Galathea Bay Port

মলাক্কা প্রণালীর নাকের ডগায় বন্দর নির্মাণ, নিকোবরের প্রকল্প কি নয়াদিল্লির ‘গেম চেঞ্জার’?

গ্রেট নিকোবর দ্বীপের গালাথিয়া উপসাগরে মেগা ‘আন্তর্জাতিক কন্টেনার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর’ নির্মাণের বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে কেন্দ্র। যা ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সমুদ্র বাণিজ্যের অনেক হিসেব বদলে দেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ০৭:৫৮
Share:
০১ ১৮

ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় প্রভাব বিস্তার, সেই সঙ্গে সমুদ্র বাণিজ্যে চিনকে টক্কর দেওয়া। এই দুই লক্ষ্যপূরণে একের পর এক পদক্ষেপ করছে ভারত। যার মধ্যে অন্যতম হল বঙ্গোপসাগরে উপসাগরীয় বন্দর নির্মাণ। যা নয়াদিল্লির কাছে ‘গেম চেঞ্জার’ হতে পারে বলে মনে করছেন আর্থিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।

০২ ১৮

বঙ্গোপসাগরের এই বন্দর তৈরি হবে গ্রেট নিকোবর দ্বীপে। যার দক্ষিণতম বিন্দু হল ইন্দিরা পয়েন্ট। সেই জায়গার সামান্য উপরে রয়েছে ‘গালাথিয়া উপসাগর’। সেখানেই দেশের ১৩তম বন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। ইতিমধ্যেই যার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।

Advertisement
০৩ ১৮

এর আগে দেশের দ্বাদশ প্রধান বন্দর হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে তালিমনাড়ুর ‘কামরাজার বন্দর’। ওই বন্দর চালু হওয়ার আড়াই দশকের মধ্যে গ্রেট নিকোবরে নতুন সমুদ্র বন্দর তৈরিতে হাত দিতে চলেছে নয়াদিল্লি। যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গালাথিয়ায় ‘আন্তর্জাতিক কন্টেনার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর’ (ইন্টারন্যাশনাল কন্টেনার ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট বা আইসিটিপি) হতে যাচ্ছে বলে সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

০৪ ১৮

বর্তমানে ভারতের হাতে একটি মাত্র কন্টেনার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর রয়েছে। যা কেরলে তৈরি করেছে আদানি গোষ্ঠী। সাধারণ বন্দরের সঙ্গে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের পার্থক্য রয়েছে। একটি বাণিজ্য রুটে অনেক বন্দর থাকে। যে বন্দর থেকে একাধিক জায়গার জন্য জাহাজে পণ্য তোলা বা নামানো হয়, তাকে বলে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর। এত দিন ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় বাণিজ্যে এই ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের জন্য অন্য দেশের সাহায্য নিতে হত ভারতকে।

০৫ ১৮

বিশেষজ্ঞদের দাবি, আইসিটিপি নির্মাণের জন্য কৌশলগত দিক থেকে একটি চমৎকার জায়গা বেছে নিয়েছে ভারত। গ্রেট নিকোবরের গালাথিয়ার অবস্থান পূর্ব-পশ্চিম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সমুদ্রপথের উপর। ফলে এখান থেকে সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও ক্লাংয়ের মতো ট্রান্সশিপমেন্ট টার্মিনালগুলির সুবিধা পাওয়া যাবে। বন্দরটির স্বাভাবিক গভীরতা হবে ২০ মিটার। ফলে বড় জাহাজ অনায়াসেই এতে ঢুকতে পারবে।

০৬ ১৮

দ্বিতীয়ত, গত কয়েক বছর ধরে দ্রুত খবরের শিরোনামে চলে আসা ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলের একটি অংশ হতে চলেছে গালাথিয়া বন্দর। একে ওই এলাকার প্রবেশদ্বার হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। যা ভারতের পূর্ব দিকের সমস্ত সমুদ্র বন্দরের জন্য ট্রান্সশিপমেন্টের কাজ করবে। সেই তালিকায় রয়েছে কলকাতা, হলদিয়া, ধামরা, পারাদ্বীপ, বিশাখাপত্তনম ও চেন্নাই। এ ছাড়া বাংলাদেশের মঙ্গলা, চট্টগ্রাম এবং মায়ানমারের ইয়াঙ্গনকেও সংযুক্ত করবে এই গালাথিয়া বন্দর।

০৭ ১৮

গ্রেট নিকোবর, আন্দমান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অংশ। এটি একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। মলাক্কা প্রণালী থেকে যার দূরত্ব মাত্র ৪০ নটিক্যাল মাইল। এই প্রণালী দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৩৫ শতাংশ পরিচালিত হয়। বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত পণ্যবাহী জাহাজের রুট হিসাবে এর পরিচিতি রয়েছে।

০৮ ১৮

আজকের দিনে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্যের প্রায় ৭৫ শতাংশই পরিচালিত হয় বিদেশি বন্দর থেকে। এর মধ্যে কলম্বো, সিঙ্গাপুর ও ক্লাং বন্দরের উপর ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাণিজ্যের ৮৫ শতাংশ নির্ভরশীল। গালাথিয়া উপসাগরীয় বন্দর তৈরি হলে নয়াদিল্লির ট্রান্সশিপমেন্ট চার্জ বাঁচবে প্রায় ২০ থেকে ২২ কোটি টাকা।

০৯ ১৮

সূত্রের খবর, এই বন্দর নির্মাণে ৪১ হাজার কোটি টাকা খরচ করবে কেন্দ্র। মোট চারটি পর্যায়ে এটি তৈরি করা হবে। প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হলেই বন্দরটিকে চালু করবে নয়াদিল্লি। যা ২০২৮ সাল নাগাদ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

১০ ১৮

গালাথিয়া উপসাগরীয় বন্দর নির্মাণে রয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জ। কারণ, যে এলাকায় এটিকে তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, পরিবেশগত ভাবে তা অত্যন্ত সংবেদনশীল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি আধিকারিকের কথায়, ‘‘বিশেষজ্ঞদের এই নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা করতে হবে। যার উপর ভিত্তি করে পরিবেশ সংবেদনশীলতাকে মাথায় রেখে বন্দরটির নির্মাণকাজ শেষ করা যাবে। তেমনই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’

১১ ১৮

সূত্রের খবর, বন্দর নির্মাণকারী ঠিকাদার সংস্থাগুলিকে পরিবেশ সংবেদনশীলতার বিষয়ে একাধিক প্রস্তাব দিতে হবে। সেগুলি বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখবে কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ দল। এর পরই পর্যায়ক্রমে বন্দর নির্মাণের ছাড়পত্র দেওয়া হবে। যা হাতে এলে কাজ শুরু করতে পারবে ঠিকাদার সংস্থা।

১২ ১৮

প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষে ২০২৮ সালে গালাথিয়া উপসাগরীয় বন্দর চালু হলে এটি ৪০ লক্ষ ‘টোয়েন্টি ফুট ইক্যুইভ্যালেন্ট ইউনিট’ বা টিইইউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। পুরো বন্দরটি তৈরি হয়ে গেলে যা বেড়ে দাঁড়াবে ১ কোটি ৬০ হাজার টিইইউ। প্রথম পর্যায়ের জন্য আনুমানিক খরচ ১৮ হাজার কোটি টাকা ধার্য করা হয়েছে।

১৩ ১৮

প্রথম পর্যায়ে বন্দর নির্মাণের পাশাপাশি ড্রেজ়িং, ব্রেকওয়াটার তৈরি, পণ্য রাখার এলাকা, একাধিক ভবন এবং যন্ত্রপাতি ইনস্টলেশনের কাজ সম্পূর্ণ করা হবে। পাশাপাশি, বন্দরটিকে কেন্দ্র করে একটি পোর্ট কলোনি তৈরি করবে কেন্দ্র। এলাকাটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এখানে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত সমস্যা নেই।

১৪ ১৮

সমীক্ষক সংস্থা ‘ক্রিসিল মার্কেট ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড অ্যানালিটিকস’-এর সিনিয়র ডিরেক্টর ও গ্লোবাল হেড (ট্রান্সপোর্ট, মোবিলিটি অ্যান্ড লজিস্টিক কনসাল্টিং) জগনারায়ণ পদ্মনাভন জানিয়েছেন, গালাথিয়া উপসাগরীয় বন্দর প্রকল্পের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এটি পশ্চিমা়ঞ্চলীয় পণ্যবাহী জাহাজগুলিকে আকর্ষণ করবে। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার অন্য ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলিকে এটি প্রতিযোগিতার মুখে ফেলতে পারে।

১৫ ১৮

বিশেষজ্ঞদের কথায়, এর জন্য পরিকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে কেন্দ্রকে। গালাথিয়ায় শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার দিকেও নজর দেওয়া উচিত। যা বন্দরটিকে সর্ব ক্ষণ পণ্য সরবরাহ করে যাবে। ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এর উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এখানে বিমানবন্দর থাকাটাও জরুরি হতে পারে। তা ছাড়া সরকারের শুল্ক নীতি বন্দরটির উন্নতিতে অনেকাংশেই প্রভাবিত করবে।

১৬ ১৮

গালাথিয়া বন্দর তৈরির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল নির্মাণ সামগ্রী পরিবহণ। উদাহরণ হিসাবে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণের কথা বলা যেতে পারে। যার জন্য প্রচুর পরিমাণে পাথরের দরকার হবে। যা বেশ দূর থেকে আনতে হবে ঠিকাদার সংস্থাকে। এ ছাড়া এই এলাকাটি যথেষ্ট ভূমিকম্পপ্রবণ। ২০০৪ সালের কম্পনে ইন্দিরা পয়েন্ট সমুদ্রের জলরাশির তলায় চলে গিয়েছিল। পরে অবশ্য জল সরলে সেটি ফের উপরে জেগে ওঠে।

১৭ ১৮

সমীক্ষক সংস্থা ‘ইনভেস্টমেন্ট ইনফরমেশন অ্যান্ড ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি’ বা আইসিআরএ-র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট বরুণ গগিয়ার কথায়, ‘‘গালাথিয়া ভারতের অর্থনীতির নতুন মাইলফলক হতে যাচ্ছে। কারণ, রাশিয়ার ভ্লাদিভস্তক থেকে চেন্নাই পর্যন্ত সমুদ্র বাণিজ্যের রাস্তা তৈরি করছে নয়াদিল্লি। সেই পথেই থাকছে এই ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর।’’

১৮ ১৮

তবে জওহরলাল নেহরু পোর্ট অথরিটি (জেএনপিএ) গালাথিয়ার জন্য অর্থ বরাদ্দ করতে রাজি নয়। এই সংস্থা ‘ভাধবন বন্দর’ নির্মাণের কাজ করছে। আর তাই অন্য অংশীদারের খোঁজ করতে হবে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে। প্রকল্পটি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের সহজেই আকৃষ্ট করবে বলে মনে করেন অধিকাংশ আর্থিক বিশেষজ্ঞ।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement