সামরিক ক্ষমতা বাড়িয়েই চলেছে চালবাজ চিন। যা নিয়ে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে আমেরিকার। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত মিটিয়ে নেওয়ায় পর বেজিংয়ের পরবর্তী লক্ষ্য কি ওয়াশিংটন? নাকি প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ান হাতানোর ছক কষছে ড্রাগনল্যান্ড? সেই আশঙ্কা কুরে কুরে খাচ্ছে আটলান্টিকের পাড়ের মহাশক্তিধর দেশটির ফৌজি জেনারেলদের।
সম্প্রতি, চিন নিয়ে ‘নিউক্লিয়ার চ্যালেঞ্জেস্’ শীর্ষক একটি বিশেষ রিপোর্ট প্রকাশ করে আমেরিকার ‘ডিফেন্স ইনটেলিজেন্স এজেন্সি’ (ডিআইএ)। ৬৪ পাতার ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, মাঝারি পাল্লার ‘ডিএফ-২৬’ ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা বাড়াচ্ছে বেজিং। যার কোড নেম ‘গুয়াম কিলার’ রেখেছে ড্রাগনল্যান্ডের পিপলস্ লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)।
প্রশান্ত মহাসাগরের গুয়ামে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। ডিআইএর দাবি, সেই সেনা ছাউনি বা যুদ্ধজাহাজে হামলার পরিকল্পনা রয়েছে চিনের। সেই মতো ডিএফ-২৬ ক্ষেপণাস্ত্রগুলি মোতায়েন করছে বেজিং। এগুলি নিখুঁত নিশানায় পরমাণু হামলা চালাতে সক্ষম বলে জানিয়েছে পিএলএ।
আণবিক এবং প্রচলিত, দুই ধরনের হাতিয়ারের সংখ্যা যে ভাবে চিন বৃদ্ধি করছে, তাতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার ভূরাজনৈতিক স্থিরতায় আঘাত লাগার আশঙ্কা রয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করেছে ডিআইএ। বেজিংয়ের সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে এখন থেকে প্রস্তুতি নেওয়া পরামর্শও দিয়েছে আমেরিকার এই সংস্থা।
ডিআইএর রিপোর্টে এই গুয়াম কিলারের ছবি দেওয়া হয়েছে। লম্বা গাড়ির উপর রাখা ওই ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরক বহন ক্ষমতা উল্লেখ করেছে ওয়াশিংটনের সংস্থা। তাদের দাবি, প্রচলিত ও পারমাণবিক— দু’ধরনের ওয়ারহেড বহনে সক্ষম এই ডিএফ-২৬।
রিপোর্টে আমেরিকান সংস্থাটি লিখেছে, ‘‘ডিএফ-২৬ মাটির উপর যে কোনও লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। আবার নৌঘাঁটি বা রণতরী ডোবানোর ক্ষেত্রেই এর জুড়ি মেলা ভার। এটি প্রকৃতপক্ষে চিনের রোড মোবাইল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা। বেজিংয়ের যাবতীয় পরমাণু হাতিয়ারের মধ্যে যা অনন্য।’’
ওয়াশিংটনের গোয়েন্দাদের দাবি, ছোট আকারের পরমাণু হামলায় সক্ষম অস্ত্র তৈরির দিকে মন দিয়েছে ড্রাগনল্যান্ড। যা বহন করবে স্বল্প বা মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। আমেরিকার ঘাঁটিতে হামলার পর ‘আনুপাতিক প্রতিক্রিয়া’র কথা মাথায় রেখে এই পরিকল্পনা করেছে বেজিং। বড় আকারের ওয়ারহেডের সঙ্গে যা সম্ভব নয়।
রিপোর্টে ডিআইএ লিখেছে, ‘‘সাম্প্রতিক সময়ে থিয়েটার রেঞ্জ ডেলিভারি সিস্টেমের মজুত বাড়াচ্ছে চিন। সেই তালিকায় রয়েছে ডিএফ-২৬ মাঝারি পাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। কম ক্ষমতা সম্পন্ন ওয়ারহেড নিয়েও এগুলি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত করতে পারে। যুদ্ধের পরিকল্পনা না থাকলে এ ভাবে হাতিয়ার এবং গোলা-বারুদ মজুতের প্রয়োজন হয় না। এটাই সবচেয়ে চিন্তার।’’
পরমাণু হাতিয়ার বৃদ্ধির বিষয়টি অস্বীকার করেনি ড্রাগনল্যান্ড। তবে এর জন্য ওয়াশিংটনকেই দায়ী করেছে বেজিং। ২০১৯ সালে রাশিয়ার সঙ্গে থাকা আণবিক চুক্তি থেকে সরে আসে আমেরিকা। চিনের যুক্তি, এই সিদ্ধান্ত বিশ্বের শীর্ষ পরমাণু শক্তিধর দেশগুলির কৌশলগত স্থিতিশীলতায় আঘাত হেনেছিল। যার জেরে বাধ্য হয়ে এই ধরনের হাতিয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে তারা।
২০২১ সালে চিনা ফৌজের হাতে থাকা ডিএফ ২৬-র সংখ্যা সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস ইনটেলিজেন্স সেন্টার’। সেখানে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে পিএলএর হাতে এই ক্ষেপণাস্ত্রের লঞ্চারের সংখ্যা ছিল ২০০। সাত মাসের মধ্যে যা বাড়িয়ে ৩৫০ করেছে পিএলএ। তবে মোট ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা এখনও জানা যায়নি।
ড্রাগনল্যান্ডের সরকারি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘গুয়াম কিলার’-এর পাল্লা ২ হাজার ৪৮৫ কিলোমিটার। অর্থাৎ দক্ষিণ চিন সাগরের মোবাইল লঞ্চার থেকে ছুড়ে গুয়াম দ্বীপের আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি ওড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে ডিএফ ২৬-এর। পাশাপাশি, এই এলাকায় টহলরত ওয়াশিংটনের বিমানবাহী রণতরীগুলিকে ধ্বংস করতে পারে সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্র।
চলতি বছরের জুনে চিনের শক্তি বৃদ্ধি নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন আমেরিকার ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত নৌসেনা অফিসার অ্যাডমিরাল স্যাম পম্পেরো। গুয়ামের বায়ুসেনা ছাউনি পরিদর্শনের পর তিনি বলেন, ‘‘এই দ্বীপ রক্ষা করা আমেরিকার মূল ভূখণ্ড বাঁচানোর সামিল। যা আমার প্রথম কর্তব্য। আর তাই এটাকে অগ্রাধিকার দিয়েছি।’’
চিনের পরমাণু হাতিয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধিকে ছোট বাহিনী থেকে ‘সুপার পাওয়ার’ হওয়ার পথে দৃঢ় পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেছে আমেরিকার স্ট্র্যাটেজিক কম্যান্ড। ডিআইএ জানিয়েছে, ২০২০ সালে বেজিংয়ের কাছে আণবিক অস্ত্রের আনুমানিক সংখ্যা ছিল ২০০-র কম। ২০৩০ সালের মধ্যে যা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
ডিআইএর রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘‘ভূমি, আকাশ এবং জল থেকে পরমাণু হামলায় ওয়ারহেডের সংখ্যা বাড়াচ্ছে লালফৌজ। ক্ষেপণাস্ত্র এবং বোমারু বিমানের সাহায্যে যা আমেরিকার বিভিন্ন শহরের উপর ফেলতে পারে পিএলএ। এ ব্যাপারে বেজিংয়ের রকেট ফোর্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।’’
পাশাপাশি, পরমাণু ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনকারী ডুবোজাহাজের সংখ্যাও বাড়াচ্ছে চিন। বর্তমানে ‘ঝাও’ শ্রেণির এই ধরনের মোট ছ’টি ডুবোজাহাজ রয়েছে পিএনএ নৌসেনার হাতে। সেখানে আরও দু’টি যুক্ত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়া লালফৌজের বায়ুসেনার কাছে রয়েছে ‘এইচ ৬-এন’ বোমারু বিমান। এগুলি পরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম। শুধু তাই নয়, মাঝ আকাশে জ্বালানি ভরতে পারে এই বোমারু বিমান। যা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা রয়েছে আমেরিকার সেনাকর্তাদের।
ওয়াশিংটনের গোয়েন্দাদের দাবি, চিনের পাশাপাশি গত দু’বছরে আণবিক অস্ত্রের সংখ্যা বাড়িয়েছে রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া। অন্য দিকে এই হাতিয়ার তৈরির খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছে ইরান। পরমাণু হাতিয়ার নির্মাণে শিয়া মুলুকটিকে পিছন থেকে মস্কো প্রবল ভাবে সমর্থন করছে বলে জানা গিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে ভারতও। সূত্রের খবর, বর্তমানে পাকিস্তানের থেকে বেশি সংখ্যায় অনবিক অস্ত্র রয়েছে নয়াদিল্লির হাতে। চিনের সঙ্গে আপাতত সীমান্ত সংঘাত থামলেও ফৌজি শক্তি বাড়াতে নিত্য নতুন হাতিয়ার তিন সেনার হাতে তুলে দিচ্ছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।