অনন্ত: অ্যাকাডেমিতে শিল্পী মন্দিরা গঙ্গোপাধ্যায়ের একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
সম্প্রতি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে মন্দিরা গঙ্গোপাধ্যায়ের একক প্রদর্শনী হয়ে গেল। দক্ষতার সঙ্গে প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন শুভঙ্কর সিংহ। আর্টভার্সের তরফ থেকে এটিই প্রথম একক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হল। মন্দিরা গঙ্গোপাধ্যায় মূলত স্বশিক্ষিত। শিল্পের যা কৌশল তিনি আয়ত্ত করেছেন, তার প্রায় সমস্তটাই নিজস্ব প্রয়াসে। এক সময়ে প্যারিসে ছিলেন এবং প্রায় আড়াই বছর ধরে আমেরিকান সেন্টার ফর ফাইন আর্টস থেকে চারুকলায় শিক্ষাগ্রহণ সম্ভব হয়। তারপর ফিরে এসে বিড়লা অ্যাকাডেমিতে ‘স্বরসঙ্গম’-এর ছাতার নীচে শিল্পকলায় শিক্ষাগ্রহণ করেন। এটি তাঁর পঞ্চম একক প্রদর্শনী। অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে এই প্রথম প্রদর্শনী করলেন শিল্পী। নাম, ‘ব্রিদিং ইনফিনিটি’।
এই প্রদর্শনীতে মন্দিরা গঙ্গোপাধ্যায়ের ছত্রিশটি কাজ দেখতে পাওয়া গেল। পনেরোটি ক্যানভাসের উপরে অ্যাক্রিলিকের কাজ। বাকি একুশটি কাজ জলরং, পেন্সিল এবং কন্টি পেন্সিলে করা কাগজের উপরে। মোটামুটি সব মাধ্যমেই মন্দিরার কাজ করার ক্ষমতা লক্ষণীয়।
শিল্পীর প্রতিকৃতির হাত ভাল। চারকোল এবং পেন্সিলে কাগজের উপরে করা বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রতিকৃতি দেখা গেল এবং সেগুলিতে বাস্তবের হুবহু প্রতিফলন আনতে কিছুটা সক্ষমও হয়েছেন তিনি। প্রদর্শনীতে রাখা একটি প্রতিকৃতির নাম ‘দ্য গ্লান্স’। চকিতে দেখছে এক সুপুরুষ। হয়তো চলচ্চিত্রের অভিনেতাই হবে, কিন্তু ওই দৃষ্টিটা অল্প চারকোলের কাজে সুন্দর ধরেছেন মন্দিরা। এখানেই তাঁর হাত কত পরিণত বোঝা যায়, যদিও সম্পূর্ণ ভাবেই বাস্তবধর্মী কাজ এটি।
জলরঙের কাজের মধ্যে ‘চার্মড পেডলার’ নামের কাজটি অনুভূতিময়। ছোট্ট কৃষ্ণ নিজে পছন্দ করে বাঁশি কিনছে এক বাঁশিওয়ালার কাছ থেকে। সংবেদনশীল কাজ জলরঙে। রচনাশৈলীতে আকর্ষণ আছে। তবে জলরংকে তুলি থেকে আরও কিছুটা বন্ধনমুক্ত করতে হবে শিল্পীকে। জলরং তো কাগজের উপরে স্বাধীন ভাবে বিচরণ করতে চায়, তাই তাকে আরও কিছুটা ছেড়ে কাজ করতে হবে।
ক্যানভাসের উপরে অ্যাক্রিলিকে করা একটি ছবি ‘দ্য চেরিজ়’। বাস্তবধর্মী ছবি হলেও এই ছবিতে বেশ একটা মজা আছে এবং চেরিগুলোর নিজস্ব রসালো চেহারা এবং উজ্জ্বল রং অনবদ্য ভাবে ধরতে সক্ষম হয়েছেন মন্দিরা।
অ্যাক্রিলিকের একটি ছবির নাম ‘দ্য ভ্যানিশিং ফ্রেম’। এখানে চার্লি চ্যাপলিনের মতো একটি চরিত্র এঁকেছেন মন্দিরা। তার সঙ্গে একটি বালক। মনে পড়িয়ে দেয়, চ্যাপলিনের ‘দ্য কিড’ বলে সিনেমাটির কথা। তবে এখানে শিল্পীর বলতে চাওয়া গল্পটা কিন্তু আলাদা। কাজটি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, চ্যাপলিনের মতো এই জাদুকর যেন তার মোহিনী শক্তি ব্যবহার করে অপ্রাকৃত এক পৃথিবী বা পৃথিবীর বাইরের এক মহাশূন্য দর্শন করাচ্ছে ওই বাচ্চাটিকে। যেখানে আছে তারামণ্ডল, চাঁদ, সূর্য নিয়ে সম্পূর্ণ এক গ্যালাক্সি। যেন শিল্পী বলতে চাইছেন যে, আমরা সকলেই এই সুবৃহৎ তারামণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত ক্ষুদ্র সব প্রাণ। ছবিটি ক্যানভাসের উপরে অ্যাক্রিলিক রঙে করা। দু’টি মানুষেরই মুখের অভিব্যক্তি খুব সুন্দর। ছবিটিতে রং অত্যন্ত কোমল ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। নীল এবং সোনালি রঙের প্রাধান্য রয়েছে এই কাজে।
প্রায় প্রতিটি ক্যানভাসকেই মন্দিরা গঙ্গোপাধ্যায় এক সূত্রে বাঁধতে চেয়েছেন। সেই সূত্রটি আত্মিক বা আধ্যাত্মিক। একটা সুপ্ত অলৌকিক ভাব কাজ করছে সব ক’টি ছবিতে। সেটা মানুষের মুখের অভিব্যক্তি হতে পারে বা কুকুরের প্রতিকৃতি হতে পারে। অথবা ফল বা ফুলের ছবিও হতে পারে। এই বিষয়টিই মন্দিরার এত বড় একটা রঙিন সম্ভারের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।