০

একই কথা খাটে জুলানির ক্ষেত্রেও। সিরিয়ার আসাদ সরকারকে প্রথম দিন থেকে সমর্থন করে এসেছে রাশিয়া। বিনিময়ে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি এলাকা সেনাছাউনি তৈরির জন্য মস্কোকে ছেড়ে দেন তিনি। ফলে পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ায় রুশ প্রভাব বাড়ছিল। এতেই প্রমাদ গনে আমেরিকা।

০৭ ২০

যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর বাহিনী সিরিয়াতেও একরকম ‘আফগানিস্তান মডেল’ অনুসরণ করেছে বলা যেতে পারে। ২০১১ সাল থেকে পর্দার আড়ালে থেকে সিরিয়ার বিদ্রোহে মদত জুগিয়ে গিয়েছে আমেরিকা। আসাদ সরকারকে বারে বারে স্বৈরাচারী তকমা দিয়ে দুনিয়া জুড়ে প্রচার চালিয়েছে সিআইএ। পাকিস্তানের মতোই সিরিয়ার ক্ষেত্রে বিদ্রোহীদের হাতে হাতিয়ার ও গোলা-বারুদ তুলে দিতে তুরস্ককে ব্যবহার করতে দ্বিতীয় বারের জন্য ভাবেনি আমেরিকা।

০৮ ২০

অর্থাৎ, লাদেনের মতোই যুক্তরাষ্ট্রের মদতে সিরিয়ায় শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে জুলানির। তাঁর হাতে গড়া বিদ্রোহী সেনা দখল করেছে রাজধানী দামাস্কাস। ফলে আগামী দিনে ভুমধ্যসাগরের তীরের রুশ সেনাছাউনি পশ্চিম এশিয়ার দেশটিতে আর থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। এককথায় জুলানির জন্যেই সিরিয়ায় স্বার্থরক্ষা হয়েছে আমেরিকার। ফলে তাঁর পরিণতিও লাদেনের মতো হতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকের।

০৯ ২০

১৯৮৮ সালে আল কায়দা নামের জঙ্গি গোষ্ঠী তৈরি করেন লাদেন। এই সংগঠনের সঙ্গেও একটা সময়ে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিলেন জুলানি। ২০০৩ সালে আল কায়দায় যোগ দেন তিনি। ওই সময়ে পশ্চিম এশিয়ায় সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান চালাচ্ছিল আমেরিকা। ২০১১ সালে আল কায়দার অধীনে নতুন ‘জাভাত আল-নুসরা’ গঠন করেন জুলানি। পরবর্তী কালে এরই নাম হয় এইচটিএস।

১০ ২০

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিমান ছিনতাই করে নিউ ইয়র্কের ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার’-এ আত্মঘাতী হামলা চালায় আল কায়দার ১৯ জন জঙ্গি। তদন্তে এই ঘটনার মাস্টারমাইন্ড হিসাবে বিন লাদেনের নাম উঠে আসে। ফলে তাঁকে নিকেশ করতে উঠেপড়ে লাগে ওয়াশিংটন। যদিও ওই ঘটনার এক দশক পর্যন্ত লাদেনের টিকি পর্যন্ত ছুঁতে পারেননি আমেরিকার গোয়েন্দারা।

১১ ২০

শেষে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে আল কায়দার এই শীর্ষনেতার হদিস পান যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচরেরা। সঙ্গে সঙ্গে ‘নেভি সিল’ যোদ্ধাদের পাঠিয়ে তাঁকে নিকেশ করে ওয়াশিংটন। অপারেশন লাদেনের কোড নাম ছিল ‘নেপচুন স্ফিয়ার’। তারিখ ছিল ২০১১ সালের ২ মে।

১২ ২০

জুলানির পরিণতি লাদেনের মতো হওয়ার আশঙ্কার নেপথ্যে দ্বিতীয় যুক্তি হল আর এক কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন ‘ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া’ বা আইএসআইএসের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। আল কায়দায় থাকাকালীনই এই সন্ত্রাসীদের প্রধান আবু বকর আল বাগদাদির সঙ্গে কাজ করেন তিনি। ২০২২ সালে সিরিয়ায় আমেরিকার ড্রোন হামলায় নিহত হন বাগদাদি।

১৩ ২০

আমেরিকার সংবাদমাধ্যমগুলিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জুলানি অবশ্য দাবি করেন, ২০১৩ সালেই বাগদাদির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকে গিয়েছে তাঁর। বাগদাদি নাকি নুসরা ফ্রন্টের প্রধান হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। সে ক্ষেত্রে ওই বাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতেন জুলানি। ফলে বাগদাদির ‘দাদাগিরি’ সহ্য করেননি তিনি। আইএসআইএস প্রধানের বিরোধিতাও করতে ছাড়েননি জুলানি।

১৪ ২০

২০১৮ সালে এই জুলানির মাথার দাম এক কোটি ডলার ধার্য করেছিল আমেরিকা। ভারতীয় মুদ্রায় সেই সময়ে অঙ্কটা ছিল প্রায় ৭৪ কোটি টাকা। জুলানির এইচটিএসকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন’ বলে ঘোষণা করে ওয়াশিংটন। বাগদাদির মৃত্যুর পরে ইসলামিক স্টেট ভেঙে পড়লে সিরিয়ায় এই বিদ্রোহী নেতার প্রভাব বাড়তে শুরু করে। সেখানকার ইদলিব প্রদেশে নিজের আধিপত্য কায়েম করেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বেই সেখানে তৈরি হয় সরকার।

১৫ ২০

তবে ওয়াশিংটন তাঁকে বিদেশি সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করার পর থেকেই গোপন ডেরায় চলে যান জুলানি। গত আট বছরে এক বারের জন্যেও তাঁকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। এইচটিএস দামাস্কাস দখলের পর বিবৃতি দিয়েছেন তিনি। বিদ্রোহীদের এই জয়কে সিরিয়ার ‘স্বাধীনতা’ বলে উল্লেখ করেছেন জুলানি। পাশাপাশি নিরীহদের খুন করাকে তিনি সমর্থন করেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন।

১৬ ২০

প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য তার পরও জুলানির ভাগ্য নিয়ে সন্দিহান। তাঁদের কথায়, সরকার বদল বা গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে নিজের কাজ হাসিল করার পর অনেককেই আর বাঁচিয়ে রাখেনি আমেরিকা। ফলে দামাস্কাসের আসাদ সরকারের পতনে এইচটিএসের প্রতি তাঁদের মনোভাব যে খুব একটা বদলাবে, এমন চিন্তাভাবনা একেবারই অবান্তর।

১৭ ২০

মজার বিষয় হল, আসাদ সরকারের পতনের পরই সিরিয়ার আইএসআইএসের ৭৫টি গুপ্ত ঘাঁটিতে বিমানহানা চালিয়েছে আমেরিকার বায়ুসেনা। পরে এই নিয়ে বিবৃতি দেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেন, ‘‘বাশার দেশ ছেড়ে চম্পট দেওয়ায় সিরিয়ায় রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। আইএসআইএসের জঙ্গিরা এর সুযোগ নিতেই পারে। আর তাই নিরাপত্তার স্বার্থে সেখানে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে।’’ এই একই যুক্তিতে আগামী দিনে জুলানিকেও যুক্তরাষ্ট্র নিশানা করতে পারে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।

১৮ ২০

আমেরিকাকে বাদ দিলে জুলানির দ্বিতীয় বিপদের নাম ইজ়রায়েল। সিরিয়ার সরকার পতন হতে না হতেই গোলান মালভূমি-সহ দেশটির বেশ কিছু জমি কব্জা করেছে ইহুদি ফৌজ। ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আড়াইশোর বেশি বিমান হামলা চালিয়েছে ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা। হাতিয়ারের গুদাম থেকে শুরু করে বিমানবন্দর বা তেলের ডিপো— তাঁদের নিশানা থেকে কিছুই বাদ যায়নি।

১৯ ২০

বিশ্লেষকদের দাবি, পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিতে চাইছেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। এই অবস্থায় তাঁর রাস্তায় বাধা হয়ে দাঁড়ালে জুলানিকে দুনিয়া থেকে সরাতে গুপ্তচর সংস্থা মোসাদকে কাজে লাগাতে পারেন তিনি। একটা সময়ে গোলান মালভূমি এলাকাতেই থাকতেন জুলানির বাবা হুসেন আল সারা। পরে সৌদি চলে যান তিনি। ফলে গোলান মালভূমির দখলকে কেন্দ্র করে ইহুদিদের সঙ্গে তাঁর বিবাদে জড়ানো মোটেই আশ্চর্যের নয়।

২০ ২০

সব শেষে অবশ্যই বলতে হবে রাশিয়ার কথা। সিরিয়ার বাশার সরকারের পতন যে মস্কো ভাল চোখে দেখছে না, তা একরকম স্পষ্ট। এর জন্য জুলানি যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নজরে রয়েছেন, তা বলাই বাহুল্য। শেষ পর্যন্ত মৃত্যু তাঁর সঙ্গে লুকোচুরি খেলে, না কি তিনি দেশ শাসনের গুরুদায়িত্ব পান, সেটাই এখন দেখার।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement