সে এক অপূর্ব প্রেমকাহিনি! সাংবাদিক রবি বসু লিখেছেন, “আমার চোখের সামনে চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের উজ্জ্বল বিকেলের সেই সব দৃশ্য আজও ছবির মতো ভাসছে। অনুভাদি তখন হলুদরঙা শাড়ি পরে মাঠে যেতেন। মোহনবাগান সেন্টার করে খেলা শুরু করল। রাইট হাফ অনিল দে-র পায়ে যখন বল গেল তখন তিনি কিক্ও করলেন না আর পাসও করলেন না। বলের ওপর পা-টি চেপে দাঁড়িয়ে রইলেন। মেম্বার্স গ্যালারির দিকে তাকালেন। সেখান থেকে যতক্ষণ না হলুদবরণা সুন্দরীর হাত ঊর্দ্ধে আন্দোলিত হতে দেখা গেল ততক্ষণ পর্যন্ত বল নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর সুন্দরী যখন উঠে দাঁড়িয়ে হাত দেখালেন, সঙ্গে সঙ্গে গোলার মতো একখানা শট অনিলদার পা থেকে বেরিয়ে এল। সারা মাঠ সেই দৃশ্য দেখে হইহই করে উঠল। এই প্রেমময় দৃশ্যের সাক্ষী আমি নিজে।”
অনুভা গুপ্তর কথা লিখতে বসে এর চেয়ে ভাল প্রস্তাবনা বোধহয় আর হয় না। চল্লিশের দশকে মোহনবাগান টিমের দুর্দান্ত খেলোয়াড় ছিলেন অনিল দে। মাঝ মাঠে ভারতের প্রথম নাগা ফুটবলার টি আও বা টালিমেরেন আওয়ের সঙ্গে অনিল দের জুটি প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করে দিত। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত মোহনবাগানের ক্যাপ্টেন ছিলেন অনিল দে। এহেন জনপ্রিয় ও কৃতী এক ক্যাপ্টেনের প্রেয়সী সুন্দরী অনুভাকে কলকাতা ময়দানের ফুটবলপ্রেমীরা ভাল মতোই চিনতেন। বলা যেতে পারে, পরবর্তী কালের শর্মিলা ঠাকুর- মনসুর আলি খান পতৌদি, ভিভ রিচার্ডস-নীনা গুপ্ত বা আজকের অনুষ্কা শর্মা ও বিরাট কোহালির পূর্বসুরি হলেন চল্লিশের দশকের কলকাতা ময়দানের অনিল-অনুভার জনপ্রিয় জুটি।
সেই কারণেই অনুভা গুপ্ত বাংলা চলচ্চিত্রের পরিচালক ও প্রযোজকদের চোখে পড়েছিলেন ওই মোহনবাগান ক্লাবের গ্যালারি থেকে, ১৯৪৬ সালেই। তার পর তাঁকে নিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র এতটাই মেতে উঠেছিল যে, দেখা যাচ্ছে পরবর্তী ছ’বছরে তিনি চব্বিশটি ছবিতে অভিনয় করছেন। অর্থাৎ প্রতি বছর তাঁর চারটি করে ছবি মুক্তি পেয়েছিল।
অনুভার আসল নাম ছিল মৃদুলা। জন্ম ১৯২৯ (মতান্তরে ১৯৩০) সালের ২৭ ডিসেম্বর অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুর জেলায়, মামার বাড়িতে। বাবার নাম রমেশচন্দ্র গুপ্ত, মা আভা। আভা গুপ্ত কবি ছিলেন, তাঁর কবিতা ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হত। মৃদুলার প্রথাগত শিক্ষা শুরু হয় প্যারীচরণ গার্লস স্কুলে ও তার পর বাণীপীঠ বিদ্যালয়ে। বাবা রেলে চাকরি করতেন বলে তাঁকে চাকরির সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হত। তাই মেয়েকে তিনি শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই ১৯৪৫ সালে মৃদুলা প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেন। ছোট থেকেই তিনি আগ্রহী ছিলেন নাচ, গান ও অভিনয় শিক্ষায়। খেলাধুলো ও শারীরচর্চাও তিনি করতেন। গান শিখতেন ভবানীচরণ দাসের (অনুপকুমারের বাবা) কাছে। নৃত্যশিক্ষা শুরু বঙ্গীয় কলালয়ে। ব্যায়াম ও ড্রাম বাজাতে শিখেছিলেন গুরুদাস মল্লিকের কাছে। শান্তিনিকেতনের শিক্ষা তাঁকে গান ও নাচের দিক দিয়ে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল সন্দেহ নেই। পনেরো বছর বয়সে পাড়ার অ্যামেচার ক্লাবে ‘সিরাজদৌল্লা’ নাটকে আলেয়ার ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ পান, কারণ তিনি ভাল গাইতে পারতেন। ছেলেবেলায় অভিনীত নাটকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিসর্জন’ও আছে।
ডাকাবুকো মেয়ে মৃদুলাকে পাড়ার বাসিন্দা গুরুদাস মল্লিকের বাড়িতে কাঁধে ঝুলিয়ে ড্রাম পেটাতে দেখেছেন অনেকেই। পাড়ার অনুষ্ঠানের শোভাযাত্রায় কাঁধে ড্রাম ঝুলিয়ে প্যারেড করতেন। সাংবাদিক রবি বসু নিজেই তার সাক্ষী। কিন্তু মৃদুলা যে কোনও দিন বাংলা সিনেমার নায়িকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন, তা যেমন রবিবাবু কখনও কল্পনা করেননি, তেমনই মৃদুলা নিজেও কি করেছিলেন?
১৯৪৬ সাল নাগাদ মৃদুলা তাঁর মায়ের সঙ্গে থাকতেন কলকাতার তালতলায় একটি ভাড়াবাড়িতে। রবি বসু সেই বাড়িতেই মৃদুলার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অনিলবাবুর দেখা পেয়েছিলেন। তবে “তাঁদের কখনও বিয়ে হয়নি” বলেই জানিয়েছেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। মৃদুলা ছিলেন মাধবীর অভিন্নহৃদয় বন্ধু। মৃদুলার ‘অভিনেত্রী অনুভা’ হয়ে ওঠার সুত্রপাত যে হয়েছিল মোহনবাগান মাঠে ( তখন ‘ক্যালকাটা মাঠ’ বলে সকলে চিনত), তা মৃদুলার মায়ের জন্যই। কারণ তাঁর মা নিয়মিত মোহনবাগানের খেলা দেখতে মাঠে নিয়ে যেতেন মৃদুলাকে। মাধবী মুখ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “ওঁর মা ছিলেন ফুটবলার অনিল দের ফ্যান। কিছুটা তাঁরই উৎসাহে অনিল দের সঙ্গে মৃদুলার ঘনিষ্ঠতার শুরু।”
মোহনবাগান গ্রাউন্ডে অনুভা, মঞ্জু দে ও শোভা সেন
এই মাঠের গ্যালারি থেকেই মোহনবাগানের সমর্থক সুন্দরী মৃদুলাকে আবিষ্কার করেছিলেন সঙ্গীত পরিচালক রবীন চট্টোপাধ্যায়, প্রযোজক শিশির মল্লিক ও খগেন্দ্রলাল চট্টোপাধ্যায়। এঁরা তাঁদের ‘ডি-ল্যুক্স পিকচার্স’-এর ব্যানারে ‘সমর্পণ’ ছবির জন্য নতুন নায়িকা খুঁজতে বেরিয়ে একদিন বিকেলে মোহনবাগান মাঠে খেলা দেখতে দেখতে হঠাৎই গ্যালারিতে আবিষ্কার করেন প্রাণবন্ত, সুন্দরী মেয়েটিকে। যতক্ষণ খেলা চলছিল, শিশির মল্লিক, খগেন্দ্রলাল ও রবীন চট্টোপাধ্যায় খেলা ভুলে নাকি তাকিয়ে ছিলেন মৃদুলার দিকে। তাঁর প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি, হাসি, ওঠাবসা সবই খুঁটিয়ে লক্ষ করেছিলেন।
খেলা শেষে তিনজন হাজির হয়েছিলেন মৃদুলার সামনে। তিন অপরিচিতকে দেখে তিনি কিছুটা ভীত হয়ে পড়েছিলেন। এর পরে তাঁরা যখন তাঁকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন, তিনি খুবই অবাক হয়ে যান। মৃদুলা অনুষ্ঠানে নেচেছেন, পাড়ায় থিয়েটার করেছেন, ১৯৪৪ সালে গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য ‘সম্রাট অশোক’ ছবিতে তাঁকে দিয়ে প্রথম প্লেব্যাকও করিয়েছিলেন। দেবকী বসুর সহকারী অপূর্বকুমার মিত্র পরিচালিত দ্বিভাষিক ‘সন্ধি’ ছবির জন্যও প্লেব্যাক করেছিলেন। সে ছবি বক্স অফিসে সাফল্য পেয়েছিল। এ ছাড়া ‘কর্ণার্জুন’ ছবিতেও গান গেয়েছিলেন তিনি। তখন ইচ্ছে হয়েছিল কাননদেবীর মতো তিনিও বড় গায়িকা হবেন একদিন। কিন্তু সিনেমায় অভিনয়? এমন কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। তবে শিশির মল্লিক জোর করেছিলেন। সাহস জুগিয়েছিলেন।
তখন বাংলা সিনেমায় কাননদেবী, চন্দ্রাবতীদেবী, মলিনাদেবীর মতো বিরাট মাপের অভিনেত্রীদের সঙ্গে রেণুকা, সন্ধ্যারানি, পদ্মাদেবীর রমরমা বাজার। তাঁদের নামেই ছবি হিট হয়ে যায়। এঁরা থাকতে মৃদুলাকে কেন বেছে নেওয়া হচ্ছে, তা ভেবে পাননি। তাই এই প্রস্তাবকে তিনি একটা খেলনা পাওয়ার মতোই মনে করে মজা পেয়েছিলেন।
মৃদুলা গাইতে পারেন, নাচতে পারেন জেনে শিশির মল্লিক, রবীন চট্টোপাধ্যায়দের উৎসাহটা বেড়ে গিয়েছিল। কারণ নতুন নায়িকা পাওয়া তাঁদের কাছে তখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। রবি বসু লিখেছেন, “১৯৪৬ সালে কানন দেবী, চন্দ্রাবতী দেবী আর মলিনা দেবীর তখন নায়িকা হিসেবে পড়ন্ত বেলা।” কিন্তু রেণুকা ও সন্ধ্যারানির জমজমাট বাজার হলেও ‘সমর্পণ’-এর নায়িকাকে আরও কমবয়সি হতে হবে। নতুন মুখ হিসেবে “ভারতীদেবী আর সুনন্দা ব্যানার্জি তখন বেশ নাম করেছেন। কিন্তু তাঁরা দু’জনেই নিউ থিয়েটার্সের আর্টিস্ট।”
স্বামী রবি ঘোষের সঙ্গে। ডান দিকে, ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবিতে উত্তমকুমারের সঙ্গে
ফলে নতুন এক নায়িকাকে তৈরি করে নেওয়ার দরকার ছিল নিউ থিয়েটার্সের বাইরে অন্যান্য প্রযোজকদের। কাননদেবীর যুগের অবসানের পর সুচিত্রা সেনের যুগ শুরু হওয়ার মধ্যবর্তী কালে পরিচালক ও প্রযোজকরা মৃদুলাকে ‘অনুভা’য় বদলে নিয়ে চলচ্চিত্র ব্যবসার অনিশ্চয়তাকে কাটাতে চেয়েছিলেন। ‘সমর্পণ’ ছবিতে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে মৃদুলা তাঁর মায়ের ‘আভা’ নামটিকে ‘অনুভা’ করে নিয়েছিলেন প্রযোজকদের অনুরোধে। ‘সমর্পণ’-এর পরিচালক ছিলেন নির্মল তালুকদার। এই ছবিতে অনুভা অভিনয় করেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী, কমল মিত্র, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, কৃষ্ণধন মুখোপাধ্যায়, নরেশ মিত্রের মতো বাঘা বাঘা অভিনেতার সঙ্গে।
তবে ১৯৪৬ সালে শুটিং হলেও ছবিটির মুক্তি পেতে সময় লেগেছিল বেশ কিছু কাল। তাই দেখা যাচ্ছে, ১৯৪৮ সালে তাঁর প্রথম মুক্তি পাওয়া ছবির নাম গুণময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিশ বছর আগে’। ওই বছরেই আরও একটি ছবির খবর পাওয়া যাচ্ছে, যার নাম ‘মায়ের ডাক’। সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় এই ছবিতে অনুভা গুপ্ত অভিনয় করেছিলেন উমা মুখোপাধ্যায় ও অভি ভট্টাচার্যর সঙ্গে। রবি বসুকে অনুভা জানিয়েছেন, “আমি প্রথম কন্ট্রাক্ট করি ‘সমর্পণ’ ছবিতে। কিন্তু নানা কারণে ছবিটা তৈরি হতে দেরি হয়ে যায়। ‘বিশ বছর আগে’ আমার দ্বিতীয় ছবি। কিন্তু রিলিজ করে ‘সমর্পণ’-এর আগে।” তবে ওই বছরেই ‘মায়ের ডাক’ ছবিটিও রিলিজ় করেছিল। ১৯৪৮ সালে অনুভার প্রথম দু’টি ছবি ‘বিশ বছর আগে’ ও ‘মায়ের ডাক’ মুক্তি পেয়েছিল।
কিন্তু এই দু’টি ছবি বাংলার প্রযোজক ও পরিচালকদের নজর ঘুরিয়ে দিয়েছিল অনুভার দিকে। এই নতুন মুখকে নিজেদের ছবিতে কাজ করাতে তৎপরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, দেখা যাচ্ছে পরের বছর ১৯৪৯ সালে অনুভা অভিনীত ছবির সংখ্যা হয়ে গিয়েছে পাঁচ। ছবিগুলি হল, ‘সমর্পণ’ (পরিচালনা নির্মল তালুকদার), ‘কবি’ (পরিচালনা দেবকী বসু), কাননদেবীর ‘শ্রীমতী পিকচার্স’-এর ব্যানারে ‘বামুনের মেয়ে’ (পরিচালনা অজয় কর), ‘অনন্যা’ (পরিচালনা অজয় কর), ও ‘আভিজাত্য’ (পরিচালনা সুকুমার দাশগুপ্ত)। এই তথ্য থেকে নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, সেই সময়ের দুই দিকপাল পরিচালক দেবকী বসু ও অজয় কর এবং কানন দেবীর মতো প্রভাবশালী প্রযোজকের ছবিতে কাজ করার ডাক নবাগতা অভিনেত্রী অনুভা গুপ্তকে বাংলা সিনেমায় নতুন নায়িকার আসনের স্থানটি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল মাত্র এক বছরেই।
দেবকী বসুর সঙ্গে অনুভার প্রথম সাক্ষাতের কথা তিনি শুনিয়েছিলেন রবি বসুকে। “উনি প্রথমে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন সাহিত্য-টাহিত্য পড়ি কিনা? তা সাহিত্য বলতে আমি তখন শরৎবাবুর কিছু বই পড়েছি। সিনেমা দেখার আগে বঙ্কিমবাবুর ‘চন্দ্রশেখর’ পড়েছি। আর ছোটবেলায় নীহাররঞ্জন গুপ্তের বই খুব পড়তাম। ‘কালো ভ্রমর’ আমার দারুণ লেগেছিল। সেই কথা বললাম।” ভয়ে অনুভা ঘামতে শুরু করেছিলেন। তাঁর অবস্থা দেখে দেবকীবাবু লেমনেড আনিয়ে অনুভাকে খেতে দেন। তার পর টেবিল থেকে একটি বই তুলে এগিয়ে দিয়ে বলেন, “এই বইটা এখনকার একজন বিখ্যাত সাহিত্যিকের লেখা। তাঁর নাম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ওঁর এই ‘কবি’ উপন্যাসটি এক অসাধারণ সৃষ্টি। আমি এটার ফিল্ম করব। বইটা তোমাকে পড়তে দিচ্ছি। সাতদিন পরে ফেরত চাই।”
উপন্যাসটি পড়ে অনুভার ইচ্ছে হয়েছিল ‘বসন’ চরিত্রে অভিনয় করার। কিন্তু দেবকী বসু তাঁকে ‘ঠাকুরঝি’ নির্বাচন করেন। ‘কবি’ ছবিতে ঠাকুরঝি চরিত্রে অনুভার অভিনয় আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। তাঁকে দেবকীবাবু কী ভাবে গড়ে নিয়েছিলেন, তার স্মৃতি রয়ে গিয়েছে দেবকী বসুর পুত্র চলচ্চিত্রকার দেবকুমার বসুর কাছে। “মনে পড়ে অনুভাদিকে বাবার কাছে পাঠিয়েছিলেন কাননদেবী। বাবাকে দেখেছি, অনুভাদির সঙ্গে অভিনয়ের ব্যাপারে কথা বলার আগে ওঁকে চরিত্রটি সম্পর্কে বুঝিয়ে বলতে। বাবার প্রায় পায়ের কাছে বসে উনি শুনছেন। তখন তো উনি নতুন। দেখেছি, কী মন দিয়ে শুধু শুনে যাচ্ছেন। বাবা তাঁকে ছবির একটা গান, ‘এই খেদ মোর মনে/ভালবেসে মিটল না আশ, কুলাল না এ জীবনে।/ হায়, জীবন এত ছোট কেনে?/ এ ভুবনে?’ কথা বলছেন। গানটি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়েরই লেখা। ছবিতে গেয়েছিলেন মান্না দে। গানে ওই যে ‘জীবন এত ছোট কেন?’ এই প্রশ্নটি নিয়ে বাবা ঠাকুরঝি চরিত্রটিকে বোঝাচ্ছেন আর অনুভাদি অবাক হয়ে শুনছেন, সেই ছবিটা এখনও আমার চোখে ভাসে। ‘কবি’ ছাড়া আরও একটি ত্রিভাষিক ছবি ‘রত্নদীপ’-এ অনুভাদি কাজ করেছিলেন বাবার সঙ্গে। সে ছবিও দারুণ হিট হয়েছিল। খুব নাম করেছিলেন।”
কাননদেবী খুব স্নেহ করতেন অনুভাকে। আবার অনুভা গুপ্তর জীবনে কাননদেবী ছিলেন স্বপ্নের মানুষ। তিনি ছোট থেকেই তাঁর মতো গায়িকা হতে চেয়েছিলেন। সেই কাননদেবী যখন তাঁর নতুন প্রযোজনা সংস্থা ‘শ্রীমতী পিকচার্স’-এর ব্যানারে ছবি করবেন বলে ঠিক করলেন এবং প্রথম দু’টি ছবি ‘অনন্যা’ ও ‘বামুনের মেয়ে’তে নবাগতা অনুভাকে অভিনয়ের সুযোগ করে দিলেন, তিনিও সেই কিংবদন্তি নায়িকার সঙ্গে প্রথম ছবিটিতে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন।
এর পরে অনুভা ক্রমশই বাংলা সিনেমার অপরিহার্য অভিনেত্রী হয়ে উঠতে লাগলেন। দেবকী বসু, শৈলজারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, অজয় কর থেকে শুরু করে বাংলা সিনেমার সেই সময়ের সেরা পরিচালকরা অনুভাকে নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। লক্ষ করলে দেখা যাবে, ১৯৪৮ সালে তাঁর প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির বছরে দু’টি ছবি মুক্তি পাওয়ার পরে ১৯৪৯ সালে পাঁচটি ছবি মুক্তি পাচ্ছে। ১৯৫০-এ চারটি, ১৯৫১ থেকে ১৯৫৫র মধ্যে মোট ষোলোটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। ১৯৫৫ সালে অমর মল্লিকের হিন্দি ভাষায় তৈরি ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ ছবিটি প্রশংসিত হয়। এই ছবিতেও অনুভা তাঁর প্রতিভার পরিচয় রেখেছিলেন।
অনুভা অভিনীত উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলির মধ্যে ললিতা (‘সমর্পণ’) ১৯৪৯, সন্ধ্যা (‘বামুনের মেয়ে’) ১৯৫০, সুনন্দা (‘সুনন্দার বিয়ে’) ১৯৫১, চন্দ্রাবতী (‘কবি’) ১৯৫২, মাধবী (‘মা ও ছেলে‘) ১৯৫৪, কাদম্বিনী (‘চাঁপাডাঙ্গার বউ’) ১৯৫৪, কল্যাণী (‘অনুপমা’) ১৯৫৫, জবা (‘সাহেব বিবি গোলাম’) ১৯৫৬, নবলা (‘ত্রিযামা’) ১৯৫৬, অণিমা (‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’) ১৯৬২, মালতী (‘দিবারাত্রির কাব্য’) ১৯৭০ ইত্যাদি।
১৯৫৬, ’৫৭, ’৫৮ সালে মোট সাতটি ছবি মুক্তির পরেই তিনি কাজ শুরু করেন তপন সিংহের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ ও সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে। ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে যা মুক্তি পায়। তরুণ মজুমদারের ‘পলাতক’, মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ৭১’-এর মতো অনেক ছবির কথা মনে আসে, যা অনুভা গুপ্তর অনবদ্য অভিনয়ে সমৃদ্ধ হয়ে আছে। ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ ছবির জন্য তিনি বিএফজেএ পুরস্কার পান। এই ছবিতে অনুভার সঙ্গে কাজ করেছিলেন লিলি চক্রবর্তী। তাঁর স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে অনুভার কথা, “এই ছবিতে আমি প্রথম অনুভাদির সঙ্গে কাজ করি। তারাশঙ্করবাবুর লাভপুরে আমরা আউটডোরে গিয়েছিলাম। সেখানে একটা ধর্মশালার মতো খালি বাড়ি পরিষ্কার করে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। একটা ঘরে আমরা মেয়েরা থাকতাম। আমি, রঞ্জনা, অনুভাদি আর নিভাননীদেবী। সেইখানেই প্রথম দেখা হয় আমাদের। অনুভাদি খুব মিশুকে মানুষ ছিলেন। রান্নাবান্নায় এক্সপার্ট। আউটডোরে শুটিং না থাকলে সকলের জন্য রান্না করতেন। একটা বড় বারান্দা ছিল, সেখানে শতরঞ্চি পেতে রাতের খাওয়াটা একসঙ্গে খাওয়া হত। ডিরেক্টর, ক্যামেরাম্যান থেকে টেকনিশিয়ানরা সবাই। খুব যত্ন নিতেন সকলের। কোনও সমস্যা হলে ওঁকে বললেই সমাধান মিলে যেত। ওখানেই রবিদার (ঘোষ) সঙ্গে ওঁর আলাপ হয়। তার পর বিয়ে।”
মাধবী মুখোপাধ্যায়ের কাছে অকপটে নিজের দুঃখের কথা বলতেন তাঁর অনুভাদি, ‘‘অনিল দে খুবই অত্যাচার করতেন অনুভার উপরে। রবি ঘোষের সঙ্গে বিয়ের পরেও চেষ্টা করে গিয়েছেন কী করে ওকে ফিরিয়ে আনা যায়। আমার বাড়ি অবধি ধাওয়া করেছেন, অনুভাদি কোথায় আছে তার হদিশ পেতে। ওঁর ব্যক্তিজীবনের কথা খুব বেশি জানা যায় না। এক বোন ছিলেন, তিনি অভিনয়ের দিকে আসেননি।”
অশান্তির কারণে অনুভা গুপ্ত এক সময়ে নিজের করা দক্ষিণ কলকাতার বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। “রবি ঘোষের সঙ্গেও বিয়ের ব্যাপারে প্রথমে রাজি ছিলেন না। বলতেন, বন্ধু হিসেবে থাকবেন। আমি বলেছিলাম আমাদের বাঙালি সমাজ এই ধরনের সম্পর্ক মেনে নেয় না। ওঁদের যখন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠছে, সেই সময়টায় অনুভাদি, রবি ঘোষ, আমি একসঙ্গে বেরিয়েছি। ওঁরা দু’জনে গল্প করছেন আর আমি একটু দূরে চলে গিয়েছি ওঁদের একা থাকতে দিয়ে। তবে বিয়ের পরে ক্রমশ রবি ঘোষের সঙ্গে সম্পর্কটাও খারাপ হয়ে যায়।”
ছেলেবেলার ‘খেলোয়াড় অনুভা’ চিরকালই তাঁর মধ্যে বেঁচে ছিল। ১৯৫৩ সালে বিহারীলাল আগরওয়ালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ১৯৫২ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের অঙ্গ হিসেবে চলচ্চিত্রের কলাকুশলীদের নিয়ে যে স্পোর্টসের আয়োজন হয়েছিল, সেখানে অনুভা সর্বাধিক ইভেন্টে জিতেছিলেন এবং মেয়েদের ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান করেছিলেন।
ষোলো বছর বয়সে অভিনয় জীবন শুরু করে মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে তাঁর ছাব্বিশ বছরের অভিনয় জীবন হঠাৎই থেমে যায় ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি। তাঁর অকালপ্রয়াণ নিয়ে ১৬ জানুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়, ‘জনপ্রিয় সুখ্যাত অভিনেত্রী শ্রীমতী অনুভা ঘোষ (গুপ্ত) শুক্রবার রাত্রে কলকাতার গড়িয়াহাট নার্সিংহোমে পরলোকগমন করেন। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ তাঁর মৃত্যুর কারণ। বৃহস্পতিবার শেষ রাত্রে শ্রীমতী ঘোষ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে উক্ত নার্সিংহোমে স্থানান্তরিত করা হয়। শ্রীমতী ঘোষের বয়স হয়েছিল ৪২ বছর।”
অনুভা গুপ্তর মৃত্যু এতই আকস্মিক ছিল যে, বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ ও তাঁর স্বজনবন্ধুরা মেনে নিতে পারেননি। তখন তিনি থাকতেন কলকাতার কবীর রোডে। দেবকী বসুর পুত্র দেবকুমার বসুর কথায়, “আমি শুনেছিলাম উনি তখন একাই থাকতেন কবীর রোডের একটি বাড়িতে। অসুস্থ হয়েছেন, খুবই মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আছেন। ওঁর শেষ দিকের ছবিগুলি দেখলে বোঝা যায় ওঁর চেহারা কত খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমার ইচ্ছে ছিল একবার যাব দেখা করতে। কিন্তু যাওয়ার আগেই সেই মর্মান্তিক খবরটা পেয়েছিলাম।”
মাধবী মুখ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “ওঁর অকালপ্রয়াণ নিয়ে সংশয় থেকে গিয়েছে। মঞ্জু দের সঙ্গে ওঁর গভীর বন্ধুত্ব ছিল। ওঁরা কেউ কিন্তু এই মৃত্যুটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারেননি। অনুভাদি বেঁচে থাকতে মঞ্জুদি বলতেন, ‘ও কেমন আছে কেউ-ই বলতে পারবে না, ও যদি নিজে কখনও বলে, তখনই জানতে পারা যাবে। বোঝা যাবে।’ অথচ আমি জানি উনি ভীষণ ভাবে একটা সুন্দর সংসার করতে চেয়েছিলেন।”
মুম্বইয়ের ‘সিনেস্তান’ পত্রিকার জন্য অনুভা গুপ্তর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে সাংবাদিক বিহারীলাল আগরওয়ালেরও মনে হয়েছিল “একজন সফল অভিনেত্রীর গুমর ওঁর স্বভাবে ছিল না। সাধারণ, সহজ, স্বাস্থ্যে ভরপুর, চঞ্চল, প্রাণবন্ত, সকলের কুশলকামী মানুষটির ধ্যানজ্ঞান ছিল তাঁর সংসার।”
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক তাঁর আর এক শুভানুধ্যায়ীর মতে, অনুভার আকস্মিক মৃত্যুর পিছনে এক করুণ কাহিনি লুকিয়ে আছে। যাকে তাঁর সেই অনাস্বাদিত সংসার জীবনের না পড়া কয়েকটা ছেঁড়া পাতা হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। কালের হাওয়ায় আজ তা কোথায় যেন উড়ে গিয়েছে!
ঋণ স্বীকার
সাতরং - রবি বসু
সিনেস্তান পত্রিকা