নতুন বিতর্কে জড়ালেন স্বঘোষিত ‘যোগগুরু’ রামদেব। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, মহিলাদের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন তিনি।
ঠাণের একটি শিবিরে মহিলা অনুগামীদের সামনে যোগ প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন তিনি। সেই শিবিরে উপস্থিত ছিলেন মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা দেবেন্দ্র ফডনবীশের স্ত্রী অম্রুতা ফডনবীশ এবং মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডের পুত্র শ্রীকান্ত শিন্ডে।
ওই শিবিরেই রামদেবের একটি মন্তব্য সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখান থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। যদিও আনন্দবাজার অনলাইন এই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি।
ভিডিয়োটিতে রামদেব বলছেন, “মেয়েদের শাড়ি পরলে দেখতে ভাল লাগে, সালোয়ার পরলেও ভাল লাগে, আবার কিছু না পরলেও ভাল লাগে।”
যোগগুরু মজার ছলে কথাটি বললেও মহিলা দর্শকদের তরফে কোনও হাততালি দেওয়া হয়নি। কেবল হাসতে দেখা যায় ফডনবীশ-পত্নীকে।
রামদেবের এই বিতর্কিত মন্তব্য সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই নড়েচড়ে বসে মহিলা কমিশন। দিল্লির মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন ভিডিয়োটি টুইট করে রামদেবকে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেন।
রামদেবের এই মন্তব্যকে ‘অত্যন্ত নিন্দাজনক’ বলেও আখ্যা দেন তিনি। এই মন্তব্যকে ঘিরে রাজনৈতিক রং লাগতে বেশি সময় নেয়নি।
উদ্ধব-সেনার নেতা এ নিয়ে মহারাষ্ট্রের শাসক জোটের কড়া সমালোচনা করেছে। উদ্ধব-ঘনিষ্ঠ নেতা সঞ্জয় রাউত জানিয়েছেন, এই অন্যায় মন্তব্যের প্রতিবাদ করা উচিত ছিল ফডনবীশ-পত্নীর।
একই সঙ্গে তাঁর দাবি, এই সরকার কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানে না।
এর আগে এ রকম নানা বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন রামদেব। দেশের জনসংখ্যা কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, তার ‘মোক্ষম দাওয়াই’ দিয়েছিলেন বাবা রামদেব। যে সমস্ত দম্পতির দুইয়ের বেশি সন্তান, তাঁদের ভোটদানের অধিকার কেড়ে নেওয়ার নিদান দেন তিনি!
আলিগড়ের একটি অনুষ্ঠানে জনসমক্ষে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের এমন দাওয়াই দেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের এই একটা দাওয়াইয়েই তিনি অবশ্য থেমে থাকেননি। প্রয়োজনে সরকারি চাকরি, চিকিৎসার সুবিধাও কেড়ে নেওয়ার কথা বলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘হিন্দু বা মুসলিম যে-ই হন না কেন, যাঁদের দুইয়ের বেশি সন্তান, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে তাঁদের ভোটাধিকার, সরকারি চাকরি এবং চিকিৎসার সমস্ত সরকারি সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নিতে হবে। তবেই একমাত্র দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।’’
যোগগুরু বিয়ে করেননি। তাঁর মতো অবিবাহিতদের বিশেষ ভাবে সম্মানিত করা উচিত বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি। কারণ, রামদেবের দাবি, তাঁদের মতো ব্যক্তিরাই দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন। হরিদ্বারে নিজের আশ্রমে রামদেবের ভক্তদের নিয়ে এক সমাবেশে এ কথা বলেছিলেন তিনি।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে রামদেব আরও বলেছিলেন, “বেদশাস্ত্রে কোনও কোনও ক্ষেত্রে এক জন দম্পতির ১০টি সন্তানের জন্ম দেওয়ারও অনুমতি রয়েছে। ফলে যাঁরা ক্ষমতাবান এবং যাঁদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তাঁরা এমনটা করতেই পারেন।” তবে এমনটা করা এ যুগে কি যুক্তিযুক্ত হবে, সে নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। দাবি করেন, “দেশের জনসংখ্যা ১২৫ কোটি পার হয়ে গিয়েছে। ফলে আমাদের আর জনসংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা নেই।”
শুধু তা-ই নয়, অ্যালোপ্যাথি ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন রামদেব। এ জন্য যোগগুরুর সমালোচনা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এনভি রমণার নেতৃত্বে একটি বেঞ্চ জানায়, রামদেব আয়ুর্বেদশাস্ত্র জনপ্রিয় করার জন্য প্রচার চালাতেই পারেন। কিন্তু তার জন্য তাঁর অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থার সমালোচনা করা উচিত নয়।
অতিমারি আবহে রামদেব দাবি করেছিলেন, তাঁর সংস্থার তৈরি আয়ুর্বেদিক ওষুধ কোরোনিল কোভিড-১৯ ভাইরাস থেকে পুরোপুরি ভাবে সুরক্ষা দিতে সক্ষম। একই সঙ্গে একটি ভিডিয়োতে তিনি কোভিডের টিকা এবং এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন করেন। তিনি আরও দাবি করেন, করোনার দু’টি টিকা নেওয়ার পরে ভারতে বেশ কয়েক জন চিকিৎসক মারা গিয়েছেন। এমনকি, অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসাকে ‘মুর্খ এবং দেউলিয়া’ বিজ্ঞান বলেও মন্তব্য করেছিলেন যোগগুরু। এর পরই রামদেবের বিরুদ্ধে সরব হয় চিকিৎসক সংগঠনগুলি।
কোভিড টিকার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার অভিযোগ এনে রামদেবের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল চিকিৎসকদের সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ)’। আইএমএ-র আবেদনে কেন্দ্রের কী মত, সেই জবাব চেয়েও নোটিস পাঠায় সুপ্রিম কোর্ট। এর আগে তাঁর করা মন্তব্যের জন্য দিল্লি হাই কোর্টও রামদেবকে সতর্ক করেছিল।
শুনানি চলাকালীন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এনভি রমণা আদালতে প্রশ্ন তোলেন, ‘‘রামদেব কেন অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন? তিনি যোগব্যায়ামকে জনপ্রিয় করেছেন। সেটা খুব ভাল কথা। কিন্তু তার জন্য তাঁর অন্য চিকিৎসা ব্যবস্থার সমালোচনা করা উচিত নয়। তিনি যা মেনে চলেন তা মেনে চললেোই সবাই সব রোগ থেকে সুস্থ হয়ে যাবেন তার নিশ্চয়তা কী?’’
তবে রামদেবের সঙ্গে বরাবরই গেরুয়া শিবিরের সখ্য চোখে পড়ার মতো। সম্প্রতি রামদেবের ‘দিব্য ফার্মেসি’র উৎপাদিত পাঁচটি ওষুধের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় উত্তরাখণ্ডের আয়ুর্বেদ ও ইউনানি লাইসেন্সিং অথরিটি। আগের নির্দেশিকাকে সংশোধন করে নতুন নির্দেশিকাও জারি করা হয়। সেখানে বলা হয়, ওই ৫টি ওষুধ উৎপাদন জারি রাখতে পারবে রামদেবের সংস্থা।
নির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ৯ নভেম্বর, রামদেবের সংস্থার মধুমেহ, রক্তচাপ, গলগণ্ড, গ্লুকোমা এবং উচ্চ কোলেস্টোরলের ওষুধ উৎপাদনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। তিন দিনের মধ্যেই সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
গত জুলাইয়ে, কেরলের চিকিৎসক কেভি বাবু অভিযোগ করেন, রামদেবের সংস্থা ১৯৫৪-এর ‘ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস (অবজেক্শেনবল অ্যাডভারটাইজমেন্ট)’ এবং ১৯৪০-এর ‘ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিক্স অ্যাক্ট’ লঙঘন করে এই ওষুধগুলো বিক্রি করে যাচ্ছেন। বাবু গত ১১ অক্টোবর এই মর্মেই আরও একটি অভিযোগ দায়ের করেন। গত ৯ নভেম্বর ওই ওষুধের উৎপাদন বন্ধের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যম থেকে এই সংক্রান্ত সমস্ত বিজ্ঞাপনও বন্ধ করার নির্দেশনামা জারি করে। মাত্র তিন দিনের মাথায় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় উত্তরাখণ্ড সরকার।