স্কুলের পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলোতেও অত্যন্ত আগ্রহ ছিল ছোট্ট মেয়েটির। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির শহরতলিতে ওয়ারুঙ্গায় এলাকায় বেড়ে ওঠার সময় ক্রিকেট, ফুটবল, গল্ফ, টেনিস, অ্যাথলেটিক্স এবং টাচ ফুটবল খেলতেন। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি নয়, একসঙ্গে দু’টি খেলায় মন দিয়েছিলেন এলিস পেরি। আক্ষরিক অর্থেই তিনি অলরাউন্ডার।
বিশ্বক্রিকেটে এলিস অন্যতম বড় নাম। কম বয়সেই নিজের লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছিলেন। তবে ক্রিকেটের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফুটবলেও কিশোরী এলিসের অভিষেক ঘটেছিল প্রায় একই সময়ে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ষোলো।
সদ্যসমাপ্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ষষ্ঠ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার মেয়েরা। দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে ফাইনালে তাদের হারিয়েই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এলিসের অস্ট্রেলিয়া। এখন তিনি ব্যস্ত ভারতে উইমেন্স প্রিমিয়ার লিগ খেলতে।
মহিলাদের আইপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের জার্সিতে প্রথম দু’টি ম্যাচে অবশ্য বিশেষ কিছু করতে পারেননি এলিস। দু’টি ম্যাচেই হারের মুখ দেখেছে আরসিবি। তবে তাতে তাঁর আন্তর্জাতিক স্তরের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না।
ষোলো বছর বয়সে এক দিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল এলিসের। অভিষেকেই রেকর্ড। পুরুষ, মহিলা মিলিয়ে এক দিনের ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে এত কম বয়সে আগে কেউ খেলেননি।
বড়দের কোনও প্রতিযোগিতায় না খেলেই ২০০৭ সালে নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন এলিস। তখন তাঁর বয়স ছিল ষোলো বছর ৮ মাস।
প্রথম ম্যাচে নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৮ ওভার হাত ঘুরিয়ে ৩৭ রানে ২ উইকেট নিয়েছিলেন এলিস। পরে লোয়ার অর্ডারে ব্যাট করতে নেমে ২০ বলে ১৯ রানও করেন। তবে সে ম্যাচে ৩৫ রানে হারতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে।
প্রথম ম্যাচে জয়ের স্বাদ না পেলেও প্রায় ষোলো বছরের ক্রিকেটীয় জীবনে অজস্র সাফল্য পেয়েছেন এলিস। ৩২ বছরের এলিস ১০টি টেস্টে ৭৫.২০ গড়ে ৭৫২ রান করেছেন। সর্বোচ্চ অপরাজিত ২১৩। সঙ্গে ৩৭টি টেস্ট উইকেট।
১৩১টি এক দিনের ক্রিকেটে ৩,৩৮৬ রান করেছেন এলিস। গড় প্রায় ৫০ ছুঁইছুঁই। ৫০ ওভারের ম্যাচে তাঁর উইকেট ১৬১।
টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেও তাঁর দক্ষতার পরিচয় পেয়েছেন দর্শকেরা। ১৩০টি ম্যাচে দেড় হাজারের বেশি রান এবং ১২২টি উইকেট রয়েছে এলিসের। এই ফরম্যাটে তাঁর ব্যাটিং স্ট্রাইক রেট ১১২.২০।
২০ ওভারের ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার ৬ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পিছনে এলিসের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। ২০১০ সালের ফাইনালে নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্যাট করার সুযোগ না পেলেও বল হাতে ৪ ওভারে ১৮ রানে ৩ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন। সে ম্যাচের সেরাও হন এলিস।
৫ দিনের ম্যাচেও বার বার জ্বলে উঠেছেন। ২০১৪ এবং ’১৫ সালের অ্যাশেজ়ে সিরিজ় সেরা হয়েছিলেন এলিস। সে সময় জীবনের সেরা ছন্দে ছিলেন তিনি।
২০১৫ থেকে ’১৭ সালের মধ্যে ২৬টি টেস্ট ইনিংসে ১৬টি অর্ধশতরান করেন এলিস। এর পর ’১৭-র অ্যাশেজ় সিরিজ়ে জীবনের সেরা অপরাজিত ২১৩ করেছিলেন তিনি। অস্ট্রেলীয় মহিলাদের মধ্যে যা এখনও রেকর্ড।
পরের বছর আরও একটি রেকর্ড গড়েন এলিস। নিজের এবং দেশের চতুর্থ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পথে ১০০ উইকেটের মালকিন হন। তিনিই প্রথম অস্ট্রেলীয়, যিনি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ১০০ উইকেট নিয়েছেন। আবার বিশ্বের প্রথম মহিলা ক্রিকেটার হিসাবে টি-টোয়েন্টিতে হাজার রানও রয়েছে এলিসের।
অস্ট্রেলিয়ার মহিলা ক্রিকেটে আরও একটি রেকর্ড এলিসের দখলে রয়েছে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১০ ওভারে ২২ রান দিয়ে ৭ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। ২০১৯ সালের সেই পারফরম্যান্স এখনও পর্যন্ত মহিলাদের এক দিনের ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার সেরা বোলিং পরিসংখ্যান।
ক্রিকেটে পরিচিত মুখ এলিসের ফুটবল দক্ষতাও প্রশ্নাতীত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ষোলো বছর ৮ মাস বয়সে অভিষেকের তেরো দিন পরেই দেশের জার্সিতে ফুটবল খেলতে নেমেছিলেন এলিস।
২০১১ সালে জার্মানিতে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরেও দেখা গিয়েছিল এলিসকে। ওই বছরেই বিরল নজির গড়ে ফেলেন তিনি। প্রথম খেলোয়াড় হিসাবে ক্রিকেট এবং ফুটবল বিশ্বকাপে খেলার কৃতিত্ব অর্জন করেন।
সেই বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম একাদশের ঢুকেই ক্ষান্ত হননি তিনি, মেটিল্ডাদের (অস্ট্রেলীয় মহিলা ফুটবলারদের ওই নামেই ডাকা হয়) হয়ে সুইডেনের বিরুদ্ধে স্মরণীয় গোলও করেন এলিস।
অস্ট্রেলিয়াকে শেষ ষোলোয় টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন এলিস। সুইডেনে বিরুদ্ধে ১-৩ গোলে হেরে গেলেও দলের একমাত্র গোলটি ছিল তাঁর। যদিও ওই বিশ্বকাপের পর থেকে ফুটবল ছেড়ে পুরোপুরি ক্রিকেটেই মন দেন এলিস।
অনেকের মতে, ২০১১ সালের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার মহিলা দলের সেরা গোলটি ছিল মিডফিল্ডার এলিসের। পেনাল্টি বক্সের বাইরে বল পেয়ে ডান দিক দিয়ে সোজা সুইডেনের গোলের দিকে দৌড় লাগিয়েছিলেন তিনি। এর পর জোরালো শট মারেন। এলিসের সেই শটটি সুইডিশ গোলরক্ষকের মাথার উপর দিয়ে জালে জড়িয়ে যায়। সে ম্যাচে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিলেও এলিসের গোলের স্মৃতি আজও অনেকের কাছে ধূসর হয়নি।