অঙ্গভঙ্গি: ইমামি আর্টে পার্থপ্রতিম দেবের প্রদর্শনী
রঙ্গ-ব্যঙ্গ, সেই সঙ্গে মজা-রসিকতা, এ তাঁর বরাবরের অভ্যেস। তবে সবটাই ওই দ্বিমাত্রিক কালো রেখার অঙ্কনে। অয়েল-অ্যাক্রিলিকেও এমন বহু চরিত্রের বিবিধ অঙ্গভঙ্গি মানুষকে মোহিত করেছে। চোখে ঠুলি পরা সমাজের প্রতি, এমনকি কোনও প্রতিনিধিসুলভ মানবের প্রতি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তার প্রতিও পার্থপ্রতিম দেব কোনও কোনও ড্রয়িংয়ে এক সময়ে মারাত্মক ব্যঙ্গ করতে পিছপা হননি। সেই সব বিচিত্র অঙ্গভঙ্গির অজস্র বিচিত্র মানুষকে নিয়েই অবিরল কাজ করে চলেছেন গত পঞ্চাশ-ষাট বছরেরও বেশি। এই ধরনের আরও নতুন ছোট বড় সাদা-কালো ১৭টি লিনোকাট ও প্রায় একক ভাবে ২৫টিরও বেশি ড্রয়িং নিয়ে তাঁর ‘রূপভঙ্গি’ নামের প্রদর্শনীটি চলছে। আয়োজন করেছে ইমামি আর্ট।
শিল্পীর সারা জীবনের কাজগুলিকে পর্যালোচনা করলে চারটি পর্যায় পাওয়া যাবে। গ্রাফিক্স-প্রিন্ট মেকিং, ড্রয়িং, পেন্টিং, ভাস্কর্য। এই শেষোক্ত পর্বের মধ্যেও পেপার পাল্প, বোতল, বিবিধ দ্রব্য ও পরিত্যক্ত দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রীকে আশ্চর্য শৈল্পিক বিবর্তনে ইউরোপীয় অপ ও পপ আর্টের ভারতীয়ত্ব, ইমেজ, সেরামিক, পুরনো ক্যানভাস জুড়ে, মুড়ে, সেলাই করে অদ্ভুত সব মুখাবয়ব ও রূপবন্ধের মজাদার বিশ্লেষণ...কী না করেছেন! আরও জিনিস নিয়ে কাজ করে চলেছেন। এই প্রদর্শনী শুধু ড্রয়িংয়েরই এক মহাভঙ্গির বিচিত্র ও বৈচিত্রময় রূপ। আটাত্তর বছরের এই তরুণ অধ্যাপক আজও কী বিপুল ভাবে ক্রিয়াশীল! মগ্ন চৈতন্যের অন্তর্নিহিত প্রদেশ থেকে উঠে আসা এক রসিক মানব। তবে মাধ্যমকে তিনি নতুন ভাবে চিনিয়েছেন তাঁর অগণিত ছাত্রছাত্রীকে। শিল্পকলার জন্য নির্দিষ্ট মাধ্যমগুলির বাইরে গিয়েও আরও অন্যান্য জানা-অজানা মিডিয়ামকে কাজে লাগিয়েছেন তাঁর চিত্রকর্ম থেকে ত্রিমাত্রিকতার বিভিন্ন পর্যায়ে।
‘রূপভঙ্গি’র কাজগুলিতে ১৭টি প্রায় এক ফুট বাই এক ফুটের লিনোকাটে মানুষের বিচিত্র সব অঙ্গভঙ্গির জয়জয়কার। এমনিতেই তিনি তাঁর এমন ড্রয়িংগুলিতে বহু কাল যাবৎই একটি নিজস্ব ভাষা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। কার্টুন অথচ কার্টুন নয়, সাদা-কালোর এক টেক্সচার-সমন্বিত পটভূমিকা। সেখানেও যেন ছায়াতপের বিভ্রম, রেখার বৈচিত্রময় ভিন্ন কাটাকুটি। ধারালো ধাতব কাটারকে অভাবনীয় দক্ষতায় ব্যবহারের ফলে রেখার চরিত্র বদলে দেওয়া নকশা বা ডিজ়াইন, সার্কাসের জোকারের মতো অঙ্গভঙ্গি করা মানুষ, অদেখা অজানা রূপবন্ধের সমাহারে তারা এক-একজন খেলোয়াড়— এমন সব রূপ ও ভঙ্গিকে একত্রে মিলিয়েছেন। পটভূমির কালো ভেদ করা সাদাকালোর এই নাটকীয় মুহূর্তগুলি যেন সুকুমার রায়ের মজার ছড়াকে কখনও মনে করায়, কখনও অটো ডিক্স, পিকাসো, মাতিস, নন্দলাল, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিশ্রণের এক আশ্চর্য অনুরণনও অনুভূত হয়। এই একক মানব-মানবীর বিচিত্র বিন্যাসে তাঁর লিনোকাটগুলি অবিস্মরণীয়। ‘দ্য লেডি প্লেয়িং দি ইনস্ট্রুমেন্টস’, ‘দ্য ম্যাজিক বেলুন’, ‘আ সারপ্রাইজ় ম্যান’, ‘অ্যান অবজ়ার্ভার’ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। লিনো তাঁর প্রিয় মাধ্যম। পার্থপ্রতিম কলাভবনে বিশ্বরূপ বসু, বিনোদবিহারী, ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মণ, রামকিঙ্করকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন। বরোদাতেও জ্যোতি ভাট, কে জি সুব্রহ্মণ্যমকে। সকলের কাজের বৈশিষ্ট্যই তাঁকে নিজস্ব একটি পথনির্দেশ দিয়েছিল। সেই সঙ্গে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ঐতিহ্যগত ধ্রুপদী আঙ্গিক থেকে আধুনিক শিল্পের বিমূর্ততার চরম নির্যাসটুকু গ্রহণ করেই তাকে নিজের মতো ব্যবহার করেছেন শিল্পী।
তাঁর চিত্রশিল্পে গ্রাফিক কোয়ালিটি ভীষণ ভাবে বিদ্যমান। কোথাও কোথাও হালকা ও উজ্জ্বল বর্ণ। এক বিচিত্র ডায়মেনশন ও সুররিয়াল অভিব্যক্তিও ছবিগুলির মধ্যে যেন নড়াচড়া করছে। তীব্র কৌতূহলোদ্দীপক ও উদ্দীপনা সঞ্চার করছে। বিদ্রুপ আছে, কৌতুক আছে, তীব্র অভিব্যক্তিময় একটি অভিঘাতও থেকে যায় কোথাও কোথাও। সাদা-কালোর এমন ডিস্ট্রিবিউশন ছবিকে একটি সীমা থেকে অনির্দিষ্টের দিকে নিয়ে যায়।
কলাভবন থেকে বরোদা, কিছুকাল পরে আগরতলায় ফিরে অনেক রকম কাজ করেছিলেন। রবীন্দ্রভারতীতে ফিরে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে। নতুন ধ্যানধারণায় ছাত্র-ছাত্রীদের শেখাতে চেয়ে সফল হয়েছিলেন পার্থপ্রতিম। ড্রয়িংয়ের সময়ে অবজেক্টিভ বলে কিছু থাকে না, এমনই উপলব্ধি তাঁর। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ডিস্ট্রিবিউশনই আসল তাঁর কাজে। সহজেই এসে যায় অমন অঙ্গভঙ্গি বা রূপভঙ্গি। লাইনই একটি ড্রয়িংকে সম্পূর্ণ করে। স্ট্রাকচারের সঙ্গে যার আত্মীয়তা। মানুষ আসে পরে। এটা এক রকম রান্না করার মতোই। ধীরে ধীরে উন্নত হয়। অসাধারণ একটি প্রদর্শনী।