ব্রুনেই পৌঁছলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ ৪০ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এই প্রথম কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ব্রুনেইয়ে পা রাখলেন। ব্রুনেইয়ের সুলতান হাজি হাসানল বলকিয়া এবং রাজপরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার পর বুধবার সিঙ্গাপুর পৌঁছবেন মোদী। ব্রুনেইয়ের সুলতানের প্রাসাদে নিমন্ত্রণ রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর।
ব্রুনেইয়ের সুলতানের নাম তৃতীয় হাসানল বোকাইয়া ইবনি ওমর আলি সইফউদ্দিন। তবে হাসানল বোকাইয়া নামেই অধিক পরিচিত তিনি। মালয়েশিয়া এবং দক্ষিণ চিন সাগরে ঘেরা বোর্নিয়ো দ্বীপের ছোট্ট দেশ ব্রুনেইয়ের সুলতান হাসানল। ইসলামিক রীতি মেনে সুলতান হওয়ার পাশাপাশি তিনি ব্রুনেইয়ের প্রধানমন্ত্রীও বটে। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পাশাপাশি একাধিক মন্ত্রকেরও দায়িত্বে তিনি। অর্থ, বিদেশ, প্রতিরক্ষা এবং বাণিজ্য মন্ত্রকেরও দায়িত্ব সামলান তিনি। এক দিকে পুলিশ সুপার হিসাবে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন, অন্য দিকে সশস্ত্র বাহিনীরও প্রধান হাসানল।
১৫ জুলাই ১৯৪৬ সালে জন্ম হাসানলের। তাঁর পিতা তৃতীয় সুলতান ওমর আলি সইফউদ্দিন ১০ সন্তানের মধ্যে হাসানলকেই রাজ্যপাট চালানোর জন্য বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে ব্রুনেইয়ের সুলতানের গদিতে বসেন তিনি। ধনসম্পত্তির পরিমাণ নেহাত কম নয় হাসানলের। ভারতীয় মুদ্রায় তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ২ লক্ষ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা।
ব্রুনেইয়ের দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার আগে নিজেদের প্রাসাদেই প্রাথমিক শিক্ষাদীক্ষার পাঠ পড়ানো হয়েছিল সুলতানকে। পরে অবশ্য উচ্চশিক্ষার জন্য মালয়েশিয়ার কুয়ালা লামপুরের ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন তিনি। এর পর ইংল্যান্ডের রয়্যাল অ্যাকাডেমি থেকে স্নাতক হন।
প্রথাগত পড়াশোনার পাট চুকিয়ে বিয়ে সেরে ফেলেন হাসানল। এক বার নয়, তিন তিন বার বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তিনি। তিনি পাঁচ পুত্র এবং সাত কন্যাসন্তানের জনক।
পৈতৃক সূত্রে ধনপ্রাপ্তির পাশাপাশি ব্রুনেইয়ের তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস ভান্ডারগুলি থেকে মুনাফা জুড়েছে হাসানলের সম্পত্তির ঝুলিতে। ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তিনিই ছিলেন বিশ্বের ধনীতম। সে সময় তাঁর মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
বসবাসের জন্য সোনার আস্ত প্রাসাদ বানিয়ে ফেলেছেন হাসানল। ১৯৮৪ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত হয় ব্রুনেই। সেই বছরেই ২২ ক্যারাট সোনা দিয়ে প্রাসাদ গড়ে তুলেছিলেন তিনি। প্রাসাদের নাম ইস্তানা নুরুল ইমান। গিনেস বুকে নামও রয়েছে এই প্রাসাদের। এই নামের অর্থ ‘বিশ্বাসের আলোর প্রাসাদ’।
প্রাসাদের নকশা বানিয়েছিলেন লিয়ান্ড্রো ভি লকসিন। ইসলাম এবং মালয়, দুই রকম ঐতিহ্যের ছাপই রয়েছে এই সোনার প্রাসাদে। সুলতানের সোনার প্রাসাদ রয়েছে ব্রুনেই নদীর তীরে। ব্যক্তিগত বসবাসের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাসাদ এটিই।
২০ লক্ষ বর্গফুট এলাকা জুড়ে বিস্তৃত প্রাসাদটি অত্যন্ত বিলাসবহুল। প্রাসাদে অন্তত ১৭০০টি ঘর রয়েছে। ২৫৭টি শৌচালয় এবং ৫টি সুইমিং পুল রয়েছে। এই প্রাসাদেই সুলতান থাকেন। ব্রুনেইয়ের সমস্ত প্রশাসনিক কাজও হয় এই প্রাসাদ থেকে। তার জন্য আলাদা আলাদা ঘর বরাদ্দ রয়েছে।
প্রাসাদের মধ্যে সুলতানের বিনোদনের জন্য একটি চিড়িয়াখানা রয়েছে। কানাঘুষো শোনা যায়, সেখানে নানা প্রজাতির পাখির পাশাপাশি ৩০টি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার রয়েছে।
সুলতানের সংগ্রহে ৭ হাজারেরও বেশি গাড়ি রয়েছে। এই গাড়িগুলি রাখা থাকে প্রাসাদের গ্যারাজে। প্রাসাদের মধ্যে ১১০টি গ্যারাজ রয়েছে। সুলতানের সংগ্রহে রয়েছে ৪৫০টি ফেরারি, ৩৮০টি বেন্টলিজ়, ২৭৫টি ল্যাম্বরঘিনি, ২৫৮টি অ্যাস্টন মার্টিন, ১৭২টি বুগাটি, ৬০০টি রোলস রয়েস, ৪৪০টি মার্সিডিজ বেঞ্জ, ২৬৫টি অডি, ২৩৭টি বিএমডব্লিউ, ২২৫টি জাগুয়ার এবং ১৮৩টি ল্যান্ড রোভার।
সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ৬৭২ কোটি টাকা মূল্যের বেন্টলি ডমিনেটর এসইউভি রয়েছে সুলতানের সংগ্রহে। ২৪ ক্যারাট সোনার পাতে মোড়া রোলস রয়েস সিলভার স্পার ২ মডেলের গাড়ি রয়েছে তাঁর।
শোনা যায়, শখপূরণের জন্য সোনা দিয়ে একটি রোলস রয়েস গাড়ি আলাদা ভাবে তৈরি করান সুলতান। সেই গাড়ির ছাদ খোলা। একটি ছাতাও লাগানো রয়েছে গাড়িতে।
২০০৭ সালে সুলতান তাঁর কন্যা মাজেদেদার বিয়ে উপলক্ষে তাঁকে সোনার পাতে মোড়া রোলস রয়েসের একটি গাড়ি উপহার দেন বলে কানাঘুষো শোনা যায়।
পোলো খেলার শখ রয়েছে সুলতানের। সেই কারণে ২২০টি ঘোড়াও পোষেন তিনি। ঘোড়াগুলি পরিচর্যার জন্য একাধিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আস্তাবল রয়েছে প্রাসাদ চত্বরে।
সোনার পাত লাগানো ব্যক্তিগত বিমান রয়েছে সুলতানের। সেই বিমানেরও ঠাঁই এই প্রাসাদে। সুলতানের সংগ্রহে রয়েছে সোনায় মোড়া বোয়িং ৭৪৭-৪০০ এবং এয়ারবাস এ৩৪০-২০০ জেট।
সাধারণ মানুষের কাছে এই প্রাসাদ ঘুরে দেখার অনুমতি নেই। একমাত্র রমজান মাসের শেষে এক উৎসব উপলক্ষে সাধারণ মানুষ প্রাসাদে ঢুকতে পারেন। তিন দিন ধরে উৎসব চলে।
প্রতি বছর উৎসবের সময় এক লক্ষেরও বেশি দর্শকের জমায়েত হয় এই প্রাসাদে। নানা রকম সুস্বাদু পদের পাশাপাশি সবুজ কাগজে মোড়া উপহার দেওয়া হয় দর্শকদের। মূলত পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যদের উপহার হিসাবে টাকা দেওয়া হয়।
তবে বলকিয়াহ রাজপরিবারের আরও একটি প্রাসাদ রয়েছে। তার নাম হাউস অফ বলকিয়াহ। ১৪ শতকে এই প্রাসাদ গড়ে উঠেছিল। তবে ইস্তানা নুরুল ইমান প্রাসাদ বানানোর পর হাউস অফ বলকিয়াহের জৌলুস কমে যায়।
সুলতান হাসানল বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনীদের মধ্যে অন্যতম। ২০০৮ সালে ফোর্বস ম্যাগাজ়িন অনুসারে তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল দুই হাজার কোটি ডলার। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের পর তিনিই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে রাজত্ব করা সুলতান। ২০২৪ সালের ৫ অক্টোবর শাসনকালের ৫৭ বছর পূর্তি উৎসব পালন করবেন তিনি।
শোনা যায়, প্রতি মাসে অন্তত এক বার চুলে ছাঁট দেন সুলতান। তিন থেকে চার সপ্তাহ অন্তর তাঁর চুলের কায়দা বদলান তিনি। চুলের ছাঁট দিতেই প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা খরচ করেন সুলতান। সে কারণে লন্ডন থেকে কেশসজ্জাশিল্পীকে ডাক দেন তিনি। কেশসজ্জাশিল্পীকে স্রেফ প্রথম শ্রেণির বিমানভাড়া বাবদ প্রায় ন’লক্ষ টাকা দেন সুলতান।