দক্ষিণ চিন সাগরের আধিপত্য নিয়ে ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়ার সঙ্গে চিনের বিরোধ নতুন নয়। সেই কবে থেকে দেশগুলির মধ্যে দক্ষিণ চিন সাগরের অধিকার নিয়ে লড়াই চলছে। সম্প্রতি দক্ষিণ চিন সাগর নিয়ে উত্তেজনা চরমে উঠেছে। সেই বিরোধে এ বার নিজেদের জড়িয়ে ফেলল আমেরিকা।
জাপান এবং ফিলিপিন্সের সঙ্গে আমেরিকার ত্রিপাক্ষিক সম্পর্ক মজবুত করতে হোয়াইট হাউস একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। সেই সম্মলেনে বক্তৃতা করতে গিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ‘‘আমরা এক হয়ে দাঁড়ালে সবার জন্য একটি ভাল ভবিষ্যৎ গড়তে সক্ষম হব।’’
হোয়াইট হাউসের সম্মেলনে দক্ষিণ চিন সাগরের বিরোধ নিয়ে উদ্বেগপ্রকাশ করেন বাইডেন। পাশাপাশি, ফিলিপিন্সকে প্রতিরক্ষা বিষয়ে সাহায্য করা হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। বাইডেন বলেন, ‘‘দক্ষিণ চিন সাগরে ফিলিপিন্সের বিমান, জাহাজ বা সশস্ত্র বাহিনীর উপর যদি কোনও আক্রমণ হয়, তবে আমাদের পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি অনুযায়ী সাহায্য করা হবে।’’
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সঙ্গে হোয়াইট হাউসে সম্প্রতি বৈঠক করেছিলেন বাইডেন। সেই বৈঠকে দু’দেশের প্রধানের মধ্যে একাধিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। ইউক্রেনকে সাহায্য করা, প্রযুক্তির উন্নয়ন, মহাকাশ নিয়ে একযোগে কাজ করার মতো বিষয়গুলি নিয়ে কথা হয়েছে বাইডেন এবং কিশিদার মধ্যে।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল উত্তর-পূর্ব এশিয়ার পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে দু’দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। অনেকেই মনে করছেন, আমেরিকা এবং জাপানের মধ্যে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেলে চিনের উপর চাপ বৃদ্ধি হতে পারে।
শুধু জাপান নয়, ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়রের সঙ্গে বাইডেনের বৈঠকও আলোড়ন ফেলেছে বিশ্ব কূটনৈতিক মহলে। দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের আধিপত্য খর্ব করতেই ফিলিপিন্সকে সাহায্য করতে চায় আমেরিকা, এমনটা মনে করছেন অনেকেই।
জাপান এবং ফিলিপিন্স উভয়ের সঙ্গেই চিনের আঞ্চলিক বিরোধ রয়েছে। অতীতে পূর্ব চিন সাগরের সেনকুকা দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে ঝামেলা ছিল। পরে সেই বিবাদ অগ্রসর হয় দক্ষিণ চিন সাগরের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের দিকে।
চিনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দক্ষিণ চিন সাগরের পাশেই রয়েছে ফিলিপিন্স। ছোট ছোট কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দ্বীপরাষ্ট্র। ফিলিপিন্স এবং চিনের বিরোধের অন্যতম কারণ ঘটেছিল সেকেন্ড থমাস শোলে দ্বীপকে কেন্দ্র করে। ফিলিপাইন দ্বীপের পালাওয়ান থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই সেকেন্ড থমাস শোলে। ১৯৯৯ সালে ফিলিপিন্স নৌবাহিনী সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটি জাহাজ ফেলে রেখে তাতে অবস্থান করছিল। আবার ২০১২ সালে ফিলিপিন্সের কাছ থেকে স্কারবোরো শোলে দ্বীপের দখল নিয়েছিল চিন।
অন্য দিকে, দক্ষিণ চিন সাগরে একাধিপত্যের দাবি থেকে এক ইঞ্চিও সরতে রাজি নয় বেজিং। সম্প্রতি দক্ষিণ চিন সাগরের উপর থাকা ফিলিপিন্সের কয়েকটি জাহাজের উপর হামলার অভিযোগ ওঠে চিনের বিরুদ্ধে। চিনের ছোড়া জলকামানের আঘাতে তাদের দেশের কয়েক জন নাবিক আহত হয়েছেন বলে দাবি করে ফিলিপিন্স।
দক্ষিণ চিন সাগরে জাপানের কোনও সরাসরি দাবি নেই। তবে তারা ভিয়েতনাম এবং ফিলিপিন্সের দাবির সমর্থনে নিজেদের জাহাজ এবং সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করে। একই পথে হেঁটেছে আমেরিকাও। সীমানা বিরোধে কোনও পক্ষে নেই বলেই দাবি করে তারা। তবে ফিলিপিন্সকে সাহায্য করতে সর্বদাই এগিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে হোয়াইট হাউসকে।
দক্ষিণ চিন সাগর নিয়ে বিভিন্ন দেশের এত আগ্রহ কেন? রাষ্ট্রপুঞ্জ সূত্রে খবর, বাণিজ্যের জন্য দক্ষিণ চিন সাগর খুবই গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ। ২০১৬ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের মোট বাণিজ্যের প্রায় ২১ শতাংশই এই সমুদ্রপথ দিয়ে পরিবহণ করা হয়। বিগত কয়েক বছরে সেই পরিমাণ আরও বেড়েছে বলেও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে।
এ ছাড়াও এই সাগর মৎস্যজীবীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মাছ ধরার নৌকাই দক্ষিণ চিন সাগরের উপর দিয়ে যাতায়াত করে। লাখ লাখ মৎস্যজীবীর জীবিকা নির্ভর করে এই সাগরের উপর।
দক্ষিণ চিন সাগরের সবচেয়ে বড় অংশটি চিন নিজেদের বলে দাবি করে। ১৯৪৭ সালে চিন একটি মানচিত্র প্রকাশ করেছিল। সেই মানচিত্রে মোট ন’টি ড্যাশ লাইন ব্যবহার করে দক্ষিণ চিন সাগরে নিজেদের অধিকার চিহ্নিত করেছিল বেজিং।
চিনের এই দাবি মানতে নারাজ ফিলিপিন্স, ভিয়েতনামের মতো দেশগুলি। ভিয়েতনামের বক্তব্য, চল্লিশের দশকের আগে চিন কখনই দক্ষিণ চিন সাগরের উপর এ হেন দাবি জানায়নি।
চিনের দাবি কখনই ন্যায্য নয় বলে দাবি করে ভিয়েতনাম। স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে শুরু হয় দু’দেশের মধ্যে বিরোধ। পরে ফিলিপিন্স ওই অঞ্চলের উপর নিজেদের দাবি জানায়। এ ছাড়া, স্কারবোরো শোলের উপর অধিকার নিয়েও চিনের সঙ্গে ফিলিপিন্সের বিরোধ রয়েছে।