প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কার্যকলাপে আবার কপালে ভাঁজ মোদী সরকারের। ভারত এবং মলদ্বীপের সম্পর্কের টানাপড়েনে মধ্যেই মলদ্বীপের প্রেসিডেন্টের চিন সফরে তৈরী হয়েছে নতুন জল্পনা।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্যের জেরে নয়াদিল্লি-মালে টানাপড়েনের আবহে এ বার সক্রিয় বেজিং। চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সে দেশে সফররত মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জুকে আশ্বাস দিয়েছেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সব রকম সহায়তা করা হবে।
কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত একদলীয় চিনের সরকারি সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ কথা জানানো হয়েছে।
পাঁচ দিনের চিন সফরের তৃতীয় দিনে বুধবার জিনপিংয়ের সঙ্গে রাজধানী বেজিংয়ে বৈঠক করেন মুইজ্জু। সেখানেই ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘাতের আবহে মলদ্বীপের পাশে থাকার অঙ্গীকার করে চিনা প্রেসিডেন্ট তথা কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষনেতা।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ওই বৈঠকেই বেজিংকে তাঁদের ‘পুরনো বন্ধু এবং ঘনিষ্ঠতম সহযোগী’ বলেন মুইজ্জু। দুই রাষ্ট্রপ্রধানের বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক আর্থিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা সংক্রান্ত কয়েকটি চুক্তি সই হয়েছে বলে চিনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমটির দাবি।
কূটনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছে, এ ক্ষেত্রে কার্যত ভারতকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে চিন। জিনপিংয়ের বক্তব্যে স্পষ্ট, এ বার ‘ভারতীয় প্রভাব বলয়ে’ থাকা দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতিতে অনুপ্রবেশের ছক কষছেন চিনের কমিউনিস্ট নেতৃত্ব। অতীতে কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাক সংঘাতেও তাঁদের এমন ভূমিকা দেখা গিয়েছে।
সমাজমাধ্যমে ‘বয়কট মলদ্বীপ’-এর ঠেলা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র। আগে থেকে মলদ্বীপে ঘুরতে যাওয়ার বিমান-হোটেলে টিকিট বুক করে রাখার পরেও তা বাতিল করে চলেছেন একের পর এক ভারতীয়। ক্রমে সেই সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
এই পরিস্থিতিতে চিন সফরে গিয়ে মঙ্গলবার মুইজ্জু চিনা সরকারের এবং সে দেশের বণিকসভার প্রতিনিধিদের কাছে পর্যটক চেয়ে ‘দরবার’ করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, করোনাপর্বের আগে চিন ছিল তাঁদের দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সহযোগী। তিনি চান সেই পরিস্থিতি আবার ফিরে আসুক।
গত সেপ্টেম্বরে দু’দফায় মলদ্বীপে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছিল। সেই ভোটে মলদ্বীপ ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এমডিপি)-র নেতা ইব্রাহিম মহম্মদ সোলিকে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রেসিডেন্টের কুর্সি দখল করেছিলেন মুইজ্জু।
সেই ভোট সম্পর্কে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক দল ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইলেকশন অবজ়ারভেশন মিশন’-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে মুইজ্জু ও তাঁর সহযোগীদের ভারত-বিরোধী প্রচারের উল্লেখ রয়েছে। চিনের ইন্ধনেই মুইজ্জু শিবির ধারাবাহিক ভাবে ভারত বিরোধী কার্যকলাপ চালাচ্ছে বলেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে ওই রিপোর্টে।
মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে ‘চিনপন্থী’ নেতা মুইজ্জু দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ভারতের বিরুদ্ধে একের পর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। যা নিয়ে নয়াদিল্লি-মালে টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনের একাধিপত্যের মোকাবিলা করতে সক্রিয় মোদী সরকার।
আমেরিকার নেতৃত্বে গড়া কোয়াড-এ তারা প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। কিন্তু তার আগে সমুদ্রপথ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগে পড়ছে সাউথ ব্লক। তার অন্যতম কারণ ‘চিন-ঘনিষ্ঠ’ মুইজ্জু। প্রেসিডেন্ট হয়েই তিনি মলদ্বীপে মোতায়েন ভারতীয় সেনাকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন।
সম্প্রতি, তিনি নয়াদিল্লির সঙ্গে চার বছরের পুরনো জলচুক্তি বাতিলের কথা ঘোষণা করেন। ওই চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় নৌবাহিনীর নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সাহায্য করার জন্য মলদ্বীপের জলসীমায় ‘হাইড্রোগ্রাফিক’ সমীক্ষা চালানোর অনুমতি মিলত। চুক্তি বাতিলের ফলে তা বন্ধ হয়েছে।
টানাপড়েনের এই আবহে সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লক্ষদ্বীপে গিয়েছিলেন মোদী। সেই সফরের বেশ কিছু ছবি এবং ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়। অভিযোগ, মলদ্বীপের তিন মন্ত্রী, মরিয়ম শিউনা, মালশা শরিফ এবং মাহজ়ুম মাজিদ কিছু ছবিতে মোদীকে ‘পুতুল’ এবং ‘জোকার’ বলে মন্তব্য করেন।
ভারত-ইজ়রায়েল সম্পর্ক নিয়েও আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়। পরে অবশ্য বিতর্কের মুখে পোস্টগুলি মুছে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মলদ্বীপের বিরোধী নেতাদের চাপের মুখে তিন মন্ত্রীকে সাসপেন্ড করতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু।
কিন্তু বিতর্ক তাতে থামেনি। এই পরিস্থিতিতে মলদ্বীপের বিরোধী দলগুলি অবশ্য ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে। মুইজ্জুকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বরখাস্ত করার জন্য সোলি-সহ বিরোধী নেতৃত্ব আবেদন জানিয়েছে পার্লামেন্ট সদস্যদের কাছে।