ফোর্ট নক্স। লুইভিলের দক্ষিণে এবং এলিজাবেথটাউনের উত্তরে কেন্টাকিতে রয়েছে আমেরিকার সেনাবাহিনীর এই দফতর। ১৯১৮ সালে আমেরিকার অস্থায়ী সেনা ঘাঁটি হিসাবে কেন্টাকিতে ক্যাম্প নক্স তৈরি করা হয়েছিল। ওই ঘাঁটির নামকরণ করা হয়েছিল আমেরিকার সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল হেনরি নক্সের নামে। পরে, ১৯৩২ সালে ক্যাম্প নক্সকে একটি স্থায়ী সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করা হয়।
বাইরে থেকে দেখলে সাধারণ সামরিক ঘাঁটি মনে হলেও এই সামরিক ঘাঁটির বুকে লুকিয়ে রয়েছে আমেরিকার বহু রহস্য।
ফোর্ট নক্সেই রয়েছে আমেরিকার সরকারি কোষাগার। মনে করা হয় এর মধ্যে রয়েছে সে দেশের সোনার ভান্ডার। সেই কোষাগারের দায়িত্বে রয়েছে আমেরিকার সম্পত্তি বিষয়ক মন্ত্রক। যদিও ফোর্ট নক্সের সেই ‘বিশাল সোনার ভান্ডারে’ কত সোনা রয়েছে, সে নিয়ে আমেরিকা এখন আর টুঁ শব্দ করে না।
যাঁরা জেমস বন্ডের ছবি ‘গোল্ডফিঙ্গার’ দেখেছেন, তাঁরা ফোর্ট নক্সের সঙ্গে পরিচিত। আমেরিকার এই তোষাখানাকে ঘিরে বহু জল্পনা রয়েছে।
মনে করা হয়, ফোর্ট নক্সের বোমা প্রতিরোধী গ্রানাইটের দেওয়ালের ও পারে লক্ষ লক্ষ কেজি সোনা রয়েছে। আবার অনেকের মতে, এক সময় ফোর্ট নক্সের তোষাখানায় টন টন সোনা উপস্থিত থাকলেও বর্তমানে তা আর সেখানে নেই।
ফোর্ট নক্স যে অনেক কিছু গোপন রেখেছে, তা মনে হতে পারে সেই সামরিক ঘাঁটির আঁটসাঁট নিরাপত্তা দেখে। নক্স দুর্গের পুরো চত্বর স্টিলের বেড়া দিয়ে ঘেরা। পদে পদে রয়েছে বৈদ্যুতিন অ্যালার্ম। প্রতিটি গ্রানাইটের দেওয়াল ইস্পাতের পাত দিয়ে মোড়া এবং বোমা প্রতিরোধী।
বিশ্বযুদ্ধের আবহে আমেরিকার সোনা রক্ষার জন্য ১৯৩৫ সালে ফোর্ট নক্সের ভিতরে একটি কোষাগার তৈরি করা হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে বেশির ভাগ দেশের কাছেই ফোর্ট নক্স নিয়ে বিশেষ কোনও তথ্য ছিল না।
ফোর্ট নক্সের চারপাশে অনেকগুলি পাহাড় থাকার কারণেও এই জায়গাটি নিরাপদ বলে মনে করেছিলেন আমেরিকার তৎকালীন শাসকরা। ১৯৩৭ সালে টন টন সোনা কড়া নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ট্রেনে করে ফোর্ট নক্সে পাঠানো হয়েছিল।
আমেরিকার সরকার বলছে, ফোর্ট নক্সে বর্তমানে ১৪.৭৩ কোটি আউন্স সোনা রয়েছে। সরকারি হিসাবের খাতায় লেখা অনুযায়ী যার মূল্য ৬২২ কোটি ডলার। কিন্তু এই হিসাবের খাতা ১৯৭৩ সালের। সেই সময়ের থেকে এখন সোনার দাম অনেক বেড়়েছে।
মোটামুটি ভাবে হিসাব করে দেখলে দেখা যাবে, বর্তমানে ওই সোনার দাম ২৭,৪০০ কোটি ডলার! কিন্তু সেই সোনা এখনও কোষাগারে রয়েছে কি না, তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন।
তবে অনেক ‘কন্সপিরেসি থিওরিস্টের’ মতে, ফোর্ট নক্সের সোনার বারগুলি আসলে সোনার মতো দেখতে টাংস্টেনের ইট ছিল। টাকার প্রয়োজনে আসল সোনা সরকার গোপনে বিক্রি করে দিয়েছিল।
আবার অনেকের মতে, দেশে সোনার দাম কমানোর জন্য এবং ডলারের দাম বৃদ্ধি করতে ওই সোনা চুরি করা হয়েছিল। ‘গোল্ড অ্যান্টি-ট্রাস্ট অ্যাকশন কমিটি’ নামে পরিচিত একটি ‘কন্সপিরেসি থিওরি’র গোষ্ঠীর দাবি, ওই সোনা দিয়েই অনেক বিদেশি ব্যাঙ্কের সঙ্গে চুক্তি করেছিল আমেরিকা। যদিও এ সব তথ্য মানতে রাজি নয় ওয়াশিংটন।
তবে ফোর্ট নক্স নিয়ে আরও অনেক রহস্য এবং জল্পনা রয়েছে। মনে করা হয়, ফোর্ট নক্সের কোষাগার শুধু সোনা সঞ্চয় করার জন্য তৈরি হয়নি। আরও অনেক মূল্যবান নথি এবং জিনিস লুকোনো রয়েছে সেখানে।
মনে করা হয়, ফোর্ট নক্সের অন্যান্য অমূল্য সম্পত্তির মধ্যে এক সময় ছিল আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার নথি, অধিকারের বিল এবং আমেরিকার সংবিধানের মূল খসড়া।
পার্ল হারবারে জাপানি বায়ুসেনার হামলার দু’সপ্তাহ পর ওয়াশিংটনে হামলা চালানো হতে পারে ভেবে সেই নথিগুলো ফোর্ট নক্সের কোষাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে নথিগুলি আবার ওয়াশিংটনে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।
এক সময় ফোর্ট নক্সের কোষাগারে টন টন ব্যথা উপশমকারী মরফিন সালফেট রাখা হয়েছিল। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে আমেরিকা আশঙ্কা করেছিল যে, কলকাঠি নেড়ে তাদের দেশে আফিমের আমদানি বন্ধ করে দিতে পারে শত্রুপক্ষ রাশিয়া। আর সেই জন্য আগে থেকে প্রচুর পরিমাণ মরফিন সালফেট ফোর্ট নক্সে মজুদ করে রেখেছিল তৎকালীন সরকার।
এখনও পর্যন্ত মাত্র কয়েক জনই ফোর্ট নক্সের ভিতরে প্রবেশ করেছে। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি ফোর্ট নক্সের কোষাগারে পা রেখেছিলেন। ১৯৪৩ সালে ব্যক্তিগত ভাবে তিনি মজুদ থাকা সোনা পরিদর্শনের জন্য সেখানে গিয়েছিলেন।
এর পর ২০১৭ সালে আমেরিকার ‘ট্রেজারি সেক্রেটারি’ স্টিভ মুনচিন বেশ কয়েক জন নির্বাচিত সরকারি আধিকারিকের সঙ্গে ফোর্ট নক্সে গিয়েছিলেন। সব জল্পনা উড়িয়ে তিনি জানিয়েছিলেন যে, ফোর্ট নক্সের কোষাগারে সব সোনা এখনও সুরক্ষিত।