আমেরিকার বাল্টিমোর শহরের ‘ফ্রান্সিস স্কট কি’ সেতু বিপর্যয়ের স্মৃতি এখনও টাটকা। বাল্টিমোর বন্দর থেকে যাত্রা করে একটি ভারতীয় জাহাজ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সরাসরি ধাক্কা মারে ‘ফ্রান্সিস স্কট কি’ সেতুর একটি স্তম্ভে। তৎক্ষণাৎ সেতুটি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে প্যাটাপসকো নদীতে।
দুর্ঘটনার সময় এম ভি দালি নামক জাহাজে থাকা ২২ জন ভারতীয় নাবিকের উপস্থিত বুদ্ধির জন্য বড়সড় বিপদ এড়ানো সম্ভব হয়েছে বলে মেনে নিয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও।
দুর্ঘটনার পরই শুরু হয় উদ্ধারকাজ। এই ঘটনায় ছ’জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। কী ভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটল তা নিয়ে তদন্তও শুরু হয়েছে। আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড’ (এনটিএসবি) জানিয়েছে, ঘটনার গভীরে গিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। সব দিক খতিয়ে দেখা হবে। তদন্ত শেষ হতে দু’বছরও লেগে যেতে পারে বলে জানিয়েছে তারা। সেতুর অবস্থা নিয়েও তদন্ত চলছে। আর এই আবহেই মাথাচাড়া দিচ্ছে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব।
বাল্টিমোরের সেতু বিপর্যয়ের পর পরই সমাজমাধ্যমে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেরই ধারণা, এই হামলার নেপথ্যে রয়েছে নাশকতামূলক কার্যকলাপ। এই হামলায় চিনা যোগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকে। কেউ কেউ আবার এর সঙ্গে আমেরিকার ৯/১১-এর হামলার প্রসঙ্গও টানছেন।
অনেকের দাবি, এম ভি দালিতে সাইবার হামলা করেছেন চিনা হ্যাকারেরা। যে সময় জাহাজটি দুর্ঘটনায় পড়ে সেই সময়ে জাহাজে বিদ্যুৎ ছিল না। জাহাজে এ ভাবে বিদ্যুৎ চলে যাওয়া একমাত্র সাইবার হামলাতেই হতে পারে বলে ধারণা তাঁদের।
আমেরিকার সঙ্গে চিনের দ্বন্দ্ব নতুন নয়। অনেক আমেরিকানই চিনকে শত্রু মনে করে। বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারে দুই দেশের ‘লড়াই’ সম্পর্কে প্রায় সকলেই অবগত।
সম্প্রতি আমেরিকা এপিটি৩১ নামে পরিচিত একটি হ্যাকিং গ্রুপের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। শুধু আমেরিকা নয়, ব্রিটেনও একই গ্রুপের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
চলতি বছরের শেষে আমেরিকায় জাতীয় নির্বাচন রয়েছে। গোয়েন্দাদের দাবি, চিনা হ্যাকারেরা আমেরিকার অনেক উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার, সাংবাদিক, বিচার বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি, রাজনীতিবিদদের উপর নজরদারি চালাচ্ছে। আর তাই নাকি তাদের উপর এই নিষেধাজ্ঞা।
বাল্টিমোরের সেতু বিপর্যয়ের পরেই চিনা হ্যাকারদের উপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা জারির ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। এই দুই ঘটনা কি শুধুই সমাপতন না কি সত্যিই দুই ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে, তা নিয়েই চর্চা তুঙ্গে। আমেরিকার তথ্য বিশেষজ্ঞ ব্রায়েন কস্টেলো এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করে দাবি করেছেন, ‘‘বাল্টিমোরের সেতু বিপর্যয়ের ঘটনার পর আমাদের বন্দরের সাইবার দুর্বলতার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি করছে।’’
তিনি তাঁর মন্তব্যের সপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘‘আমেরিকার বন্দরগুলিতে কাজ সহজ করতে ব্যবহৃত ক্রেনগুলির প্রায় ৮০ শতাংশই চিন তৈরি করে এবং সেগুলি চিনা সফ্টওয়্যার দ্বারা পরিচালিত করা হয়।’’
চিনা হামলার তত্ত্ব অবশ্য মানতে নারাজ হোয়াইট হাউস এবং বল্টিমোর প্রশাসন। বল্টিমোরের পুলিশ কমিশনার রিচার্ড ওরলিও জানিয়েছেন, তদন্তে নাশকতার কোনও চিহ্ন মেলেনি। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে মুখ খুলেছে চিনও। বাল্টিমোরের সেতু বিপর্যয়ের সঙ্গে চিন যোগের সম্ভাবনার জল্পনাকে ‘অপবাদ’ বলে নিন্দা করেছেন ওয়াশিংটনে চিনা দূতাবাসের মুখপাত্র লিউ পেংইয়ু।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যে কোনও বিপর্যয়ের পরেই এ ধরনের ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব প্রকাশ্যে আসে। আর এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে পুরনো শত্রুকেই খাড়া করা হয়। বাল্টিমোর সেতু বিপর্যয়ের পর তাই চিনকে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে। এতে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে যা দুই দেশের সম্পর্কে অবনতি ঘটাতে পারে।
গত জানুয়ারিতে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই সতর্ক করে বলেছিল, চিনা সরকারের হয়ে আমেরিকায় ‘ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর’ প্রস্তুতি নিচ্ছে সাইবার অপরাধীরা।
এফবিআই প্রধান ক্রিস্টোফার রে সে সময় বলেছিলেন, ‘‘প্রায় প্রতি দিনই তারা (চিন) আমাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সক্রিয় ভাবে আক্রমণ চালাচ্ছে। এতে আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হয়ে যাচ্ছে।”
যদিও, এমন অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে আখ্যা দিয়েছিল চিন। এফবিআইয়ের সতর্কতা জারির পরই হোয়াইট হাউস এই নিয়ে পদক্ষেপ করা শুরু করে। আলোচনা করার পর চিনা হ্যাকারদের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপায় আমেরিকা।