লেখাপড়ার সূত্রে বিদেশে যান অনেকে। কেউ যান ঘুরতে। আবার অনেকে বিদেশে যান কাজের সন্ধানে। বছরের পর বছর কর্মসূত্রে বিদেশেই পড়ে থাকেন তাঁরা। বিদেশি মুদ্রায় উপার্জন করেন।
ভারত থেকে কর্মসূত্রে যাঁরা বিদেশে যান এবং সেখানে অস্থায়ী ভাবে থাকতে শুরু করেন, তাঁরাই পরিযায়ী শ্রমিক। তাঁদের হাত ধরে দেশে আসে বিদেশি মুদ্রা। উন্নত হয় দেশের অর্থনীতি।
যে সমস্ত ভারতীয় কর্মসূত্রে বিদেশে গিয়েছেন এবং বছরের পর বছর ধরে ভারতের নাগরিক হিসাবেই বিদেশ থেকে অর্থ উপার্জন করছেন, দেশে তাঁদের প্রেরিত অর্থকে বলা হয় ‘রেমিট্যান্স’। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়।
ভারতে আত্মীয়স্বজন, নিকটজনদের জন্য বিদেশ থেকে টাকা পাঠিয়ে থাকেন সেখানে কর্মরতেরা। নিজেরা দেশে ফিরলেও তাঁদের সঙ্গে আসে বিদেশ থেকে অর্জিত অর্থ। ভরে ওঠে দেশের ভান্ডার।
রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েক বছরে বিদেশ থেকে দেশীয় নাগরিকদের মাধ্যমে অর্জিত অর্থের নিরিখে অন্য অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভারত। এমনকি, ২০২২ সালে সেই তালিকায় ভারতই শীর্ষে। অর্থাৎ, ওই বছর বিদেশ থেকে ভারতীয় নাগরিকদের মাধ্যমে দেশের ভান্ডারে যত টাকা এসেছে, তা অন্য কোনও দেশের ভান্ডারে যায়নি।
রাষ্ট্রপুঞ্জের ২০২২ সালের বিশ্ব মাইগ্রেশন রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘রেমিট্যান্স’ প্রাপকের তালিকায় ওই বছর শীর্ষে ভারত। তার ঠিক পরেই রয়েছে মেক্সিকো, চিন, ফিলিপিন্স এবং ফ্রান্স।
রিপোর্ট বলছে, বিদেশে কর্মরত ভারতীয়েরা ২০২২ সালে দেশে যে অর্থ পাঠিয়েছেন, তার পরিমাণ ১১ হাজার ১০০ কোটি ডলার। যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।
‘রেমিট্যান্স’-এর অঙ্ক ১০ হাজার কোটির গণ্ডি প্রথম ছুঁয়েছে ভারতই। বিশ্বের আর কোনও দেশ এখনও পর্যন্ত এই পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। গত ১২ বছরে বিদেশে কর্মরত ভারতীয়দের থেকে পাওয়া ‘রেমিট্যান্সের’ পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
বিদেশি অর্থ ‘রেমিট্যান্স’ প্রাপ্যের নিরিখে এর পরেই রয়েছে মেক্সিকো। তারা ওই বছর বিদেশে কর্মরত নাগরিকদের থেকে ‘রেমিট্যান্স’ পেয়েছে ৬ হাজার ১১০ কোটি ডলার।
তালিকায় তৃতীয় দেশ হিসাবে রয়েছে চিন। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে চিনের প্রাপ্য ‘রেমিট্যান্স’-এর পরিমাণ ৫ হাজার ১০০ কোটি ডলার। চার নম্বরে রয়েছে তাদেরই পড়শি দেশ ফিলিপিন্স।
ফিলিপিন্স ২০২২ সালে ‘রেমিট্যান্স’ বাবদ সংগ্রহ করেছে ৩ হাজার ৮০৫ কোটি ডলার। এ ছাড়া, ফ্রান্স ৩ হাজার ৪ কোটি ডলার ‘রেমিট্যান্স’ নিয়ে ওই তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে।
ভারত শীর্ষে থাকলেও তার দুই পড়শি বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান ‘রেমিট্যান্স’-এর তালিকায় খানিকটা পিছনে। ৩ হাজার কোটি ডলার ‘রেমিট্যান্স’ নিয়ে পাকিস্তান রয়েছে ষষ্ঠ স্থানে। আর অষ্টম স্থানে থাকা বাংলাদেশ ২০২২ সালে ‘রেমিট্যান্স’ পেয়েছে ২ হাজার ১৫০ কোটি ডলার।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ‘রেমিট্যান্স’-এর নিরিখে এগিয়ে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিই। অন্য মহাদেশের কোনও কোনও দেশ এই তালিকায় থাকলেও সংখ্যায় দক্ষিণ এশীয় দেশই বেশি।
দেশ ছেড়ে কাজের খোঁজে কোথায় যান ভারতীয়েরা? দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের পরিযায়ীদের গন্তব্যই বা কোথায়? পরিসংখ্যান বলছে, এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আরব উপসাগরীয় দেশগুলি। আমেরিকা গন্তব্যের তালিকায় তাদেরও পরে।
সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, সৌদি আরব, ওমান, কাতার, কুয়েত, বাহরিনের মতো দেশগুলিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ থেকে বহু মানুষ পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে যান। সেই সঙ্গে এই দেশগুলিতে ভিড় জমে আফ্রিকানদেরও।
শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বেই ‘রেমিট্যান্স’-এর সবচেয়ে বড় ভান্ডার আরবীয় দেশগুলি। ২০২২ সালে সৌদি আরব থেকে ‘রেমিট্যান্স’ হিসাবে অন্যান্য দেশে গিয়েছে ৩ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। এ ছাড়া, ওই বছর কুয়েত এবং কাতার থেকে ‘রেমিট্যান্স’ গিয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ৮০০ কোটি এবং ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার।
যে কোনও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এই ‘রেমিট্যান্স’। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির উন্নতি হয়। তবে প্রদীপের তলার অন্ধকারের মতো ‘রেমিট্যান্স’-এরও কালো দিক রয়েছে।
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং কাঠামোর দিকে ইঙ্গিত করে ‘রেমিট্যান্স’। কারণ ‘রেমিট্যান্স’ আসে বিদেশে কর্মরত পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছ থেকে। সেই শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি হলে ‘রেমিট্যান্স’-এর পরিমাণও বেড়ে যায়।
কোনও দেশে বিদেশে কর্মরত নাগরিকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার একটি অর্থ হল, সে দেশের কর্মসংস্থানে ঘাটতি। নিজের দেশে পর্যাপ্ত রোজগারের উপায় খুঁজে না পেয়েই বিদেশে পাড়ি দেন মানুষ। সেই ধরনের দেশ আপাতত দক্ষিণ এশিয়ায় বেশি।
বিদেশে কাজ করতে গিয়ে বিবিধ সমস্যার সম্মুখীনও হতে হয় এই পরিযায়ী শ্রমিকদের। অর্থসঙ্কট থেকে শুরু করে জ়েনোফোবিয়া, তালিকাটি দীর্ঘ। বিদেশে যাওয়ার খরচ জোগাড় করতেই অনেকে গলা পর্যন্ত ঋণে ডুবে যান।
পেটের টানে বিদেশে গিয়ে সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন না অনেকে। তাঁরা জ়েনোফোবিয়ার শিকার হন। বিদেশি লোকজনের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মানসিকতাই হল জ়েনোফোবিয়া। আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলিতে গিয়ে হামেশাই যার সম্মুখীন হতে হয় ভারতীয়দের।