মহাত্মা গাঁধী প্রয়াত হওয়ার ১৩ বছর পর প্রথম বার ভারতে এসেছিলেন ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। গাঁধীজির সমাধিস্থলে গিয়ে জাতির জনককে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলেন। তার পরও দু’বার ভারতে এসেছিলেন। বৃহস্পতিবার রানির জীবনাবসানের পর তাঁর ভারত সফরের উজ্জ্বল স্মৃতি এখনও অমলিন।
বাবা ষষ্ঠ জর্জের প্রয়াণের পর ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রিটেনের রানির সিংহাসনে বসেছিলেন এলিজাবেথ। রানি হওয়ার ন’বছরের মাথায় প্রথম বার ১৯৬১ সালে ভারতে এসেছিলেন তিনি।
এলিজাবেথই ছিলেন প্রথম ব্রিটেনের রানি, যিনি স্বাধীন ভারতে এসেছিলেন। এর আগে, ১৯১১ সালে পরাধীন ভারতে পা রেখেছিলেন এলিজাবেথের দাদু পঞ্চম জর্জ ও রানি মেরি।
১৯৬১ সালে রানির ভারত সফরের স্মৃতি আজও অমলিন। সে বার গাঁধীজির সমাধিস্থলে জুতো খুলে প্রবেশ করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ডিউক অব এডিনবরা প্রিন্স ফিলিপ। ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে তাঁরা যে ভাবে সম্মান দিয়েছিলেন, তা নজর কেড়েছিল।
দিল্লি বিমানবন্দর থেকে রাজ-দম্পতিতে স্বাগত জানাতে গিয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও উপরাষ্ট্রপতি সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন।
রানিকে এক ঝলক চোখের দেখা দেখতে রাস্তায় ভিড় জমিয়েছিলেন অগণিত মানুষ। রানির সফর ঘিরে দেশজুড়ে উন্মাদনাও চোখে পড়ার মতো ছিল।
দিল্লির রাজপথে প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে সম্মাননীয় অতিথি হিসাবে হাজির ছিলেন রানি। ভারতে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়ে তিনি যে আপ্লুত, সে কথা বলেছিলেন এলিজাবেথ।
ভারত সফর চলাকালীন উপহার দেওয়া হয়েছিল রানিকে। দু’ফুট লম্বা কুতুব মিনার উপহার হিসাবে রানিকে দিয়েছিল দিল্লি পুরসভা। রুপোর ঝাড়বাতিদান দেওয়া হয়েছিল ডিউককে।
সে বছর ২৭ জানুয়ারি অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেসের (এমস) ভবনের উদ্বোধন করেছিলেন রানি। এমস চত্বরে বৃক্ষরোপণও হয় রানির হাত ধরে।
প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডের আগে রাজস্থানের জয়পুরে গিয়েছিলেন রানি। রানি ও ডিউককে রাজকীয় অভ্যর্থনা দেওয়া হয়েছিল।
জয়পুরের তৎকালীন মহারাজা দ্বিতীয় সওয়াই মন সিংহের সঙ্গে হাতির পিঠে চড়েছিলেন রানি।
প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডের পর আগরায় তাজমহল দর্শনে গিয়েছিলেন রানি। খোলা গাড়িতে চড়ে তাজমহল যাওয়ার সময় হাজার হাজার মানুষের উদ্দেশে হাত নাড়তে দেখা গিয়েছিল রানিকে।
উদয়পুরেও গিয়েছিলেন রাজ-দম্পতি। সেখানে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছিলেন মহারাণা ভগবৎ সিংহ মেওয়ার।
এর পরের গন্তব্য ছিল পাকিস্তানের করাচি। আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকা খাইবার পাসেও গিয়েছিলেন।
পাকিস্তানে এক পক্ষ কাল কাটানোর পর আবারও ভারতে ফেরেন। সে বার দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানায় যান এলিজাবেথ। ব্রিটেনের সহযোগিতাতেই ওই কারখানা নির্মাণ করা হয়েছিল। কারখানার কর্মীদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন রানি।
দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা ঘুরে কলকাতায় পা রেখেছিলেন রানি। জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে কলকাতায় স্বাগত জানানো হয়েছিল এলিজাবেথকে।
কলকাতায় থাকাকালীন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে গিয়েছিলেন এলিজাবেথ। রানিকে সংবর্ধনা দিতে বিশেষ রেসের আয়োজন করেছিল ‘দ্য রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব’। রেসের পুরস্কার মূল্য ছিল ৩০ হাজার টাকা।
কলকাতার পর বেঙ্গালুরু পাড়ি দিয়েছিলেন রানি। সেখানে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিলেন মাইসুরুর মহারাজা ও বেঙ্গালুরুর মেয়র।
বেঙ্গালুরুর পর রাজ-দম্পতি তৎকালীন বম্বে (অধুনা মুম্বই) গিয়েছিলেন। সেখান থেকে যান বারাণসী। বারাণসীতে গঙ্গায় নৌকাবিহারও করেন রানি।
১৯৬১ সালের পর ১৯৮৩ সালে আবারও ভারতে এসেছিলেন রানি। সে বার মাদার টেরেজার সঙ্গে দেখা করেছিলেন তিনি।
১৯৮৩ সালে ভারত সফরের সময়কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গেও দেখা হয়েছিল রানির।
এর পর ১৯৯৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এ দেশে এসেছিলেন রানি।
১৯৯৭ সালে ভারত সফরে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কেআর নারায়ণন ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন রাজ-দম্পতি।
সে বার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরাল ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেছিলেন রানি।
বৃহস্পতিবার এক যুগাবসান ঘটেছে ব্রিটেনে। সাত দশক ধরে ব্রিটেনের সিংহাসনে দ্যুতি ছড়িয়েছেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ। রানির এই দীর্ঘ যাত্রাপথে ভারতে তাঁর তিন বার সফরের স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে রয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায়।