জাতীয় সড়কের কথা বললেই মনে আসে বিস্তীর্ণ চওড়া এক রাস্তার কথা। বড় বড় গাড়ি অবলীলায় যাত্রা করছে যার বুক চিরে। তেমনই একাধিক জাতীয় সড়ক ভারতের এ পার থেকে ও পার গিয়েছে রক্তজালিকার মতো। বস্তুত, জাতীয় সড়কের সেই জালই ভারতের চালিকাশক্তি। কিন্তু জানেন কি, জাতীয় সড়ক নিয়ে রয়েছে সহস্র খুঁটিনাটি?
১৯৮৮ সালে তৈরি হয় ‘ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি অফ ইন্ডিয়া’ (এনএইচএআই)। এই সংস্থার উপরেই দেশের যাবতীয় জাতীয় সড়ক দেখভালের গুরুদায়িত্ব। শুরু থেকেই অত্যন্ত পারদর্শিতার সঙ্গে তা পালন করে আসছে এনএইচএআই। এখানে মনে রাখার মতো ব্যাপার হল, প্রায় প্রতি দিনই কিন্তু দেশের জাতীয় সড়কের বহর বাড়ছে। ফলে প্রতি দিনই বাড়ছে কাজের বহর।
জাতীয় সড়কের বহর যে কী হারে বাড়ছে তা একটি হিসাব থেকেই পরিষ্কার হবে। ২০১৪ সালে দেশে জাতীয় সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ছিল ৯১ হাজার ২৮৭ কিলোমিটার। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লক্ষ ৪২ হাজার ১২৬ কিলোমিটার। ভারতের জাতীয় সড়কের যা ব্যাপ্তি তাকে গোটা পৃথিবীতে দৈর্ঘ্যের দিক থেকে দ্বিতীয় বলা চলে।
দেশ জুড়ে একাধিক জাতীয় সড়ক রয়েছে। কিন্তু জানেন কি, কোন উপায়ে জাতীয় সড়কের নামকরণ করা হয়? সে কাজেও রয়েছে বিশেষ পদ্ধতি বা সূত্র। গোটা দেশকে জাতীয় সড়কের ক্ষেত্রে আড়াআড়ি এবং লম্বালম্বি— এই দু’ভাগে ভাগ করা হয়। কিন্তু তাতেও রয়েছে চমক।
ভারতের সমস্ত উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী জাতীয় সড়কের নম্বর হয় জোড় সংখ্যায়। অর্থাৎ, ২, ৪, ৬, ৮ নম্বর জাতীয় সড়ক। এবং সেই নম্বর দেওয়া হয় পূর্ব থেকে পশ্চিম দিক ধরে ঊর্ধ্বক্রমানুসারে। অন্য ভাবে বলতে গেলে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতার নিরিখে উত্তর ভারতকে যদি উঁচু হিসাবে ধরা হয়, তা হলে উত্তর ভারতের জাতীয় সড়কগুলির নম্বর হবে কম সংখ্যায়।
১ নম্বর জাতীয় সড়ক জম্মু-কাশ্মীরের সঙ্গে লাদাখের যোগ স্থাপন করেছে। তা গিয়েছে জম্মু-কাশ্মীরের উরি থেকে লাদাখের লেহ পর্যন্ত। আবার দক্ষিণ ভারতের জাতীয় সড়ক ৮৫ কেরলের কোচি থেকে তামিলনাড়ুর তোন্ডি পর্যন্ত বিস্তৃত।
ভারতের সমস্ত জাতীয় স়ড়ক যেগুলি পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে গিয়েছে, তার নম্বর হয় বিজোড় সংখ্যায়। যেমন, ৩, ৫, ৭, ৯ প্রভৃতি। এ ক্ষেত্রেও উচ্চতার কথা মাথায় রেখে ক্রমান্বয়ে নম্বরের বৃদ্ধি ঘটে। যেমন, ৯ নম্বর জাতীয় সড়ক উত্তর ভারতের পঞ্জাবে রয়েছে। ঠিক তেমনই ৮৭ নম্বর জাতীয় সড়ক রয়েছে দক্ষিণতম রাজ্য তামিলনাডুতে।
দেশের জাতীয় সড়কের সংখ্যা প্রচুর। তার মধ্যে বেশ কিছু জাতীয় সড়কের গুরুত্ব বাকিদের চেয়ে অনেকটাই বেশি। জাতীয় সড়কগুলি গুরুত্বের বিচারে সাধারণত একটি বা দু’টি সংখ্যায় নামকরণ করা হয়।
দেশে কিছু কিছু জাতীয় সড়ক রয়েছে তিন অঙ্কে যাদের নম্বর। সাধারণত সেই জাতীয় সড়কগুলিকে বলা হয় ‘সাবসিডিয়ারি হাইওয়েজ়’। যেমন, ২৪৪, ১৪৪ এবং ৩৪৪ নম্বর জাতীয় সড়ক হল ৪৪ নম্বর জাতীয় সড়কের সাবসিডিয়ারি বা অনুসারি মহাসড়ক।
সাবসিডিয়ারি মহাসড়কের নামকরণের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অক্ষর ব্যবহারেরও চল ছিল। যেমন, ৩১-এর ডি জাতীয় সড়ক। কিন্তু সড়ক পুনর্বিন্যাসের পর এই ধরনের সাবসিডিয়ারি হাইওয়েজের সংখ্যা কমে গিয়েছে।
দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সড়কগুলির মধ্যে অন্যতম জাতীয় সড়ক নম্বর ৪৪, ২৭, ২৪৪ প্রভৃতি। গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সড়কের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২ নম্বর জাতীয় সড়ক অসমের ডিব্রুগড় থেকে মিজোরামের মোকোকচুং পর্যন্ত গিয়েছে।
৭ নম্বর জাতীয় সড়কও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নম্বর দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, তা পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত। পঞ্জাবের ফিরোজপুর থেকে ৭ নম্বর জাতীয় সড়ক গিয়েছে উত্তরাখণ্ডের পিথোরাগড় পর্যন্ত।
দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ রাস্তার নাম ৪৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। এর দৈর্ঘ্য ৩,৭৪৫ কিলোমিটার। যা জম্মু-কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে শুরু হয়েছে। শেষ হয়েছে দক্ষিণ ভারতের শেষতম বিন্দু কন্যাকুমারীতে। এই জাতীয় সড়ক গিয়েছে জম্মু-কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, পঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক এবং তামিলনাড়ুর বুক চিরে।
দৈর্ঘ্যের দিক থেকে বেশ বড় ৪৮ নম্বর জাতীয় সড়কও। নম্বর দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এই জাতীয় সড়কও উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী। ৪৮ নম্বর জাতীয় সড়কের দৈর্ঘ্য ২৮০৭ কিলোমিটার। দিল্লির সঙ্গে তামিলনাড়ুর যোগাযোগ স্থাপন করেছে এই জাতীয় সড়ক।
১৬ নম্বর জাতীয় সড়কও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি ভারতের পূর্ব উপকূলের অন্যতম রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের হুগলির ডানকুনি থেকে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে তামিলনাড়ুর চেন্নাইয়ে। ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশের বুক চিরে গিয়েছে এই মহাসড়ক। যা আগে পরিচিত ছিল ৫ নম্বর জাতীয় সড়ক নামে।
কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গ যাওয়ার প্রধানতম রাস্তার নাম ১২ নম্বর জাতীয় সড়ক। এই জাতীয় সড়ক কলকাতা থেকে শুরু হয়েছে। তার পর বারাসত, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর, বহরমপুর, ফরাক্কা, মালদহ, রায়গঞ্জ পর্যন্ত গিয়েছে।
ভারতে জাতীয় সড়কের দৈর্ঘ্য বিপুল। কিন্তু তা দেশের মোট সড়ক যোগাযোগের ২ শতাংশেরও কম। রাজ্য সড়কের বিস্তার ৩ শতাংশের সামান্য বেশি। তা হলে সিংহভাগ যোগাযোগ কোন পথে হয়? তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬১ শতাংশ সড়ক যোগাযোগ সূচিত হয় গ্রামীণ সড়কের মাধ্যমে।