কোনও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা কত দিন ধরে চলতে পারে? ১০ বছর, ২০ বছর, ৩০ বছর? কিন্তু পৃথিবীতে এমন এক পরীক্ষা করা হচ্ছে, যা চলছে প্রায় ১০০ বছর ধরে।
প্রায় এক শতক ধরে চলা এই পরীক্ষার নাম ‘পিচ ড্রপ এক্সপেরিমেন্ট’। যে পিচ দিয়ে রাস্তা তৈরি হয়, তা দিয়েই এই পরীক্ষা চলছে বলে পরীক্ষাটির এ রকম নাম দেওয়া হয়েছিল।
পিচ ড্রপ পরীক্ষা হল একটি দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষা, যা বহু বছর ধরে পিচের প্রবাহ পরিমাপ করে।
পিচ একটি উচ্চ ঘনত্বের তরল, যা সাধারণত বিটুমিন কয়লা থেকে তৈরি হয়। এই কয়লাজাত পদার্থ ‘অ্যাসফল্ট’ নামেও পরিচিত। ঘরের তাপমাত্রায়, পিচ খুব মন্থর গতিতে প্রবাহিত হয়।
পিচ ড্রপ পরীক্ষাটি ১৯২৭ সালে শুরু করেন টমাস পার্নেল। অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনের কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হওয়া এই পরীক্ষা এখনও চলছে।
পার্নেল কিছু পিচকে গলিয়ে তরল করেন। পরে তিনি সেই তরল পিচ একটি মুখবন্ধ ফানেলে ঢেলে দেন। একটি বড় বেলজারের মধ্যে বিকারের উপর সেই ফানেলটি রেখে দেন তিনি।
১৯৩০ সালে পার্নেল ফানেলটির নীচের সরু অংশ কেটে প্রথম পিচের ফোঁটা তৈরির জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। পার্নেল-সহ এই পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত বাকিরা দেখেন, ওই তরল পিচ থেকে এক ফোঁটা পিচ তৈরি হতে সময় লাগে ৭ থেকে ১৩ বছর।
১৯৬১ সাল থেকে পিচ ড্রপ পরীক্ষার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন জন মেইনস্টোন। তবে তিনি এখনও পর্যন্ত এক বারও পিচের ফোঁটা পড়তে দেখেননি। এক বার নাকি তিনি জল খেতে পরীক্ষাগারের বাইরে বেরিয়েছিলেন। সেই সময় ওই পিচের ফোঁটা পড়ে যায়। আর তা নিয়ে মেইনস্টোনের আফসোসের অন্ত ছিল না।
১৯৩৮ সালে পিচ ড্রপ পরীক্ষার প্রথম পিচের ফোঁটা তৈরি হয়। এর পর ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত মাত্র পাঁচটি পিচের ফোঁটা তৈরি হয়েছিল।
সপ্তম ফোঁটাটি ১৯৮৮ সালের ৩ জুলাই আনুমানিক পৌনে ৫টা নাগাদ পাত্রে পড়েছিল। পরীক্ষাটি ব্রিসবেনের ওয়ার্ল্ড এক্সপো ৮৮-তে প্রদর্শন করা হয়েছিল। তবে কেউই সেই পিচের ফোঁটা পড়তে দেখেননি।
পিচ ড্রপ পরীক্ষায় অষ্টম ফোঁটা ২০০০ সালের ২৮ নভেম্বর তৈরি হয়েছিল। নবম ফোঁটাটি ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিলে পড়তে দেখা গিয়েছিল।
গিনেসের বুকেও নাম তুলেছে পিচ ড্রপ পরীক্ষা। গিনেস ওয়ার্ল্ড অনুযায়ী, এটিই ‘বিশ্বের দীর্ঘতম সময় ধরে চলা পরীক্ষা’। মনে করা হয়, ফানেলের উপর যা পিচ আছে, তাতে অন্তত আরও ১০০ বছর ধরে এই পরীক্ষা চলতে পারে।
পরীক্ষাটি কোনও বিশেষ বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থায় করা হয় না। তাই তাপমাত্রার রকমফেরে পিচের ফোঁটা তৈরির কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। তবে সপ্তম ফোঁটা তৈরির পরে পরীক্ষাগারে একটি শীতাতপ যন্ত্র লাগানো হয়েছিল।
গড় তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে বর্তমানে পিচের একটি ফোঁটা তৈরি হতে আরও বেশি সময় লাগে। আগে যেখানে ৮-৯ বছর সময় লাগত, এখন সেখানে ১২-১৩ বছর সময় লাগে।
বিশ্বের অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন, পিচ ড্রপ পরীক্ষা সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু না। ২০০৫ সালের অক্টোবরে পার্নেল এবং মেইনস্টোনকে এই পরীক্ষার জন্য ইগনোবেল পুরস্কার (নোবেল পুরস্কারের ব্যঙ্গ করে দেওয়া একটি পুরস্কার) দেওয়া হয়।
পার্নেল মারা গিয়েছেন ১৯৪৮ সালে। তাই ইগনোবেল পুরস্কার নিয়েছিলেন মেইনস্টোন।
বর্তমানে পরীক্ষাটি একটি ক্যামেরার সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করা হয়। তবে প্রযুক্তিগত সমস্যার জন্য পিচের অষ্টম ফোঁটা তৈরির সময় তা রেকর্ড করা যায়নি।
বর্তমানে পিচ ড্রপ পরীক্ষাটি কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট লুসিয়া ক্যাম্পাসের স্কুল অফ ম্যাথমেটিক্স অ্যান্ড ফিজ়িক্সের পার্নেল ভবনের দোতলায় প্রদর্শনীর জন্য রাখা রয়েছে।
প্রতি বছর কয়েক লক্ষ মানুষ ইন্টারনেটে সেই পরীক্ষার লাইভ স্ট্রিম দেখে। সেই পরীক্ষা চাক্ষুষ করতেও পরীক্ষাগারে যান অনেকে।
হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৩ সালের ২৩ অগস্ট মারা গিয়েছেন মেইনস্টোনও। বর্তমানে পিচ ড্রপ পরীক্ষার দায়িত্বে রয়েছেন অ্যান্ড্রু হোয়াইট।
তবে শুধু অস্ট্রেলিয়া নয়, আয়ারল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ডেও এই একই পরীক্ষা চলছে বহু বছর ধরে। তবে অস্ট্রেলিয়া বাদে বাকি দুই দেশের পরীক্ষার ‘বয়স’ এত বেশি নয়।