মোহন-ইস্ট, ১৯৭৭,সমরেশ চৌধুরী-বিদেশ বসুর বল দখলের লড়াই
ম্যাচের দিন নুন শো-তে সিনেমা দেখে হোটেলে বিরিয়ানি খেয়ে পায়ে হেঁটে ফটর ফটর করতে করতে মাঠে চলে যেতেন সমরেশ চৌধুরী!
সুরজিৎ সেনগুপ্তর বাবা শৈলেন মান্নার নামে ডায়েরিই করে দিলেন হেয়ার স্ট্রিট থানায়! অভিযোগ?
শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগানের পাঁচ গোলে হারের পর আত্মহত্যা করে বসেন এক সবুজ-মেরুন সমর্থক! তাঁর সুইসাইড-নোটটি আজও অবিশ্বাস্য শোনায়!
সত্তর দশকের ময়দান মানেই এমনই সব কাহিনি। অভিযোগ। পাল্টা অভিযোগ। অবেগ। ভাঙচুর। টান টান উত্তেজনায় ঠাসা বিচিত্র সব জীবনের উপাখ্যান!
আজকের ভারতীয় দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে সত্তরের ফুটবলারদের জনপ্রিয়তার যদি তুলনা করি, কেউ অবাক হবেন না।
সুরজিৎ সেনগুপ্তকে ট্রেন ধরার জন্য ছুটতে দেখে ইএমইউ লোকালের গার্ড এমার্জেন্সি ব্রেক কষে ট্রেন দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, এমন দৃশ্যও দেখেছি।
তখনকার ফুটবলারদের এখনকার খেলোয়াড়দের যেমন, তেমন মুড়ি মিছরির মতো গাড়ি ছিল না।
সমরেশ চৌধুরী মানে পিন্টু চৌধুরী তো বড় ম্যাচের দিনও নুন শোতে টাইগারে সিনেমা দেখে আমিনিয়ার বিরিয়ানি খেয়ে হাওয়াই চটি ফটর ফটর করতে করতে মাঠে গিয়ে জার্সি পরে বাঘ হয়েছে।
আসলে তখনকার ফুটবলারদের জীবনচর্যাতেও ছিল এক অসাধারণ বোহেমিয়ানিজম, রোম্যান্টিকতা, যা তাদের কিংবদন্তি চরিত্রে পরিণত করেছিল।
কত গল্প-গাথা এই ফুটবলারদের নিয়ে!
প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি মরসুম শুরুর দিন সব ফুটবলারকে একটি পরীক্ষার সামনে ফেলতেন। ইস্টবেঙ্গল তাঁবুর ড্রেসিংরুমের সামনে পাপোশটি দেখিয়ে বলতেন, এর ইংরেজি কী? সব ফুটবলারই নাকি বলতেন, ওয়েলকাম! কে জানে, নিশ্চয় গল্পই হবে!
আসলে সত্তরের দশকটিকে আরও বর্ণময়, আরও আকর্ষণীয় করেছে ফুটবলারদের সম্পর্কে নানা মিথ, নানা গল্প।
তখন মোহনবাগান মেসে, অর্থাৎ রয়েড স্ট্রিটের মেসে থাকত হাবিব-আকবর। সাংবাদিকদের সঙ্গে হাবিবদার সম্পর্কটি ছিল অনেকটা অহি-নকুলের মতোই। কেন জানি না, সাংবাদিকদের খুব একটা পছন্দ করতেন না হাবিবদা।
মোহনবাগান মেসে সুব্রত ভট্টাচার্যের সঙ্গে গল্প করতে প্রায়ই যেতাম। আমাকে দেখে হাবিবদার সেই চোখ কুঁচকে তাকানোটা আজও দেখতে পাই।
সুব্রত, মানে বাবলুর কড়া অভিভাবক ছিলেন হাবিবদা। দুপুরের খাওয়া সাড়ে বারোটার মধ্যে শেষ না করলে দানাপানি বন্ধ।
সন্ধে সাড়ে ছ’টার পর মেসে ঢুকলে রাতের মিল একদম নো...। কত দিন যে সুব্রত রয়েড স্ট্রিটের মেসের পিছন দিকের ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে, তার ইয়ত্তা মেলা ভার। মোহনবাগানের যেমন রয়েড স্ট্রিটে মেস ছিল, মহমেডানের তেমনই ছিল ইলিয়ট রোডে।
ইস্টবেঙ্গল একটা সময়ে মেস করেছিল গড়িয়াহাটের কাছে, তার পর তারা মেস তুলে দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন ফ্ল্যাটে রাখত খেলোয়াড়দের।
শ্যাম থাপার সেই ঐতিহাসিক ব্যাকভলি ইস্টবেঙ্গলের জালে ঢোকার মুহূর্তে
মেসে মূলত ভিন রাজ্যের ফুটবলাররা থাকত। কলকাতা কিংবা শহরতলির ছেলেরা বাড়ি থেকেই আসা-যাওয়া করত। ব্যতিক্রম ছিল শুধু সুব্রত ভট্টাচার্য। বরাবরই মেসে থেকেছে সুব্রত। মেসই হয়ে উঠেছিল তার ঘরবাড়ি।
ছিয়াত্তর সালে পটনায় বসেছিল সন্তোষ ট্রফির আসর। সাংবাদিক হিসেবে সেটাই ছিল আমার প্রথম ট্যুর।
বিহারের রাজধানীতে মিনি কলকাতা বসতে দেখেছিলাম সে বার। পটনার ফ্রেজার রোডের কাছে প্রিন্স হোটেলে ছিল বাংলা দল। সে সময় সন্তোষ ট্রফির পরেই ছিল কলকাতার ফুটবলের দলবদল।
কলকাতার ফুটবল রিক্রুটাররা সন্তোষ ট্রফির মাঝপথেই হাজির হয়ে গিয়েছিলেন পটনায়। ইস্টবেঙ্গলের রিক্রুটিঙের দায়িত্বে তখন এসে গেছেন জিপ জুটি। জীবন চক্রবর্তী-পল্টু দাস।
যদিও কর্মকর্তা হিসেবে পল্টু দাসের স্বর্ণযুগের শুরু আশির দশকে, কিন্তু সেই সত্তরেও তিনি বেশ সমীহ জাগানো নাম।
প্রিন্স হোটেলের লনে রঙিন ছাতার তলায় বসে সারাদিন ধরে দু’জনে চা খান আর ইস্টবেঙ্গলের খেলোয়াড়দের চোখে চোখে রাখেন।
তাঁদের বিশেষ নজর শ্যাম থাপার দিকে। কেননা সেই ১৯৭৬ সালে শ্যাম থাপা মোহনবাগানের এক নম্বর টার্গেট। নজর এড়িয়ে কিন্তু পাখি পালালো।
ফাইনালের রাতে বাংলা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর প্রিন্স হোটেলে সবাই যখন উৎসবে মগ্ন, তখনই বাংলা দলের মোহনবাগানের ফুটবলার প্রদীপ চৌধুরীর রুমের টয়লেটের পিছনে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে শ্যাম থাপা পগার পার।
হ্যাঁ, দেহরাদূন থেকে একটা টেলিগ্রাম নাকি এসেছিল শ্যামের ঠাকুমার প্রায় শেষ শয্যার খবর জানিয়ে!
এই রকম ঠাকুমা-দিদিমাদের শেষ শয্যায় থাকার টেলিগ্রাম-টেলিফোন সেই সময় প্রায়ই আসত দলবদলের মরসুমে।
এই শ্যাম থাপাই সত্তরের দশককে মাতিয়ে দিয়েছিল তার ব্যাকভলিতে গোল দিয়ে। ক্ষিপ্র, ঋজু এবং নমনীয় শরীরটিকে বাতাসে ভাসিয়ে ব্যাকভলিতে শ্যামের সেই সব গোল সত্তরের দশককে সমৃদ্ধ করেছিল। পোশাকি নাম ছিল এলসোনিয়ান ভলি।
কলকাতার ফুটবলে যখন ব্রিটিশ দলগুলির রমরমা, তখন এলসন নামের এক সাহেব ফুটবলার নাকি ব’লে ব’লে এই রকম ব্যাকভলিতে গোল করতেন। সেই কারণে এই ব্যাকভলির নাম এলসোনিয়ান ভলি হয়ে গিয়েছিল।
সত্তর দশকে শ্যাম থাপার ব্যাকভলির কারণে এই শটের নাম অনায়াসে হয়ে যেতে পারত শ্যামিয়ান ভলি।
সেই সময়ের ফুটবলকে আরও উত্তেজক, আরও রোমহর্ষক, আরও শিহরন সৃষ্টিকারী করেছিল দলবদলের ১৫টি দিন, পয়লা মার্চ থেকে ১৫ মার্চ।
প্রথমে দলবদল হত প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে আইএফএ অফিসে। কিন্তু প্রায়ই সেখানে দলবদলকে কেন্দ্র করে রক্তারক্তি, বোতল ছোড়াছুড়ি, বোমার লড়াই, কাঁদানে গ্যাস চলায়, দলবদল সরিয়ে আনা হয় নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে।
সেই পনেরোটা দিন তখন সত্তরের ফুটবল উত্তেজনার পারদস্তম্ভকে কোথায় যে চড়িয়ে দিত! নেতাজি স্টেডিয়ামের ক্যাম্প অফিসের ভেতরে ঢোকার অনুমতি ছিল না কারও, এমনকী সাংবাদিকদেরও না।
বাইরে উৎসাহী ক্লাব সমর্থক জনতার ভিড়। সেখানেও ভাগাভাগি। এক দিকে মোহনবাগান, তো অন্য দিকে ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান জনতাও এ দিক ও দিক ছড়িয়েছিটিয়ে।
হঠাৎ হঠাৎ গুঞ্জন উঠত— ওই আসছে। গাড়ির কনভয় আর মাসলম্যানদের নিয়ে ফুটবল রিক্রুটার কর্মকর্তারা। অন্য দলের তারকা ফুটবলার নতুন দলে সই করলেই নিমেষে বোমা পটকা ইটের বৃষ্টি। ঘোড়পুলিশের ছুটে যাওয়া। উল্টো ছবিও ছিল— আবিরের বন্যা, ফুলের মালা, সই করানোর পরই খেলোয়াড়কে নিয়ে কর্মকর্তার অদৃশ্য হওয়াটা তখন রেওয়াজ। তার পর দিন তিনেকের অজ্ঞাতবাস। কারণ তখনও উইথড্র পদ্ধতি চালু। সই করার তিন দিনের মধ্যে পুরনো দলে ফিরে যেতে পারে ফুটবলার। তাই সাবধানতার মার নেই।
তারকাদের ক্ষেত্রে আবার কখনও কখনও ক্লাবই ঝুঁকি নিত না। প্রথম দু-এক দিনের মধ্যেই উইথড্র করিয়ে নিত খেলোয়াড়কে। একবার উইথড্র হয়ে গেলে আর সেই ফুটবলার সেই মরসুমে অন্য দলে যেতে পারবে না।
কত রোমহর্ষক নাটক, কত চোখের জল ঝরেছে সত্তরের দশকে এই দলবদলকে কেন্দ্র করে। খেলোয়াড় রিক্রুটের ব্যাপারে ইস্টবেঙ্গলও তখন অনেক বেশি আক্রমণাত্মক ছিল।
জীবন-পল্টু জুটির বহু কাহিনি তো মিথ হয়ে আছে। ইস্টবেঙ্গলের এই মৌরসি পাট্টায় নব্বই দশকের গোড়ায় ধাক্কা দেয় টুটু বসু মোহনবাগানের হাল ধরার পর।
তার আগে পর্যন্ত মোহনবাগান ভরসা করত ‘হুঁ হুঁ আমি গজু বসু’র স্কিল, ডজ আর ট্যাকেলের ওপর। শৈলেন মান্না-চুনী গোস্বামীর আবেদন কিংবা অ্যাপিলের ওপর। আর ধীরেন দে-র মস্তিষ্কের ওপর। টুটু বসুরাই প্রথম হাইজ্যাক করেন ইস্টবেঙ্গলের স্ট্র্যাটেজি।
সুরজিৎ সেনগুপ্ত খিদিরপুর খেকে এসে প্রথম বড় ক্লাবের জার্সি গায়ে দিয়েছিল মোহনবাগানের। শৈলেন মান্নার চোখে পড়ে গিয়েছিল সুরজিৎ। মান্নাদার ব্যবস্থাপনাতেই সুরজিৎ মোহনবাগানে যায়। কিন্তু কেন জানি না, সুহাস সেনগুপ্ত, সুরজিতের বাবা, যিনি নিজেও ক্রিকেট-ফুটবল খেলেছেন, শৈলেন মান্নার নামে কিডন্যাপিং-এর ডায়েরি করেছিলেন হেয়ার স্ট্রিট থানায়।
ব্যাপারটা কম হইচই ফেলেনি। আসলে ইস্টবেঙ্গলেরও যে টার্গেট ছিল সুরজিৎ! পরের মরসুমেই অবশ্য সুরজিৎ ইস্টবেঙ্গলে যায়। এই রকম আরও কত ঘটনা সত্তরকে রোমাঞ্চিত করেছে।
আমার আজও মনে হয়, কলকাতার ফুটবলে যে দিন থেকে এই দলবদলের প্রথা তুলে দিয়ে টোকেন সিস্টেম চালু করা হল, সে দিনই কলকাতার ফুটবলের হারাকিরি শুরু হল। এক থেকে পনেরো কিংবা পনেরো থেকে তিরিশ মার্চ হত দলবদল। তার পর পয়লা বৈশাখে বার পুজোর দিনে গোটা ফুটবল দলটিকে চেনানো হত সমর্থকদের। ইস্টবেঙ্গল অথবা মোহনবাগান যে দলেরই কোচিং করেছেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, পয়লা বৈশাখের সকালে মাইক হাতে তিনি রসিকতার বান ছুটিয়ে খেলোয়াড়দের পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন সমর্থকদের কাছে।
সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য। গ্যালারি প্রায় ভর্তি। খেলোয়াড়রা সিঁদুরের ফোঁটা কপালে পরে দাঁড়িয়ে আছে। পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। কলকাতার ফুটবলে সত্তরের এই ছবি আজও অম্লান, অক্ষত। যদিও আজকের দিনে বার পুজোর ব্যাপারটি প্রায় রিচ্যুয়ালে পরিণত হয়েছে।
বড় ম্যাচে পুলিশ প্রহরায় রেফারি-লাইন্সম্যান
কলকাতা লিগ শুরুর আগে কেরলে সেইট নাগজি ট্রফি, তার পর কলকাতা লিগ, রোভার্স, ডুরান্ড, ডিসিএম। মাঝখানে বরদলুই ট্রফি গুয়াহাটিতে। জমজমাট ফুটবল মরসুম। ভরা সংসার। সমর্থকরা হাতের কড় গুনতেন কোন দল ক’টা ট্রফি ঘরে তুলল। এ সবই এখন ডোডো পাখির মতো অদৃশ্য। সেই কথাটা ধার করতেই হল— আধুনিক ফুটরবল দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।
আবেগের এক অসাধারণ চিত্রকল্প দেখেছিলাম ১৯৭৬ সালে ইডেনে দীর্ঘ দিন পর মোহনবাগান তাদের চির প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গলকে হারানোর পর। ওই ম্যাচে সতেরো সেকেন্ডে আকবর গোল করেছিল মোহনবাগানের হয়ে। ওই এক গোলেই হারজিত। পর দিন খবরের কাগজে অজয় বসুর সেই বিখ্যাত হেডিং— ইডেনের বাদশা আকবর। সে দিন ম্যাচের শেষে মোহনবাগান জনতা যেন ইডেন থেকে তাঁবুতে ফিরে ছিল আবেগের ঘোড়সওয়ার হয়ে। সদ্য মুম্বইয়ের ক্লাব থেকে আসা প্রদীপ চৌধুরীর হাত, কাঁধ থেকে প্রায় খুলে গিয়েছিল সমর্থকদের আদরের আতিশয্যে। বছর সত্তরের এক বৃদ্ধ কিংসওয়েতে দাঁড়িয়ে অঝোর ধারায় কেঁদেছিলেন— ‘আমার মোহনবাগান জিতেছে’ বলে। সত্তরের দশকের ফুটবল-উন্মাদনার এর থেকে ভাল বিজ্ঞাপন আর কী’বা হতে পারে!
১৯৭৫-এর শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগান পাঁচ গোল খাওয়ার পর বরানগরের যুবক উমাকান্ত পালধি আত্মহত্যা করেন। তার সুইসাইড নোটে লেখা ছিল— ‘পরের জন্মে যেন মোহনবাগানের ফুটবলার হয়ে ইস্টবেঙ্গলকে গোল দিতে পারি।’ সত্তরেই বোধ হয় এটা সম্ভব ছিল।
১৯৭৬ সালে আদ্যন্ত ইস্টবেঙ্গলি সমরেশ চৌধুরী মোহনবাগানে সই করে। ১৯৭৬ সালে প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোচ হিসেবে নিয়ে আসার পর মোহনবাগান তুলে নেয় হাবিব, আকবর, সুভাষ ভৌমিক, সমরেশকে।
সমরেশ চৌধুরী যে ইস্টরবেঙ্গল ছাড়বে, তা কেউ ভাবতে পারেনি। কিন্তু যে দিন ইস্টবেঙ্গল তাঁবুর লকার রুম থেকে বুট জোড়া আর হোস নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে পিন্টু, সে দিন ইস্টবেঙ্গলের হেড-মালি শঙ্কর পিল্লাইয়ের কী কান্না! এও বোধ হয় সত্তর বলেই সম্ভব ছিল। খেলোয়াড়দের বুক দিয়ে আগলাত এই শঙ্করদা। যাকে শ্যামল ঘোষ ‘বাবা’ বলে ডাকত। সত্তরের ফুটবলের কথা বলতে গেলে শঙ্কর পিল্লাইয়ের কথা না বললে, তা রাম ছাড়া রামায়ণ হবে।
সত্তর দশকের ফুটবলে ১৯৭৭ সালের মতো বছর বোধ হয় খুব একটা আসেনি। মরসুম শুরু হওয়ার আগেই বোকারোয় একটি প্রদর্শনী ম্যাচে খেলতে অস্বীকৃত হওয়ায় গৌতম সরকার, সুধীর কর্মকার, অশোকলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ বসুকে সাসপেন্ড করে ইস্টবেঙ্গল। গৌতম-সুধীর মোহনবাগানে যায়। মোহনবাগান তখন টগবগ করে ফুটছে। সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া দল। শুধু সমরেশ চৌধুরী যা ইস্টবেঙ্গলে ফিরে গেছে।
মরসুমের প্রথম ডার্বি মোহনবাগান মাঠে। গোটা কলকাতা কেন, বাংলা জুড়ে উন্মাদনা। ঠিক করলাম নতুন কিছু করতে হবে কাগজে। ম্যাচের দু’দিন আগে সটান চলে গেলাম কসবায়। ইস্টবেঙ্গল অধিনায়ক শ্যামল ঘোষের বাড়িতে। মাকে জড়িয়ে ধরে পোজ দিল শ্যামল। শ্যামল আর ওর মায়ের ইন্টারভিউ নিলাম। পর দিন শ্যামনগরে, মোহনবাগান অধিনায়ক সুব্রত ভট্টাচার্যর বাড়িতে। প্র্যাকটিসের পর সুব্রত ফিরেছে। একটু জ্বর হয়েছে। মায়ের কোলে মাথা রেখে সুব্রতর ছবিও তোলা হল। সঙ্গে দু’জনের ইন্টারভিউ। হইচই শুরু হয়ে গেল মোহনবাগানের মধ্যে— আমাদের ক্যাপ্টেনকে এ ভাবে শুইয়ে দিল! কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল, গৌতম সরকার-সুধীর কর্মকারের ইন্টারভিউ— আজ ওরা অন্য দলে, কিন্তু বদলা নিতে তৈরি।
ব্যুমেরাং! ব্যুমেরাং!
ডার্বি ম্যাচটা মোহনবাগান হারল দু’গোলে। সমরেশ চৌধুরীর সেই অসাধারণ বাঁক খাওয়ানো ফ্রি-কিক আর মিহির বসুর সেই গোল। ম্যাচের শেষে দক্ষযজ্ঞ মোহনবাগান মাঠে। আক্রান্ত হল তাঁবু, আক্রান্ত হল খেলোয়াড়ও। কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটল। বহু রক্তাক্ত মানুষ গেল হাসপাতালে, মোহনবাগান জনতার ছোটখাটো রোষের মুখে পড়লাম আমিও— এই তো সেই রিপোর্টার, ম্যাচের আগে আমাদের ক্যাপ্টেনকে যে শুইয়ে দিয়েছিল!
ঘটনার উল্লেখ করার প্রয়োজন হল এই কারণেই যে সত্তরের ফুটবল উন্মাদনাটা ঠিক কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা বোঝানোর জন্য। সে বছরই ডাকসাইটে হাবিব, আকবর, সুভাষ ভৌমিক, শ্যাম থাপাদের পিছনে ফেলে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিল খড়দহের নিপাট ভালমানুষ, পড়াশুনোয় অত্যন্ত মেধাবী, গানপাগল রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়।
সুরজিৎ-রঞ্জিত জুটি সে বার দুর্দান্ত ভাবে সফল। ১৯৭৬ সালে এই রণজিৎকেই নেওয়ার চেষ্টা করেছিল মোহনবাগান। সেই পটনার প্রিন্স হোটেল থেকে। কেননা শ্যাম থাপা রণজিৎকেই চেয়েছিল সহযোগী স্ট্রাইকার হিসেবে। হাবিব-আকবরকে নয়। কিন্তু পটনার হোটেলে রাত দুটোয় প্রদীপ চৌধুরী আর মোহনবাগানের রিক্রুটার খিদিরপুরের রবিয়া রণজিতের ঘরে টোকা দিলেও রণজিৎ বেরয়নি। কারণ রুমেই যে ছিল সুরজিৎ সেনগুপ্ত, শ্যামল ঘোষ আর রতন দত্ত।
১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরে মোহনবাগান ক্লাব পেলেকে নিয়ে এল, সঙ্গে নর্থ আমেরিকার সকার লিগ খেলা কসমস।
এয়ার ইন্ডিয়ার মাকালু নামের বিমানটি প্রায় মধ্য রাতে নেমেছিল দমদমে। টারমাকে সব বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে জনতা আছড়ে পড়েছিল বিমানের গায়ে। তার পর পেলেকে নিয়ে কনভয় ধর্মতলার পাঁচ তারা হোটেলে পৌঁছেছিল প্রায় চার ঘণ্টা ধরে জনতার কুর্নিশ নিয়ে। সত্তরের কলকাতাতেই বোধ হয় এটা সম্ভব ছিল।
পেলের সঙ্গে তে-রাত্তির এই হোটেলে কাটিয়েছিলাম খবরের কাগজের দৌলতে। শর্ত একটাই, পেলের দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি খবর তুলে আনতে হবে। তবে, সে অন্য কাহিনি। বরং মনে আছে, ইডেনে মোহনবাগান-কসমস ম্যাচের দিন হাবিবদার আচরণ। সব খেলোয়াড় সে দিন পেলের সঙ্গে ছবি তুলেছিল। এক জন বাদে। হাবিবদা বলেছিল, ও পেলে হ্যায়, তো হামভি হাবিব হ্যায়। ওই সত্তরের দশকের এক ফুটবলারই বোধ হয় এমন কথা বলতে পারে। পেলে ম্যাচের ক’দিন পরেই শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ হওয়ার কথা। কসমসের সঙ্গে মোহনবাগানের ২-২ ড্রয়ের পর যখন সুব্রত ভট্টাচার্যকে সমর্থকরা অভিনন্দন জানাচ্ছে, আর সুব্রত আপ্লুত হচ্ছে, তখন পিছন থেকে হাবিবের বজ্রনির্ঘোষ— ‘আরে বাবলু, পাবলিক আজ গুলদস্তা দে রাহা হ্যায়, লেকিন ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ হারনেসে ইয়ে পাবলিক থাপ্পড় মারেগা। চলা আও ইধার।
আইএফএ শিল্ড, ১৯৭৩।
মালয়েশিয়ার একটি দলের আক্রমণ রুখছেন ইস্টবেঙ্গলের সুধীর কর্মকার
ফুল-কাঁটা কোনওটাই যে মিথ্যে নয়, সত্তর আমাদের তা বুঝিয়ে দিয়েছিল। ওই ’৭৭-এই জাতীয় ফুটবলের আসর বসেছিল কলকাতার ডিসেম্বরের ঠান্ডায়। কলকাতা দেখেছিল পারমিন্দর-হরজিন্দর-মনজিৎ সিংহকে। কেরলের জেভিয়ার পায়াসকে।
পঞ্জাব কিংবা জেসিটি ক্যাম্পে খেলোয়াড়রা নিজেরা রান্না করত। চমৎকার মাংস রান্না করত পারমি, মানে পারমিন্দর। মাঠে যতই আকচাআকচি থাক, দু-এক জন বাংলার ফুটবলারও সেই মাংস খেয়ে আসত। প্রতিভাবানদের ঔদার্য বোধ হয় সহজাত। হরজিন্দরের হকি স্টিকের মতো বাঁ পা চালনায় বাঙালি মুগ্ধ হয়েছিল। বাংলা টিমকেই রাখা হয়েছিল ডালহৌসি পাড়ার এক তারকা হোটেলে।
প্রাথমিক রাউন্ডে বাংলার খেলা আশানুরূপ না হওয়ায় ওলিম্পিয়া বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় কাগজে কলাম লিখছিলেন— এরা তারকা ফুটবলার, থাকে তারকা হোটেলে, দেয় কী?
ফাইনালে বাংলা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বাংলার বেশ কিছু খেলোয়াড় বদ্রুদাকে খুঁজেছিল। কোর্ট প্যান্ট টাইতে শোভিত বদ্রুদা মিটিমিটি হাসছেন— আরে বাবা, লিখেছিলাম বলেই তো আজ ওরা সেরাটা বের করে দিল!
’৭৮-এ মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের দুই ক্যাপ্টেন প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরজিৎ সেনগুপ্ত একসঙ্গে সই করতে এল নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। এক ব্যতিক্রমী ছবি। দু’জনেই ঠিক করেছিল, ওরা দলবদলের রেষারেষির মিথটা ভেঙে দেবে। ক্ষণিকের জন্য ভেঙেছিল। কিন্তু মিথটা থেকেই গিয়েছিল। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল কথা।
সত্তরের শেষ দিকে এই ফুটবলকে কেন্দ্র করেই কলকাতা জুড়ে এক জাতিদাঙ্গার প্রায় সূত্রপাত হয়ে গিয়েছিল। ইস্টবেঙ্গলে তখন এক ঝাঁক পাঞ্জাবি ফুটবলারের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের দেবরাজও ছিল। পঞ্জাব-দক্ষিণ ভারত সহাবস্থান ছিল দক্ষিণ কলকাতার এক মেসে। কিন্তু পঞ্জাবি গুরুদেব সিংহদের সঙ্গে দেবরাজের বিবাদ এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল, যে শেষ পর্যন্ত পঞ্জাবিরা এতটাই ক্ষিপ্ত হয় এবং এর পিছনে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে এমন মারমুখী হয়ে ওঠে যে তখনকার দিনের বিদ্বজ্জনদের পর্যন্ত মধ্যস্থতায় নামতে হয়। তখনকার ফুটবলের উত্তেজনা এমনটাই ছিল।
এর পর ব্যাটন বদল হয়। সত্তর ধীরে ধীরে অবসিত-প্রায়। নতুন এক ঝাঁক তরুণ উঠে আসছে। পুরনোরাও আছে। কিন্তু নবীনের তূর্যনিনাদ শোনা যাচ্ছে। একটি দশক যেন কলকাতার ফুটবলের একটি ক্যানভাস। যে ছবিটাই এই ক্যানভাসে আঁকা যায়, সেটাই সত্যি। কলকাতার ফুটবলের ম্যাসকট—৭০!
(শেষ)