অক্ষয় কুমার অভিনীত ‘প্যাডম্যান’ ছবির কথা মনে পড়ে? ২০১৮ সালে আর বালকির পরিচালনায় এই সিনেমা বক্স অফিসে ঝড় তুলেছিল। ছবির চিত্রনাট্য এবং অক্ষয়ের অভিনয়ের প্রশংসা তখন দর্শকের মুখে মুখে। অরুণাচলম মুরুগানন্থমের জীবনের উপর তৈরি হয়েছিল এই ছবিটি। নিজের নামের চেয়ে ‘প্যাডম্যান’ হিসাবেই বেশি পরিচিত তিনি। অরুণাচলমের মতো এ দেশে রয়েছেন আরও এক জন। তিনি অনুরাগ বোহরা। বেশি পরিচিত পাশাপাশি ‘প্যাডওয়ালা’ নামে।
গোয়ালিয়র থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে মানেপুরা গ্রামের ভিন্ড এলাকার বাসিন্দা অনুরাগ। এই প্রত্যন্ত গ্রাম বহু বছর লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও এখন ‘প্যাডওয়ালা’ অনুরাগের জন্যই পরিচিতি পেয়েছে ভিন্ড এলাকা। স্যানিটারি প্যাড তৈরির মেশিন এবং স্যানিটারি প্যাড তৈরি করে বিক্রি করে তাঁর সংস্থা।
ইনদওরে দু’বছরের জন্য ফ্যাশন ডিজ়াইনিং নিয়ে ডিপ্লোমা করেছিলেন অনুরাগ। তার পর কাজের সন্ধানে মুম্বই পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। স্বপ্নপূরণের আশায় মুম্বই গেলেও কোথাও চাকরি পাচ্ছিলেন না । অগত্যা খালি হাতে নিজের গ্রামে ফিরে আসতে হয় তাঁকে।
চাকরি না পেয়ে আবার বাড়ি ফিরে এসেছেন দেখে অনুরাগকে নিয়ে গ্রামবাসীরা বাঁকা মন্তব্য করতে পিছপা হননি। তাঁকে উদ্দেশ করে অনেকে বলেছিলেন, ‘‘শাহরুখ খান হতে গিয়েছিল আর কী হয়ে ফিরল!’’ অনুরাগের ভাই ভিরাগ সেই সময় ভোপালে এমটেক করছিলেন।
২০১২ সালে অনুরাগ এবং ভিরাগ জয়পুরে একটি ‘কলেজ ট্রেড ফেয়ার’-এ গিয়েছিলেন। ব্যবসার নতুন পরিকল্পনা পাওয়া যায় কি না সেই কারণেই জয়পুরে গিয়েছিলেন তাঁরা। সৌরপ্যানেল কী ভাবে লাগানো হয় তা শিখলেও দুই ভাইয়ের নজর পড়ে অন্য দিকে। এক প্রান্তে স্যানিটারি প্যাড তৈরি করার যন্ত্র নিয়ে বসেছিলেন এক জন মহিলা। ওই যন্ত্রটি কী ভাবে ব্যবহার করতে হয় তা দুই ভাইকে দেখান তিনি।
মহিলার চোখেমুখে ছিল হতাশা। তিনি অনুরাগ এবং ভিরাগকে জানালেন যে এই যন্ত্রের মাধ্যমে প্যাড তৈরি করা যায় ঠিকই, কিন্তু তার আকার-আকৃতি ভাল হয় না। তখন দুই ভাইয়ের মাথায় নিজেদের ব্যবসার পরিকল্পনা আসে। ভোপালে ফিরে আসেন অনুরাগ এবং ভিরাগ।
গ্রামাঞ্চলের মহিলারা ঋতুস্রাবের সময় প্যাডের পরিবর্তে কাপড় ব্যবহার করেন। প্যাডের সঙ্গে তাঁদের পরিচিতি কম। আবার দাম বেশি হওয়ার কারণে অনেকে তা কিনতেও চান না। অনুরাগ এবং ভিরাগ গ্রামের মহিলাদের সঙ্গে যখন এই বিষয়ে কথা বলতে যেতেন, তখন বেশির ভাগ মহিলা কথাই বলতেন না।
তবুও গ্রামের মহিলাদের প্যাড পরার উপকারিতা বোঝাতে পিছপা হননি অনুরাগ এবং ভিরাগ। গ্রামের চারদিকে কোনও ওষুধের দোকান ছিল না যেখানে প্যাড কিনতে পাওয়া যায়। এই সুযোগ নিয়েই দুই ভাই মিলে প্যাড তৈরির কাঁচামাল কিনতে শুরু করেন।
২৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন অনুরাগ এবং ভিরাগ। কিন্তু কাঁচামাল কিনতে গিয়ে সমস্যার মুখে পড়েন তাঁরা। প্যাডের পিছনে পাতলা কাগজের আবরণ প্রয়োজন। কিন্তু কোথাও সেই ধরনের উপকরণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না তাঁরা।
এক দিন দু’জনে একটি বিয়েবাড়িতে খেতে গিয়েছিলেন। সেখানে এক খাবার পরিবেশনকারীর হাতে একটি ‘পেপার রোল’ দেখতে পান তাঁরা। এই ধরনের কাগজই তো প্রয়োজন তাঁদের! বিয়েবাড়ি থেকে খোঁজ নিয়ে ওই পেপার রোল অর্ডার দেন অনুরাগ। তার পর ভোপালে প্যাড তৈরির যন্ত্র তৈরি করতে শুরু করেন তাঁরা।
২০১৫-১৬ সাল নাগাদ অনুরাগ এবং ভিরাগ নিজেদের একটি সংস্থাও খুলে ফেলেন। প্যাড তৈরির যন্ত্রের সঙ্গে প্যাডও তৈরি করতেন দু’জনে। কিন্তু শুরুতে তাঁদের ব্যবসা লাভের মুখ দেখতে পায়নি। পরে তাঁদের সঙ্গে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হাত মেলায়।
গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনুরাগ এবং ভিরাগের সংস্থার নাম হতে থাকে। কেনিয়া, ইউরোপ, নেপালেও তাঁদের নাম ছড়িয়ে পড়ে।
২০২০ সালে ভিরাগের স্ত্রী পলক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় গ্রামাঞ্চলের মহিলারা যেন ভরসা পান। পলক গ্রামের প্রতিটি ঘরে গিয়ে মহিলাদের সঙ্গে কথা বলেন। বর্তমানে প্রতি মাসে ৫টি করে প্যাড তৈরির যন্ত্র এবং ৬০ থেকে ৭০ হাজার প্যাডের প্যাকেট বিক্রি হয় তাঁদের।
আগে গ্রামের যে মহিলারা প্যাড কিনতে চাইতেন না, তাঁরাও অনুরাগের সংস্থার তৈরি প্যাড ব্যবহার করতে শুরু করেন। ওই মহিলাদের বক্তব্য, নামী ব্র্যান্ডের প্যাডের এত দাম যে, তা কিনতে গেলে তাঁদের দিনে এক বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। কিন্তু অনুরাগ সে জিনিস এত কম দামে বিক্রি করেন যে, গ্রামের মহিলারা ঋতুস্রাব হলে ওই প্যাডই ব্যবহার করেন।
মাত্র ২৫ হাজার টাকা দিয়ে যে ব্যবসার শুরু, বর্তমানে তার বার্ষিক আয় আড়াই কোটি টাকা। এক সময়ের বেকার অনুরাগ এখন সকলের কাছে ‘প্যাডওয়ালা’।