শিল্পী রবীন মণ্ডলের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
শিল্পী রবীন মণ্ডলের ১৯৭২ থেকে ২০১৭ সাল সময়কাল পর্যন্ত করা ৪৩টি কাজ সম্প্রতি উপস্থাপন করল গ্যালারি ৮৮।
রবীন মণ্ডলের জন্ম ১৯২৯ সালে হাওড়ার এক মধ্যবিত্ত, যৌথ পরিবারে। বড় হওয়ার সময়ে দেখেছেন মন্বন্তর, তেভাগা আন্দোলন, দেশভাগ ইত্যাদি। বাড়িতে হিন্দুস্তানি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা ছিল। তাঁর জ্যাঠামশাই খুব ভাল পাখোয়াজ বাজাতেন। এ ছাড়াও রবীনের বাবার ছবি আঁকার অভ্যাস ছিল। দুর্ভাগ্যবশত, ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়ে এক অদ্ভুত অসুস্থতা শয্যাশায়ী করে ফেলে রবীনকে। অসুস্থ অবস্থায় সমস্ত সঙ্গীদের চেয়ে আলাদা হয়ে একটি ছোট্ট ঘরে বেশ কিছু দিন কাটাতে হয়েছিল। শিল্পী সতীশ গুজরালের জীবনের সঙ্গে এখানে কিছুটা সাদৃশ্য পাওয়া যায় রবীনের। সেই সময়ে বাবা তাঁকে ড্রয়িংয়ের খাতা এবং যাবতীয় আঁকার সামগ্ৰী উপহার দিয়েছিলেন। সেই হল তাঁর ছবি আঁকার শুরু। ওই ছোট ঘরের বন্দি-জীবনে একটি জানালা দিয়ে বাইরের দুনিয়াটা দেখতেন রবীন, রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’-এর অমলের মতো খানিকটা। ছবি আঁকতেন, কানে আসত বাবার পাখোয়াজের বোল। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অসুস্থ রবীনের ঘরে কেউ তাকে দেখতে এলেই বসতে অনুরোধ করতেন রবীন এবং তাঁর প্রতিকৃতি আঁকতে চাইতেন। ছেলেবেলার এই দিনগুলির প্রভাব চিরজীবনের মতো দেখা গিয়েছে তাঁর কাজে।
রবীনের কাজ নিয়ে আয়োজিত ‘ডিপ স্ক্র্যাচেস’ নামে এই প্রদর্শনীতে ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে করা একটি ছবি দেখা গেল, নাম ‘ফিশিং ইন রেন’। অ্যাক্রিলিকের ছবি ক্যানভাসের উপরে, টেক্সচার সমৃদ্ধ। প্রায় মোনোক্রমেই করা বলা চলে। সোজাসুজি ক্যানভাসের উপরে রং ফেলে করেছেন। ঠিক যে রকম ভাবে কাজ করতেন শিল্পী রবীন মণ্ডল, তার স্বাক্ষর বহন করে এই ছবিটি। শিল্পীর মানসিকতা সাধারণত উচ্ছ্বাসপ্রবণ নয়। তাঁর কাজে বাস্তবতাও হুবহু চিত্রিত হয় না। তবুও যেন এই কাজে যথেষ্ট অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। খুব সুন্দর কাজ।
এর পরের ছবিটির নাম ‘ডল’। এটি ১৯৯৭ সালে করা ডল সিরিজ়ের একটি ছবি। কাগজের বোর্ডের উপর অ্যাক্রিলিকে করা। সোজাসুজি রং ফেলে করা এবং অসমতল তুলির কাজ দেখা যাচ্ছে। হয়তো ছোটবেলায় পুতুল খেলা দেখে তার কিছু প্রভাব পড়েছে তাঁর মনে কিংবা হয়তো কোন নারীকে পুতুলের মতো করে কল্পনা করেছেন শিল্পী। বাস্তবের অনেক কিছুই পরোক্ষ ভাবে শিল্পীকে প্রভাবিত করে অনেক সময়ে, কিন্তু সেটা কখনওই প্রত্যক্ষ সত্যি হয়ে ওঠে না। ঠিক সে রকমই শিল্পীর অন্তর্জগতের এক ভাবমূর্তি এই ডল বা পুতুল।
এ বার যে ছবিটির কথা বলা দরকার, সেটির নাম ‘উয়োম্যান’। কাগজের উপরে মিশ্রমাধ্যমে করা একটি মহিলার ছবি। রঙের বাহুল্য নেই ও আঙ্গিক তাঁর নিজস্ব স্বাক্ষরবাহী। শহর হাওড়ার অবস্থান, সেখানকার কলকারখানার সমস্যা এবং তার প্রতিক্রিয়া নিয়ে এমন ভাবে বিহ্বল হয়ে থাকতেন শিল্পী যে, তাঁর এই ছবিতেও সেই যন্ত্রণাদায়ক হতাশার ছাপ স্পষ্ট। এই কারণেই হয়তো শিল্পকলায় চপল সৌন্দর্য ও অলঙ্করণ থেকে তিনি সরে থেকেছেন চিরকাল।
এ বারের ছবি ‘লাভার্স’, ২০০৭-এ করা কাগজের বোর্ডের উপরে অ্যাক্রিলিকের কাজ। এ ছবির কালার প্যালেটও উজ্জ্বল নয়, খানিকটা ‘ফিশিং ইন রেন’-এর মতোই। শ্যাওলা রঙের প্রেক্ষাপটে প্রেমিক-প্রেমিকার ছবি। লাভার্স সিরিজ়ের চার নম্বর ছবি এটি। প্রেমিকা যেন প্রেমিকের কোলে বসে আছেন, কারণ তার উচ্চতা বেশি। এখানেও শিল্পী রবীন মণ্ডলের স্বভাবসুলভ প্রেম-বিহ্বলতা দেখা গেল না যুগলের মুখাবয়বে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, দু’জনের শরীরেই ছোট ছোট ডিজ়াইন দেখা যাচ্ছে। খানিকটা নামাবলিতে যে রকম থাকে। কিন্তু ওই নকশার মধ্যে হরিনাম স্পষ্ট নয়। ছবিটি দর্শকদের ভাবায়, এরা কি কীর্তনিয়া? এই দুই নর-নারীর মধ্যে গভীর বন্ধন সুস্পষ্ট। এই ছবি খুব একটা নয়নসুখকর না হলেও বিষয়গত দিক থেকে যথেষ্ট মনোগ্রাহী।
১৯৮৮ সালে মিশ্রমাধ্যমে করা কাগজে শিরোনামহীন একটি ছবির কথা বলতে হয়। গ্রামীণ এক মহিলার মধ্যে হতাশা এবং অভাব ছাপিয়েও সরলতা, পেলবতা ধরা পড়েছে। এই নারী তার উন্মুক্ত স্তনের উপরে এক শিশুকে চেপে ধরে রেখেছেন। হয় মানবশিশু, অথবা কোনও পশুশাবক। এই ছবিতে বাস্তবের কঠোরতা ছাপিয়ে শিল্পীমনের কোমলতা আত্মপ্রকাশ করেছে। এটি জলরং এবং পেন অ্যান্ড ইঙ্কের উপরে করা ভাবপ্রধান কাজ।
২০০৮ সালে কাগজের উপরে মিশ্রমাধ্যমে করা একটি মুখাবয়ব দেখা গেল। নাম ‘ফেস’। কালো কাগজের উপরে উজ্জ্বল বর্ণের একটি মুখ। এখানে হলুদ, কমলা, খয়েরি রঙের উপরে সরু কালো কলমের এলোমেলো আঁচড়ে ব্যক্ত হয়েছে দু’টি চোখের মর্মস্পর্শী অভিব্যক্তি। ২০০৪-এ করা একটি ছবি, নাম ‘আনটাইটেলড’। ছবিটি শিরোনামহীন হলেও তাতে একটু যেন শিল্পীর রাজা-রানি সিরিজ়ের ছোঁয়া পাওয়া যায়। কাগজে অ্যাক্রিলিকের কাজ। এ ছবির বর্ণ অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল। বার্ন্ট সিয়েনা রঙের চেয়ে উত্তরণ ঘটিয়ে বেশ চমৎকার লালের আভাস।
শিল্পী রবীন মণ্ডল যখন আঙ্গিক বা স্টাইল নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন, নিজের ভাবনাকে ঠিক ভাবে প্রকাশ করতে চাইছিলেন, সেই সময়ে তিনি ভরসা করেছিলেন এবং আশ্রয় নিয়েছিলেন প্রাচীন জনজাতির মূর্তিতে বা লোককথার রীতিতে। কারণ সেখানেই তিনি দেখেছেন পৃথিবীর কল্পস্বর্গ। তাঁর সব কাজেই সেই প্রভাব প্রতীয়মান। আলোচ্য প্রদর্শনীতে রাখা কাজগুলিও ব্যতিক্রম নয়, যা শিল্পরসিক দর্শকের কাছে নতুন ভাবনার পরিসর খুলে দেয়।