দুগ্গাদুগ্গা

আসলে তিনি কে? বায়োডেটায় চোখ রেখে অবাক শংকরশারদোৎসবের প্রাক্কালে প্রবাসের পড়াশোনা করা ব্রাইট ছেলেমেয়েরা তাদের সিনিয়র আত্মীয়স্বজনদের কাছে নানা আব্দার জানায়। বোঝা যায়, প্রতি বছর লোকমুখে গডেস দুর্গা সম্বন্ধে যে সব খবরাখবর ছড়ায়, তাতে নতুন যুগের নাগরিকদের মন ভরে না। তাদের কেউ কেউ জানতে চায়, দুর্গার ‘হুজ হু’ নামে কোনও হ্যান্ডবুক এখনও কেন প্রকাশিত হচ্ছে না? উত্তরে কী বলা যাবে? কোনও রকমে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলা, আরও একটু বড় হয়ে অক্সফোর্ড কিংবা কেমব্রিজ থেকে ডিগ্রি নিয়ে তোমাদেরই এই জরুরি কাজটা করতে হবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

অলংকরণ: দেবাশীষ দেব

শারদোৎসবের প্রাক্কালে প্রবাসের পড়াশোনা করা ব্রাইট ছেলেমেয়েরা তাদের সিনিয়র আত্মীয়স্বজনদের কাছে নানা আব্দার জানায়।
বোঝা যায়, প্রতি বছর লোকমুখে গডেস দুর্গা সম্বন্ধে যে সব খবরাখবর ছড়ায়, তাতে নতুন যুগের নাগরিকদের মন ভরে না।
তাদের কেউ কেউ জানতে চায়, দুর্গার ‘হুজ হু’ নামে কোনও হ্যান্ডবুক এখনও কেন প্রকাশিত হচ্ছে না?
উত্তরে কী বলা যাবে?
কোনও রকমে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলা, আরও একটু বড় হয়ে অক্সফোর্ড কিংবা কেমব্রিজ থেকে ডিগ্রি নিয়ে তোমাদেরই এই জরুরি কাজটা করতে হবে।
বিলেত থেকে এই হ্যান্ডবুক প্রকাশিত হলে, এদেশের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ডেলি-পেপারে তার ফুলপেজ রিভিউ অবশ্যই বেরবে এবং তা পড়ে আমরা স্পেশাল আনন্দ পাব।
আমার বিশেষ পরিচিতা এক নবমবর্ষীয়া বালিকার কৌতূহল, ‘ডেভি’ দুর্গার কোনও ‘সিভি’ নেই কেন?
এই বস্তুটি কি তা মিষ্টি ভাবে জানতে চায়, তার নিবেদন— দাদা, বায়োডাটা, অর্থাৎ লাইফের ইম্পর্ট্যান্ট ইনফরমেশনগুলো না ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সবার জন্য রেডি রাখতে হয়!
এই বালিকাকে আমার বিনীত নিবেদন, আমাদের সবার প্যান নম্বর নেই।
এর অর্থ হল, পার্মানেন্ট অ্যাকাউন্ট নম্বর, নশ্বর এই ভারতীয় জীবনে একমাত্র অবিনশ্বর সংখ্যাতিলক না থাকলে আয়কর বিভাগ বড্ড মনোকষ্ট পায়।
কমবয়েসি মেয়েরা আজকাল বেশ হুঁশিয়ার, তাদের প্রশ্ন, ‘হোয়াট অ্যাবাউট ‘আধার’?

Advertisement

না, এই ব্যাপারেও আঁধারে থাকা উচিত নয়, তবে মা দুগ্গাই তো সমস্ত সৃষ্টির আধার, ওনারশিপ প্রমাণে আধার কার্ডের প্রয়োজন নেই, যেমন বিশ্বজননীর ভোটার কার্ডও অপ্রয়োজনীয়।

এ বিষয়ে আর লেবু তেতো করলাম না, সস্নেহে বলি, রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের শ্রদ্ধেয়দেরও ভোটার তালিকায় নাম থাকে, কিন্তু সন্ন্যাসীরা হুড়মুড় করে কখনও ভোট দেন না।

Advertisement

আছেন অথচ নেই হলে, এ দেশে শ্রদ্ধেয় ও শ্রদ্ধেয়াদের সম্মান বেড়ে যায়, আমাদের মা দুর্গা সেই দলে।

তা হলে, আইনের চোখে মাদার দুর্গার স্টেটাস কী?

সেই কঠিন প্রশ্নের প্রিভিকাউন্সিলের সায়েবজজরা বহু বছর আগেই ঠিক করে গিয়েছেন, দেবদেবীদের আইনি অস্তিত্ব আছে। বিষয়সম্পত্তির অধীশ্বরীও হতে পারেন অনায়াসে। কিন্তু প্রত্যেক দেবীই পার্পিচুয়াল মাইনর— বাংলা করলে দাঁড়ায় এঁরা চিরবালিকা।

বেচাকেনা ভোগদখল যাঁর করায়ত্ত, তাঁর নাম সেবায়েত। আরও মন্তব্য স্বর্গমর্ত্যপাতালে এত নামডাক, কিন্তু অন্য অনেক দেবদেবীর তুলনায় পার্থিব সম্পদ তেমন কিছু নয়— কলকাতায় দুর্গাবাড়ির সংখ্যা কত? সেই তুলনায় কালীমন্দিরের বিষয়সম্পত্তির পরিমাণ যে কোনও ভক্তের মাথা ঘুরিয়ে দেবে!

ইংলিশ স্পিকিং ছেলেমেয়েরা কুইজের ভয় পায় না। প্যান নেই, আধার কার্ড নেই, পাসপোর্ট নেই, ভিসা নেই, কিন্তু প্লিজ বাপের নামটা ডিসক্লোজ করো, আমরা জানি তিনি গিরিরাজসূতা, হাজবেন্ডের নামটাও বহুল প্রচারিত, কারণ স্পাউস বা হাজবেন্ড ছাড়া তিনি বছরে একবারও বাপের বাড়ি ভিজিট করেন না। সঙ্গে থাকেন দুই পুত্র ও কন্যা যাঁরা দেবদেবী হিসেবে খুবই সিনিয়র।

জ্যেষ্ঠ পুত্রটি হায়ারারকি লিস্ট অফ প্রিসিডেন্সে এক নম্বর, ওঁ গণেশায় নমঃ না বললে বিশ্বচরাচরে কোনও পুজোই তো স্টার্ট করা যায় না।

এরপরেও তো জটিলতা!

মহিষাসুরের সঙ্গে যখন ফাটাফাটি লড়াই করলেন তখন শ্রীশ্রী চণ্ডীর বৈবাহিক স্টেটাস কী?

তখন তো তাঁর ছেলেমেয়েদের কোনও আইডেনটিটি বা খোঁজখবর তেমন পাওয়া যাচ্ছে না!

দেবতাদের তেজ থেকে জন্ম নিয়েই তো রণক্ষেত্রে ছুটলেন, মেটারিনিটির সুযোগ তো পেলেন না!

আরে বাপু, অত ইনক্যুইজিটিভ হয়ে লাভ নেই, তখন তো ত্রিভুবন রক্ষা ও মহিষবিনাশের জন্য শ্রীশ্রীচন্ডী।

নানা পর্বে এখন তাঁর নানা ভূমিকা, নানা নাম, নানা ধরনের কীর্তি। ধারাবাহিক ডিটেকটিভ ফিল্মের মতো প্রত্যেকটা পর্বে আলাদা আলাদা নাম।

শরৎকালে যে এপিসোডের জন্য মর্ত্যলোকে এত মাতামাতি, এটাকে বলতে পারো শ্রীশ্রী চণ্ডী, ওই নামের বইটার সার্কুলেশন বেড়ে যায় প্রচণ্ড, মায়ের অডিটব্যুরো অফ সার্কুলেশনও মাথায় হাত দিয়ে বসে!

বই ছাপা হয়, প্রচার হয়, কিন্তু পড়া হয় কি?

বচ্ছরকার দিনে ডিফিকাল্ট কোশ্চেনের মুখোমুখি হয়ে লাভ নেই। শ্রীশ্রীচণ্ডী পাঠের জন্য নানা ইনসেনটিভ নানা ভাবে দেওয়া হয়েছে কিন্তু ফলাফল জানবার উপায় নেই।

আসমুদ্র হিমাচল এই ভারতে দেবীদুর্গাকে নানা রূপে ও নানা নামে পূজা করা হয়ে থাকে।

সেই সব জটিল হিসেব নিকেশের মধ্যে প্রবেশ না করেও বলা যায় আমাদের বেঙ্গলে দশভূজা মূর্তির পূজা হয়, বিস্তারিত ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘‘মৃণ্ময়ী-মূর্তির মধ্যে প্রথমে খড় দিয়া, তাহার উপর মাটি দিয়া মূর্তি নির্মাণ করা হয়।

খড় না দিয়া যদি মৃণ্ময়ী-মূর্তি নির্মিত হয়, তবে সেই মূর্তি গৃহস্থের পূজার যোগ্য হয় না।

যে মূর্তির উচ্চতা সাড়ে তিন হাত, সেই মূর্তি গৃহস্থের পূজার যোগ্য নয়। গৃহস্থের পক্ষে তিন হাত অথবা তাহার ন্যূনপরিমাণ প্রতিমাই পূজার উপযুক্ত।’’

মহিষাসুর নিধনপর্বে এসে গিরিরাজ-তনয়া শিবপ্রিয়া গৃহিনী দুর্গার বায়োডাটা অন্য পথ ধরে যাত্রা শুরু করছে।

স্পষ্ট বলা হচ্ছে, বিভিন্ন দেবতার তেজোরাশি থেকে এই দেবী স্পেশালি মেড্। ‘‘কাত্যায়নাশ্রমে দেবগণ সেই সুদীপ্ত তেজোপুঞ্জকে দিগন্তব্যাপি জ্বলন্ত পর্বতের মতো অবস্থিত দেখলেন।’’

শম্ভুর ত্যেজে সেই নারীমূর্তির মুখ, যমের তেজে কেশপাস ও বিষ্ণুর ত্যেজে বাহুসমূহ সৃষ্টি হল। চন্দ্রত্যেজে স্তনযুগল, ইন্দ্রত্যেজে শরীরের মধ্যভাগ, বরুণের ত্যেজে জঙ্ঘা ও ঊরুদ্বয় এবং পৃথিবীর ত্যেজে নিতম্ব সৃষ্টি হল।’’

আরও নিবিড় অঙ্গবর্ণনা আছে, যেমন দক্ষাদি প্রজাপতিগণের ত্যেজে দন্তযুগল ও বহ্নির ত্যেজে ত্রিনয়নের উৎপত্তি হল।

শুধুমাত্র অপরের উপহারে তেজস্বিনী হয়েও নব নাটকের শেষ হয়নি।

নায়িকার মিলেছিল নানা উপহার, যার আইটেম ডিটেল রয়েছে শ্রীশ্রীচণ্ডীতে।

গত জন্মের মহাদেব এই অসুরঘাতিনীকে দিয়েছিলেন শূলান্তর, বিষ্ণু সুদর্শনচক্রান্তর, ইন্দ্র তার বজ্র থেকে বজ্রান্তর, এমনকী স্বর্গঐরাবতের ঘণ্টা থেকে চক্রান্তর।

একটা জিনিস স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন, কোনও দেবতাই তাঁদের অরিজিন্যাল ওয়েপনটি দেননি। দিয়েছিলেন তার পেটেন্টেড অস্ত্রের অথরাইজড কপি, যাকে বলা যায় জাস্ট লাইক অরিজিনাল।

শুধু অস্ত্র নয়, রমণী হিসেবে মিলেছিল নানা জুয়েলারি, যেমন বলয়, ললাটভূষণ, কণ্ঠভূষণ ও অঙ্গুরী।

তবে সব থেকে বিতর্কিত উপহারটি এসেছিল কুবেরের কাছ থেকে। রণক্ষেত্রের বিশেষ প্রয়োজনের কথা ভেবে দূরদর্শী কুবের যুবতীকে উপহার দিয়েছিলেন এমন একটি আশ্চর্য পানপাত্র যা খালি হলেই আবার নিজে থেকেই পূর্ণ হয়ে যায়।

ভয়াবহ রণাঙ্গণে রমণীহস্তে এই পাত্রের বারবার অপব্যবহার হয়েছিল এবং বিভিন্ন গ্রন্থে এক মদোন্মত্তা একাকিনী রমণীর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।

এই সদাপূর্ণ ভোজন অথবা সুরাপাত্র যে সেকালের দেবতাদের বিশেষ ফেভারিট ছিল তা দেবীভাগবতের মতন ঢাউস ঢাউস বইয়ের ফুটনোটগুলো একটু খুঁটিয়ে দেখলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে।

একটি সবিনয় উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

একবার প্রাণীদের কর্মের দুর্বিপাকবশত এই পৃথিবীতে পনেরো বছর বৃষ্টিপাত হয়নি। গৃহে গৃহে অসংখ্য মৃত্যু অনাহারে, ক্ষুধার্তিরা অশ্ব, বরাহ প্রভৃতি ভক্ষণ করতে লাগল।

কেউ কেউ মৃতদেহ ভক্ষণ শুরু করল। ব্রাহ্মণরা তখন একত্রিত হয়ে গৌতম নামে ঋষির দ্বারস্থ হলেন।

মহর্ষি তখন বাধ্য দেবী গায়ত্রীর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন, জগন্মাতা মূর্তিমতী হয়ে দর্শন দিলেন এবং একটি ভোজ্যপূর্ণ পাত্র দান করলেন।— ‘‘হে মুনে তুমি যখন যে যে খাদ্য ইচ্ছা করবে, এই পাত্র তখনই তোমাকে সেই খাদ্য দান করবে।’’

দেবগণের তিজোউদ্ভিত দেবীই যে অবিস্মরণীয় যুদ্ধের পরে কী ভাবে ফ্যামিলিলেডি হিসেবে আমাদের মধ্যে ফিরে এলেন সে নিয়ে ভক্তজনেরা তখন মাথা ঘামাননি।

দেবদেবীদের জীবনে নানা পর্যায় থাকে, এক এক রূপে এক এক পারিবারিক পরিচ। আমরা তাঁদের পেয়ে থাকি।

কোন বায়োডাটায় কী লেখা থাকছে তা নিয়ে ভক্তদের অযথা মাথা ঘামানোর তেমন রেওয়াজ নেই।

দেবী চণ্ডীর রণরঙ্গিনী মূর্তির বিস্তারিত বিবরণ শ্রীশ্রীচণ্ডীতে নেই, অনেক অপ্রচলিত সংবাদ আছে, দ্বাদশ স্কন্ধযুক্ত দেবীভাগতম-এ।

এই পুরাণকে মহাপুরাণও বলা হয়ে থাকে, আদি লেখক বেদব্যাস। বাংলায় অনুবাদক শ্রীপঞ্চানন দেবশর্মা তাঁর ভূমিকায় বলেছেন, ‘‘মাৎসর্যহীন হইয়া এই গ্রন্থ পাঠ করিলে, শাক্তবৈষ্ণব উভয়েই ইহা হইতে অমৃত ভাগ গ্রহণ করিতে পারেন।’’

রণক্ষেত্রে মহিষাসুর এবং তাঁর সেনাপতি ও পরামর্শদাতাবৃন্দ কেউই বুঝতে পারেননি যে এই আকর্ষণীয়া ও অপরিচিতা রমণীই দুর্গা।

তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে সদরদপ্তরে সুরাপানে মত্ত এক যুবতীর রিপোর্ট পাঠিয়েছেন এবং সেই রিপোর্ট পড়েই মহিষাসুর তাঁর প্রেমে পড়ে বিবাহপ্রস্তাব পাঠিয়েছেন।

এই প্রেমনিবেদন এবং প্রত্যাখ্যানের বিবরণ দেবীভাগবতমের অন্যতম আকর্ষণ— যুদ্ধের চেয়ে পুরুষ ও রমণীর বাক্যবিনিময় এই বইয়ের বিশেষ সম্পদ।

তবে ঘটনাবলির শেষ পরিণতি দুই বইতেই এক। এ কালের গণমাধ্যমের প্রচেষ্টায় এই যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ ভক্তদের কাছে অজ্ঞাত নয়।

কিন্তু নিষ্ঠাবান দুর্গা-ওয়াচাররা পুরুষ দেবতাদের নির্লজ্জ স্বার্থপরতা দেখে বেশ কিছুটা বিস্মিত।

সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে না, স্বর্গ থেকে বিতাড়িত ও প্রাণভয়ে পলায়মান দেবতারা কেমন করে একজন রমণীকে নানা অলঙ্কারে সজ্জিত হাতে করে একটি পানপাত্র ধরিয়ে দিয়ে ভয়াবহ এক অসুরের কাছে পাঠালেন।

শুধু এই নয়, ভয়াবহ যুদ্ধের শেষে এই রমণীর হাতে স্বর্গের সমস্ত দায় দায়িত্ব অর্পণ না করে সুলিখিত ভাষায় নিজেদের নানা আব্দার পেশ করবার জন্য প্রস্তুত হলেন। এই চার্টার অব ডিমান্ড মর্তের ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদেরও লজ্জা দেয়।

যুদ্ধপরবর্তী বিজয় আনন্দের মধ্যে আজও কিছুটা অস্পষ্টতা আছে!

যিনি এই মহাসাফল্যের নায়িকা তিনি উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু না হয়ে হঠাৎ নিঃশব্দে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন!

সংবাদপত্র ও টিভি সেই সময় সক্রিয় থাকলে আলোড়ন ফেলে দিত, কেন মহাযুদ্ধের মহাবিজয়িনী হঠাৎ বিরক্ত এবং অভিমানিনী হলেন?

তাঁর সংবর্ধনায় কোন ভুল হল, তা নিয়ে নানা চাঞ্চল্যকর গুজব রটেছে। শ্রীশ্রী চণ্ডীর কোনও স্পোকসপার্সন অথবা মুখপাত্রী ছিল না। দোর্দণ্ডপ্রতাপ দেবদেবীরা নিজের কথা নিজেই সোজাসুজি বলতেন, ফলে টেনশনের পক্ষে পেনসন নেওয়া সম্ভব হত না।

যাই হোক যথা সময়ে স্বার্থপর দেবতারা পরিস্থিতি নিজেদের আয়ত্তের মধ্যে এনে চণ্ডীবন্দনায় রত হলেন এবং সুযোগ বুঝে তাঁদের দেহি দেহি দাবিসনদ বা প্রত্যাশা-তালিকা পেশ করলেন।

এই তালিকাটি খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় শুধু আজকের মর্ত্যলোকেই নয়, অনন্ত সুখের স্বর্গলোকেও আরও দাও আরও দাও-এর জয়ধ্বনি।

মহাদুর্যোগের মধ্যে প্রাণরক্ষা হল এই না যথেষ্ট, কিন্তু লজ্জার মাথা খেয়ে স্তাবকরা বললেন, শুধু জয়ং নয়, রূপং দেহি!

এই সব আনন্দোৎসবে শ্রীশ্রীচণ্ডীর নিজের স্পেশাল। বাসস্থানের একটা বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে।

যাঁরা দেবীদুর্গার এই প্লেজার প্যালেসের খোঁজ করছেন অথচ খুঁজে পাচ্ছেন না, তাঁরা জেনে রাখুন এই রিসর্টের নাম মণি-দ্বীপ, ব্রহ্মলোকের উর্ধ্বে এর অপর নাম সর্বলোক। দেবী ভগবতী নিজের বসবাসের জন্য কল্পনাবলে যা সৃষ্টি করেছিলেন তা বৈকুণ্ঠ এবং কৈলাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

একটু নমুনা বর্ণনা দেবীভাগবতম থেকে দেওয়া যেতে পারে।

অতি গম্ভীর সুধাসাগর এই দ্বীপের চতুর্দিকে বেষ্টন করে আছে। শত শত দ্বারপাল ধাতুনির্মিত প্রাকারের চারটি দ্বার রক্ষা করছে এবং সজাগ সিকিউরিটি কর্মীরা বেত হাতে কিলকিলা-রবে জনতা সামলাচ্ছেন। ব্রহ্মাণ্ডে যতরকম গাছ আছে সবই এখানে পোঁতা হয়েছে এবং নিরন্তর পুঞ্জিত ও নবপল্লবিত হয়ে তারা সৌরভ বিস্তার করছে।

ঢাকা শহরে বারিধারা অঞ্চলে কয়েক দিন বসবাসের সুযোগ হয়েছিল, এই নামের সঙ্গে যে দেবীদুর্গার স্পেশাল সম্পর্ক রয়েছে তা তখন জানতাম না। নভঃশ্রী, নিরত্বি, মেঘয়াস্তিকা, চিবুনিকা, বারিধারা ইত্যাদি দ্বাদশশক্তি মদবিহ্বলা হয়ে বর্ষারাজের আনন্দোৎপাদন করছে এই মণিদ্বীপে। হেমন্ত নামে ঋতু এই স্থানের অধিনায়ক, তাঁর দুই ভার্যার নাম মাঘ-শোভা ও ফাল্গুন-শোভা।

মহাদেবীর মদগর্বিতা পরিচারিকাদের বিশ্রাম ও বসবাসের জন্য একটি বিশেষ টাউনশিপ রয়েছে। দেবীর বিশেষ প্রিয় অষ্টসখীর কয়েকজনের নাম অনঙ্গরূপা, সুন্দরী, মদনাতুরা, ভুবনাবেগা ইত্যাদি।

দেবীদুর্গা প্রসঙ্গে আমরা কেবল কৈলাসকাহিনী বারবার শুনে থাকি, কিন্তু কেন সর্বলোক অথবা মণিদ্বীপের কথা তেমন ওঠে না তা ভক্তজনেরা তেমন খোঁজখবর করেন না।

আমরা কেবল জানি, এই স্বপ্নশহরের ঠিক দক্ষিণে যমালয় যেখানে সূর্যতনয় যম দোর্দণ্ডপ্রতাপে রাজত্ব করেন।

মহিষাসুর বধের অন্তিম দৃশ্যটি অবশ্যই স্মরণীয়। উৎকৃষ্ট চক্র ধারণ করে ক্রোধভরে পুণঃ পুণঃ মাধবীসুধা পান করতে করতে দেবী বললেন, অরে মদান্ধ, এই চক্র দর্শন কর, ইহাতেই তোমার কণ্ঠদেশ বিচ্ছিন্ন হইবে, তুই এক্ষণে ক্ষণমাত্র স্থির হইয়া যমলোক গমন কর! এ বার ভীষণ চক্র নিক্ষেপ করামাত্র মহিষের মস্তক ছিন্ন হইল।

মহিষাসুর বিনিপাতিত হওয়ায় দেবগণ পরম আনন্দসাগরে ভাসমান হলেন এবং দেবচণ্ডী সমরক্ষেত্র পরিত্যাগ করে পবিত্র প্রদেশে অবস্থান করতে লাগলেন।

দেবগণের স্তুতিবাদ শ্রবণ করে দেবী ভগবতী বললেন, যদি কিছু অপর দুঃসাধ্য কাজ থাকে বলো, যে যে সময়ে তোমাদের কোনও দুষ্কর কাজ উপস্থিত হবে, সেই সময়ে আমাতে চিন্তা কোরো, আমি সেই বিপদ দূর করব।

দেবগণের নির্লজ্জ প্রশস্তি তখনও অব্যাহত, কিন্তু দেবী এ বার অকস্মাৎ অন্তর্ধান করায় দেবগণ কিছুটা বিস্মিত হলেন।

এ বার দেবী কোথায় গেলেন?

ব্যাসদেব জানাচ্ছেন এর পরেই তিনি তাঁর পরম প্রিয় স্থান মণিদ্বীপে গমন করলেন।

নবযুগের নবীন-নবীনাদের প্রশ্নের শেষ হতে চায় না। তাঁদের প্রশ্ন, দেবী দুর্গা ও শ্রীশ্রী চণ্ডী কি একই দেবী?

উত্তরে বলা চলে, স্কন্দ পুরাণে আরও সংখ্যাহীন নামে তাঁর পরিচয়। অষ্টোত্তর সহস্রনামের জন্যই তো আমাদের দেবদেবীরা পরিচিত। স্কন্দপুরাণে দেবী দুর্গার মস্ত লিস্টি আছে। আবার হাতের গোড়ায় রয়েছে বহুপরিচিত ‘দেবী ভগবতম’।

গায়ত্রীদেবীর অষ্টোত্তর সহস্রনামের যে তালিকা, সেখানে বলা হচ্ছে তিনিই জয়া, শান্তা, কান্তা, দুর্গা, তিনিই চণ্ডিকা। এই মন্ত্রের ঋষি ব্রহ্মা, ছন্দ অনুষ্টুপ। গায়ত্রীর এক হাজার আটটি পবিত্র নামের তালিকাটি বঙ্গীয় বধূরা এক সময়ে সযত্নে গহনার বাক্সে রেখে দিতেন, বংশে নবজাত কন্যাদের নামকরণের জন্য।

নিষ্ঠাবান ভক্তদের বিশ্বাস এই তালিকা বাড়িতে থাকলে এবং মাঝে মাঝে পঠিত হলে মানুষের পুণ্য হয় এবং দরিদ্রের ধনপ্রীতি ঘটে।

এই অষ্টোত্তর সহস্রনামের উৎস অবশ্যই দেবীভাগতম্। গায়ত্রীর এই নামতালিকা অনেকেই খোঁজ করেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement