বাবা কী করেন? যখনই প্রশ্নটা শুনতেন, মনে মনে খুব বিরক্ত হতেন প্রাচী। আবার সেই এক প্রশ্ন, এক উত্তর! তাই উত্তর এড়িয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করতেন তিনি।
অনেকে তো গর্ব করে বলে, আমার বাবা বড় অফিসার, আমার বাবা শিক্ষক ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু প্রাচী কেন এড়িয়ে যেতেন? সেই কাহিনিই সকলকে শুনিয়েছেন তিনি।
না, তাঁর বন্ধুরা তাঁদের বাবাকে নিয়ে যতটা গর্ব বোধ করতেন, প্রাচী পারতেন না। বরং লজ্জা হত তাঁর। খুব লজ্জা। কেননা, ওঁর বাবা তো পানের দোকান চালান! আর পাঁচজন বন্ধুর বাবার মতো সরকারি চাকরি করেন না, বড় অফিসে চাকরি করেন না, ভাল বেতনও পান না। তাই সকলের সামনে বাবার পেশা নিয়ে বলতে লজ্জাই হত প্রাচীর।
প্রাচী ঠাকুর। বিহারের একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এক তরুণী। কেন বাবার পেশা নিয়ে লজ্জা পেতেন, সেই কাহিনি সমাজমাধ্যমে শেয়ার করেছেন। আর সেখানে অকপট স্বীকারোক্তিও করেছেন তিনি।
প্রশ্নটা প্রথম এসেছিল স্কুলের বন্ধুদের কাছ থেকে— তোর বাবা পানের দোকান চালায়? বন্ধুরা বাবার পেশা নিয়ে বার বার খোঁচা দিত। ছোট্ট প্রাচী তখন খুব কান্না পেত। প্রাচী বলেন, “এক দিন সকলের সামনে দাদার এক বন্ধু বাবার পেশা নিয়ে বলেছিল। আমার তখন বাবার উপর খুব রাগ হয়েছিল। লজ্জা হচ্ছিল, বাবা এমন একটা পেশায় জড়িত।”
প্রাচী বলেন, “আমিও চাইতাম অন্যদের বাবার মতো আমার বাবাও সেই কাজ করুক। নিজের একটা বড় দোকান বা কোনও অফিসের কর্মী। একটা ভাল সাইকেল থাকবে। এটাও দেখতে চাইতাম।” কিন্তু সেই ইচ্ছাপূরণ হয়নি প্রাচীর।
প্রাচী আরও জানিয়েছেন, তাঁর বাবা ইস্ত্রি করা পোশাক পরুক। এক জন বেতনভুক কর্মী হোক। সেই বেতন পেলে ভাল ভাল বই কেনা যেত। কিন্তু না, কোনওটাই হয়নি।
বিহারের এই তরুণী বলেছেন, “এ সব কোনও কিছু হয়নি বলে খুব রাগ হত। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম, আমার বাবা যেমন ছিল, যেমন আছে, তেমনই থাক। আর এটাই আমার গর্ব।”
বিহারের মতো একটি রাজ্য। যেখানে গ্রামে-গঞ্জে অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। দশম পাশ করলেই যেখানে মেয়েদের বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রাচীর বাবা ঠিক উল্টো পথে হেঁটেছেন।
প্রাচী বলেন, “বিয়ে করার জন্য বাবা আমাকে কোনও দিন চাপ দেয়নি। বরং সব সময় বলেছে, তোকে আরও অনেক পড়তে হবে। অনেক দূর এগোতে হবে।”
যেখানে সন্ধ্যা নামলেই মেয়েদের ঘরের বাইরে পা রাখা নিষিদ্ধ, প্রাচীকে কিন্তু নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পাঠাতেন তাঁর বাবা। সন্ধ্যার অন্ধকার নামলেও কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না। প্রাচী বলেন, “যেখানে ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, মেয়েদের নম্র হতে হয়, নিচু স্বরে কথা বলতে হয়, কিন্তু সেখানে বাবা আমাকে শিখিয়েছে কী ভাবে আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে হয়। কী ভাবে মঞ্চে পারফর্ম করে দর্শকদের মন জয় করতে হয়।”
যে শহরে মেয়েদের শিক্ষার উপরে কোনও আলোকপাত করা হয় না, সেই শহর থেকেই প্রাচীকে হাত ধরে স্নাতকোত্তর করতে সুদূর পুদুচেরীতে পাঠিয়েছিলেন সেই বাবা, যাঁর জন্য প্রাচী লজ্জাবোধ করতেন।
প্রাচী আরও বলেছেন, “যেখানে মেয়েদের ঘরে বসিয়ে রাখা হয়, বাবা আমাকে জিমে পাঠিয়েছিল। অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন, তোমার আত্মবিশ্বাসের রহস্য কী? তাঁদের গর্ব করে বলতাম, আমার বাবাই এই রহস্যের কারণ। বাবাই আমার অনুপ্রেরণা।”
তাঁর কথায়, “এটা ঠিক, একটা সময় বাবার পেশা নিয়ে লজ্জা পেতাম। কিন্তু আজ ওঁর জন্য গর্ববোধ করি। ওঁর মেয়ে হতে পেরে গর্ব হয়। না, বাবা বদলায়নি। একই রকম আছে। তবে পেশাও বদলায়নি। সেই পানের দোকান আছে। পাশাপাশি, তিনি রান্নার গ্যাস সারাইয়ের কাজ করেন।”
পুদুচেরী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন প্রাচী। বর্তমানে ‘ট্যুরিজম এবং হসপিটালিটি’ সেক্টরে কাজ করেন। আর এ সবের নেপথ্যে সেই পানবিক্রেতা বাবা।