ফুটবল বিশ্বকাপের শুরু ১৯৩০ সালে। সেই বারই প্রথম ফাইনালে ওঠা। তার পরের ফাইনাল খেলার জন্য নীল-সাদাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল ৪৮ বছর।
সাল ১৯৭৮। প্রথম বার বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় আর্জেন্টিনা। ড্যানিয়েল পাসারেল্লার অধিনায়কত্বে সেই স্বপ্নপূরণের কারিগর ছিলেন মারিও কেম্পেস, লিওপোলদো লুকেরা।
তত দিনে অবশ্য দিয়েগো মারাদোনাকে দেখে ফেলেছিল গোটা বিশ্ব। কিন্তু ’৭৮ এর বিশ্বকাপে জায়গা হয়নি মারাদোনার। যা নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি।
১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে দলে মারাদোনার জায়গা হলেও বিজয়রথ থমকে গিয়েছিল দ্বিতীয় পর্বেই।
এরপরই সরে দাঁড়ান কোচ সিজ়ার লুই মেনত্তি।দায়িত্ব নেন কার্লোস বিলার্দো। আর্জেন্টেনীয় ফুটবলের ইতিহাসে শুরু হয় মারাদোনা যুগ।
১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জেতে মারাদোনার আর্জেন্টিনা। প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন তিনি।
ছিয়াশির বিশ্বকাপে মারাদোনার হাত ধরে যে যাত্রার সূত্রপাত, তা স্থায়ী হয়নি বেশি দিন। ১৯৯০ সালের ফাইনালে নীল-সাদারা উঠেছিল বটে, কিন্তু সেরার শিরোপা জোটেনি।
তার পরেই কার্যত পতনের সূত্রপাত। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে ড্রাগ নেওয়ার অভিযোগে ফিফার কোপের মুখে পড়তে হয় মারাদোনাকে। রাজপুত্রহীন সেই দল প্রতিযোগিতায় বেশি দূর এগোতেও পারেনি। ঘরে ফিরে আসতে হয় প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে।
১৯৯৮ সালে আর্জেন্টিনা দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ড্যানিয়েল প্যাসারেলা। সেই প্রতিযোগিতাতেও কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে ফিরে আসতে হয়েছে তাদের।
২০০২ সালের বিশ্বকাপে অন্যতম দাবিদার হিসাবে অংশ নিলেও গ্রুপ পর্যায়ে বিদায় নিতে হয় আর্জেন্টিনাকে।
আর্জেন্টিনার ফুটবলের ইতিহাসে লিয়োনেল মেসি যুগের শুরু ঠিক তার পরেই।
সাল ২০০৬। বিশ্বকাপের মঞ্চে প্রথম বার পা রাখেন মারাদোনার উত্তরসূরি মেসি। হোসে পেকারম্যানের আর্জেন্টিনার হয়ে সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রোর বিরুদ্ধে পরিবর্ত হয়ে খেলতে নেমেছিলেন। প্রথম ম্যাচে গোলও করেছিলেন। কিন্তু সে বারের বিশ্বকাপে পরিবর্ত হয়েই খেলতে হয়েছিল তাঁকে।
কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়ে মেসিদের।
২০১০ সালের বিশ্বকাপের আগে অবশ্য নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন মেসি। সে বার আর্জেন্টিনার দায়িত্বে ছিলেন তাঁরই পূর্বসূরি দিয়েগো মারাদোনা। মেসিই ছিলেন তাঁর দলের প্রধান ফুটবলার। কিন্তু সে বারও কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানি-কাঁটায় স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল মেসিদের।
২০১৪ সালের বিশ্বকাপে ২৮ বছর পর ফাইনালে উঠেছিল মেসির আর্জেন্টিনা। ওই ১০ নম্বর জার্সিকে কেন্দ্রে রেখে দল তৈরি করেছিলেন কোচ আলেহান্দ্রো সাবেয়া। সে বার গ্রুপ পর্যায়ে ৪টি গোল করেছিলেন মেসি।
কিন্তু ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ের গোলে জার্মানির কাছে হারতে হয়েছিল মেসিদের। বহুপ্রতীক্ষিত ট্রফির কাছে গিয়ে ব্যর্থ হতে হয়েছিল আর্জেন্টিনাকে।
২০১৮ সালেও ব্যর্থ হয়েছিল মেসি বাহিনী। কোনও রকমে গ্রুপ পর্ব টপকানোর পরে শেষ ষোলোর লড়াইয়ে ফ্রান্সের সামনে পড়েছিলেন তাঁরা। কিলিয়ান এমবাপে ঝড়ে তছনছ হয়ে গিয়েছিল আর্জেন্টিনার রক্ষণ।
সাতটি বালঁ দ্যর। অলিম্পিক্সে সোনার পদক। বার্সেলোনার হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়। ক্লাব বিশ্বকাপে সেরা হওয়ার ট্রফি... ফুটবল জীবনে সবই পেয়েছেন মেসি। মারাদোনার উত্তরসূরি হিসাবে শুধুই অধরা থেকে গিয়েছিল আর একটি বিশ্বকাপ।
২০১৪ থেকে ২০১৯— এই পাঁচ বছর আর্জেন্টিনার ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন সময় বলেই অনেকে মনে করেন। দু'-দু'বার কোপা আমেরিকার ফাইনালে উঠেও হারতে হয় দলকে। জাতীয় দল থেকে সরে দাঁড়ান মেসিও।
শাপমোচন ঘটে সেই মারাকানায়, যেখানে ২০১৪ সালে স্বপ্নের দরজায় পৌঁছেও বিশ্বকাপ ছুঁতে পারেনি আর্জেন্টিনা। ২৮ বছর পর ২০২১ সালে কোপা আমেরিকায় জয় দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, রবিবার কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে তা সম্পূর্ণ হল।
৩৬ বছর পর আবার বিশ্বকাপ জিতল আর্জেন্টিনা। সেরার শিরোপা এনে দিলেন সেই মারাদোনারই উত্তরসূরি লিয়োনেল মেসি। নীল-সাদা জার্সি গায়ে তাঁর শেষ ম্যাচে।
বছর দু'য়েক আগেই প্রয়াত হয়েছেন মারাদোনা। মেসিদের স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখা তিনি দেখে যেতে পারলেন না। তবে রবিবার গ্যালারিতে আধো অন্ধকারে বসে অতীত স্পর্শ করলেন আর্জেন্টিনীয়দের হাতে প্রথম বিশ্বকাপ তুলে দেওয়া সেই কেম্পেস।