নিউ টাউনের একটি বড় কমপ্লেক্সের শপিং প্লাজ়ার একতলার আয়তাকার পরিসরে ‘মাই ক্যালাইডোস্কোপ’-এর আয়োজনে সম্পন্ন হল সাময়িক একটি প্রদর্শনী। এটি কোনও সংস্থা বা গ্যালারি নয়। কর্তৃপক্ষ জানালেন, আপাতত এই নাম সামনে রেখে প্রদর্শনীর ভাবনা, পরবর্তী সময়ে এখানেই বিভিন্ন শিল্প প্রদর্শনী, ওয়ার্কশপ করার ইচ্ছের কথা। ৫৪টি কাজ প্রদর্শনের উপযুক্ত ব্যবস্থা করেই ঝোলানো উচিত ছিল। অনুষ্ঠানবাড়ির মতো পাতলা সাদা কাপড় দিয়ে তিন দিক ঘিরে ও ভাবে ডিসপ্লে করার আগে সমগ্র ব্যবস্থা নিয়ে, সুচারুভাবে একটি প্রদর্শনী যেমন হয়, সে ভাবেই করা যেত, যা এখানে পালন করা হয়নি। এত ছবি প্রায় গায়ে গায়ে ঝুলিয়ে, নীচে পাশে, মাটিতে কাজ রাখা প্রদর্শনীর পক্ষে বড্ড বেমানান। গোটা জায়গাটিকে প্রয়োজন অনুযায়ী না ঘিরে, অনেক অসম্পূর্ণতার মধ্যে এ ভাবে প্রদর্শনী না করাই সঙ্গত। গণমাধ্যমে নানা ভাবে প্রচার করা, আর একটি সুশোভন প্রদর্শনীর আয়োজন করা, দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। উদ্দেশ্য যদি প্রচারসর্বস্বতা হয়, সে প্রশ্ন আলাদা। ভবিষ্যতে প্রদর্শনী আয়োজনের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ অবশ্যই বিষয়গুলি নিয়ে ভাববেন।
কুড়ি জনের কাজগুলির মধ্যে বেশ কিছু দুর্বল, অতি সাধারণ মানের, প্রদর্শনীর জন্য অনুপযুক্ত। সব কাজই রাখতে হবে, এমন হলে মানের প্রশ্নেই বাধা আসবে। পাশাপাশি কিছু কাজ দেখে বোঝাই যায় তার গুণমান। দু’-তিনজন স্বশিক্ষিত শিল্পী।
সদ্যপ্রয়াত অমিতকুমার বসু সফট প্যাস্টেল, অয়েল ইত্যাদিতে কাজ করেছেন। আর্ট কলেজে পড়েননি। সেনাবাহিনী ও ব্যাঙ্কে কর্মরত থাকাকালীন প্রধানত বইপত্র দেখেই ছবি আঁকতেন, কপিওয়ার্ক করতেন। সে ভাবেই সম্পূর্ণ নিজে শেখা। রেফারেন্স সংবলিত কাজে তাঁর ট্রিটমেন্ট ও ড্রয়িংয়ের পারফেকশন কিন্তু উন্নত মানের। বেঙ্গল স্কুল ও ইউরোপীয় রীতিকে তিনি ভালই আয়ত্ত করেছিলেন, বর্তমান কাজগুলি দেখে বোঝা যায়। প্রদর্শনীটির মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করা হয়েছে।
শিক্ষানবিশ পর্বে থাকা (আর্ট কলেজে নয়) অবস্থায় অনেকেই পেন্টিংয়ের প্রাথমিক কিছু প্রয়োজনীয় ও প্রধান জায়গাটিকেই ধরতে পারেন না। এখানেও তা বেশ অনুভূত হয়েছে। শিক্ষকের ভূমিকা এখানে অনেকটাই। ফলে যাঁরা শিখছেন, তাঁদের কাজের ওই সব দিকে তাঁকেও নজরে রাখতে হয়। ভুলভ্রান্তি ধরাতে হয়। অনেকের ড্রয়িং অতি দুর্বল। একটি প্রবণতা অনেকের কাজেই বিদ্যমান, তা হল, মিডিয়ামটি বুঝুন বা না বুঝুন, যেমন-তেমন ভাবে ক্যানভাস বা কাগজে ব্রাশের মাধ্যমে একটি অদ্ভুত টেকনিক প্রয়োগ করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছেন। বর্ণের প্রয়োগ, মিশ্রণ, ব্রাশিং, একটি নির্দিষ্ট আবহ তৈরি করা... এ সব বিষয় ছবিকে অতি দুর্বলই করেছে। প্রধান অবজেক্ট বা অন্যান্য অনুষঙ্গের সঙ্গে পটভূমি ও স্পেসের ভূমিকাকে অনেকে বুঝতেই পারেননি। পেন্টিং রঙিন সচিত্রকরণ নয়। এর একটা উদ্দেশ্য থাকে। ফর্ম, অ্যারেঞ্জমেন্ট, স্পেস, ব্যাকগ্রাউন্ড, কালার, ট্রিটমেন্ট, অবজেক্ট, পার্সপেক্টিভ, প্রোপোর্শন... এমন অনেক কিছুই এ সব ক্ষেত্রে জড়িত। ছবি দেখে মনেই হয় না যে, তাঁরা এ নিয়ে প্রাথমিকভাবে কিছু শিখেছেন।
কয়েকজনের কাজে সারল্য, উন্মাদনা, এমনকি ধীর, সংযত রূপও লক্ষ করা গিয়েছে। বোঝা যায়, স্বাধীনতাকে তাঁদের মতো করে ছবির মধ্যে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। সব ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন তা নয়, তবু প্রচেষ্টার মধ্যে একটা সিরিয়াসনেস কাজ করেছে, বুঝতে অসুবিধে হয় না। অন্তত ভাবনা ও কম্পোজ়িশনে একটা পর্যবেক্ষণকে লালন করেছেন। সাহসের সঙ্গে চরম বিমূর্ততার আভাসও রাখার চেষ্টা করেছেন। এ বার ধীরে ধীরে বুঝতে হবে ছবি তৈরির মূল জায়গাটিকে আয়ত্ত করা।
কিছু রিয়েলিস্টিক কাজও ছিল। মানুষ ও দেবদেবীর মুখাবয়বকে প্রাধান্য দিয়ে হঠাৎ কোথাও অবান্তর ও বর্ণের বিচ্ছুরণ এবং প্রতিচ্ছায়াকেন্দ্রিক কাজও আছে। ধরন বা স্টাইল দু’-তিন জনের কাজে পাওয়া গেলেও, অধিকাংশেরই তা এখনও গড়ে ওঠেনি। তাঁদের সমস্যাই বেশি।
ডিজ়াইনের সঙ্গে লোকশিল্প আঙ্গিক মিশে একটা পৌত্তলিকতা তৈরি হয়েছে শুভেন্দু ঘোষের কাজে। পুষ্প ও নারীমুখের সুললিত সিরিজ় ছাড়াও উগ্র চড়া লাল বা ব্রাউন-অরেঞ্জ-রেড মিশ্রিত ল্যান্ডস্কেপে পুষ্পেন নিয়োগী প্রতিচ্ছায়াবাদকে যেন ফিরিয়েছেন, ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে। একই মাধ্যমে অর্পিতা দের ‘বারাণসী’ অন্য রকম। নবমিতা চক্রবর্তীর প্রজাপতি নিয়ে ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকের কাজটিতে ট্রিটমেন্ট চমৎকার। অন্যটি অতি দুর্বল। এ ছাড়া ভাল কাজ করেছেন অনুমিত্রা বসু মণ্ডল, সুস্মিতা হাজরা, শ্বেতা ভট্টাচার্য, অঙ্কিতা পাল, মানসী কুণ্ডু প্রমুখ।