পোল ডান্স! একটা লম্বা খুঁটিকে জড়িয়ে নাচ। প্রথমটায় শুনে অনেকে ভ্রূকুটি করেছিলেন। বলেছিলেন, এ সব তো পানশালা বা স্ট্রিপ ক্লাবে হয়! তিনি তোয়াক্কা করেননি, বরং মহড়ার সময় বাড়িয়েছেন। সমাজমাধ্যমে নতুন নতুন ভিডিয়ো পোস্ট করেছেন। এখন সেই অনুষা স্বামীর হাত ধরে ‘অচ্ছুত’-এর তকমা অনেকটাই ঝেড়ে ফেলেছে পোল ডান্স। অনুষার মতো অনেকেই ফিট থাকতে বেছে নিচ্ছেন পোল ডান্সকে।
যে চেন্নাইতে জন্ম ভরতনাট্যমের, সেখানেই বহু ঘরে এখন নিত্য চর্চার বিষয় এই পোল ডান্স। তামিল তরুণী অনুষা এবং আরও কয়েক জনের সহযোগিতায় বেশ কয়েকটি কর্মশালাও হয়েছে ওই শহরে। অনেকেই সমাজ মাধ্যমে অনুষার নাচের ভিডিয়ো দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
তবে এই পোল ডান্সকে নতুন রূপ দিয়েছেন অনুষা। কোনও উত্তেজনাপূর্ণ গানের সঙ্গে নয়, বরং তামিল গানের সঙ্গে পোল ডান্স করেন অনুষা। এআর রহমানের ‘ইয়েনগা পোনা রাসা’, ইলাইয়ারাজার ‘ঠুম্বি ভা’ গানের সঙ্গে নাচ কম্পোজ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন অনুষা।
কেন হঠাৎ এ সব গানের সঙ্গে নাচেন অনুষা? একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, কোনও কিছুই পূর্ব পরিকল্পিত নয়। তাঁর কথায়, ‘‘যে সব গান ছোট থেকে শুনে বড় হয়েছি, বাড়িতে সেগুলির সঙ্গেই নাচের মহড়া দিই। আমি এক জন শিল্পী। তাই গান শুনলেই নেচে উঠি।’’ অনুষা জানিয়েছেন, পরে যখন নিজের নাচ মোবাইলে রেকর্ড করতে শুরু করেন, তখন দেখেন, তামিল গানের সঙ্গে তা ভালই যাচ্ছে।
ইনস্টাগ্রামে অনুষার অনুগামীর সংখ্যা ১০ লক্ষেরও বেশি। সেই অনুগামীর তালিকায় রয়েছেন ‘দিল বেচারা’ ছবির পরিচালক মুকেশ ছাবড়া, পোশাক ডিজাইনার নীতা লুল্লা।
কী ভাবে এই পোল ডান্সে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন অনুষা? তা নিয়ে অদ্ভুত এক গল্প রয়েছে। ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। মেলবোর্ন শহরে যে হোটেলে ছিলেন, তার পাশেই পোল ডান্সের প্রশিক্ষণ চলছিল।
অনুষা চার দিনের সেই পোল ডান্স প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগ দেন। তখনও জানতেন না, পরে এই নাচই তাঁর জীবনের অক্সিজেন হয়ে উঠবে।
২০২০ সালে লস এঞ্জেলেসে নাচের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য যাওয়ার কথা ছিল অনুষার। অতিমারির কারণে সেই প্রশিক্ষণ নিতে আর যাওয়া হয়নি। তখন বাড়িতে বসে অনলাইনে পোল ডান্সের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন অনুষা। নিজেও মহড়া শুরু করেন।
অতিমারির সময় এই পোল ডান্সই বাঁচার রসদ জুগিয়েছিল অনুষাকে। তিনি মনে করেন, শুধু পানশালায় পারফর্ম করার জন্য এই নাচের জন্ম নয়। তার বাইরেও অন্য দিশা খুলে দিতে পারে এই পোল ডান্স।
এই নাচকে কখনওই ‘নিষিদ্ধ’ বলে ভাবতে চাননি অনুষা। তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘প্রথমে মজার জন্যই এই নাচ শিখতে শুরু করেছিলাম। সমাজের কুৎসা যখন শুরু হয়, তখন বিদ্রোহী হয়ে উঠি। জিজ্ঞেস করি, এই নাচে লজ্জার কী রয়েছে?’’
অনুষার মতে, এই বিশেষ ধরনের নাচের জন্য মনোসংযোগ প্রয়োজন হয়। এই নাচের জন্য ক্রীড়াবিদের মতো ফিটনেসও প্রয়োজন হয়।
অনুষার এই নাচের ভিডিয়ো দেখে সমালোচনার ঝড়ও ওঠে। তবে অনুষা সে সবে মাথা ঘামান না। তিনি বরং তাঁর নাচের প্রতি মনোসংযোগ বাড়িয়েছেন।
অনুষা এও জানিয়েছেন, সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীদের একাংশ তাঁর নাঁচ নিয়ে আপত্তি তুললেও কোনও সুরকার বা গীতিকার তাঁদের গান ব্যবহার নিয়ে বাদ সাধেননি। তাঁর কথায়, ‘‘প্রকৃত শিল্পী হলে এ ধরেনর আপত্তি তুলবেন না। কারণ আমি নিজের কাজ করছি। আর তাঁরা নিজের।’’
শিল্পী এই নাচ নিয়ে কর্মশালারও আয়োজন করেছিলেন। তাতে কারা যোগ দিয়েছিলেন? অনুষা জানিয়েছেন, আইনজীবী, তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী থেকে যোগ প্রশিক্ষক, সকলেই যোগ দিয়েছিলেন, যাঁদের বয়স ১১ থেকে ৪৮। অনেকেরই চেহারা বেশ ভারী। তাঁরাও উৎসাহী হয়ে যোগ দিয়েছিলেন কর্মশালায়।
এখন নাচ অনুষার প্রাণ হলেও এক কালে কিন্তু তা ছিল না। রীতিমতো জোর করেই তাঁকে নাচের ক্লাসে ভর্তি করিয়েছিলেন মা। অনুষার কথায়, ‘‘তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেছিলাম। তাই ছোট থেকে নাচ-গান করা এক প্রকার বাধ্যতামূলক ছিল।’’
অনুষার ঠাকুমা ভায়োলিন বাজাতেন। মায়ের বাবা বীণা শেখাতেন। অনুষাকেও ছোটবেলায় গানের ক্লাসে ভর্তি করানো হয়েছিল। যদিও সে সব ছিল তাঁর নাপসন্দ। শেষে ৬ বছর বয়সে ভরতনাট্যমের ক্লাসে ভর্তি করেন মা। হায়দরাবাদে স্কুলে পড়ার সময় কুচিপুরীও শিখেছিলেন।
যদিও যতই বড় হচ্ছিলেন অনুষা, ততই সিনেমার নাচের প্রতিই ঝুঁকছিলেন তিনি। পরে তাঁর পরিবার হায়দরাবাদ থেকে চেন্নাইতে চলে যান। সেখানে গিয়ে পাশ্চাত্য নাচের ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। যদিও ফি বেশি থাকায় ক্লাস ছেড়ে দেন। অনুষা জানান, মূলত টিভি দেখেই শিখেছিলেন নাচ।
এর পর কলেজে পরার সময় লাতিন আমেরিকার নাচও শিখেছিলেন। ক্রমে একটি তেলগু রিয়েলিটি শোয়ে অংশ নেন। এর বেশ কিছু ছবিতে সহকারী কোরিওগ্রাফার হিসেবে কাজ করেন। সমাজমাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। যদিও তিনি জানিয়েছেন, মুক্তির স্বাদ তিনি খুঁজে পেয়েছেন পোল ডান্সেই। পোলে উঠলে ঠিক কী মনে হয় নিজেকে? অনুষার কথায়, ‘‘মুক্ত, ঠিক যেন একটা বাচ্চা।’’