রূপালি বসু, কৌশিকী চক্রবর্তী এবং পদ্মজা সুরেশ
কৌশিকী চক্রবর্তী, সঙ্গীতশিল্পী
আত্মসম্মান এবং নিজেকে প্রকাশ করার অধিকার যদি সম্পূর্ণ ভাবে নিজের হয়, তা যদি অন্য কারও উপরে নির্ভরশীল না হয়, সেটাই স্বাধীনতা— মনে করেন সঙ্গীতশিল্পী কৌশিকী। তবে তিনি মনে করিয়ে দিলেন, ‘‘দায়িত্ববোধের কাছে আমরা সব সময়েই পরাধীন। আর আমার কাছে স্বাধীনতা এবং নারী স্বাধীনতা আলাদা নয়। আমাকে মা-বাবা মানুষ করেছেন, শুধুই মেয়ে করেননি। মেয়ে হওয়ায় কাজের ক্ষেত্রে বাধা যেমন পাইনি, তেমন কোনও আলাদা সুবিধেও পাইনি।’’ তাঁর পক্ষে প্রথম সুযোগ পাওয়া কঠিন ছিল না, কারণ তিনি পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কন্যা। কিন্তু সেখানেও তাঁর যাত্রা সহজ ছিল না। ‘‘প্রথম পাঁচ-ছ’টা কনসার্ট হয়তো সে ভাবে পাওয়া যায়। তবে যখন মানুষ তাঁদের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে টিকিট কেটে গান শুনতে আসেন বা কোনও সংস্থা স্পনসরশিপ দিতে রাজি হয়, তখন কারও ছেলে বা মেয়ে বলেই সেটা করেন না,’’ স্পষ্টবক্তা কৌশিকী। দেশের ৭৫ বছরের স্বাধীনতা উদ্যাপন প্রসঙ্গে শিল্পীর মত, ‘‘আমরা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, সেখানেই যদি থাকতাম, তা হলে আজ নারী স্বাধীনতার কথা আলাদা করে বলতেই হত না। আমাদের দেশে কালী ঠাকুরের পায়ের তলায় শিবঠাকুর থাকেন। একমাত্র এ দেশেই মহিলাদের পুজো করা হয়। সে দেশের মানুষ হয়ে কী করে নিজেদের শিকড় ভুলতে পারি?’’
রূপালি বসু, চিকিৎসক
কলকাতার একটি বিখ্যাত নার্সিং হোমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও বিশিষ্ট চিকিৎসক রূপালি বসুর কাছে যেমন স্বাধীনতার সংজ্ঞা হল নিজের শিক্ষা, মেধা ও বিবেচনা অনুসারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার। রূপালি জানালেন, ‘‘আমাদের দেশের জন্য কষ্টার্জিত সার্বভৌমত্ব ধরে রাখার ক্ষমতা অর্জন করা ও বজায় রাখা সমান ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।’’ পাশাপাশি, নিজের কর্মক্ষেত্রের প্রসঙ্গে তিনি জানালেন তিনি মহিলা হিসেবে কর্পোরেট বোর্ডরুম বৈষম্যের শিকার কখনও হননি। তাঁর কথায়, ‘‘ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে নিজের সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা বজায় রাখতে আমাকে সে অর্থে লড়তে হয় না। তার কারণ এগুলি নেওয়া হয় কর্পোরেট বোর্ডরুমে-এ কিছু কাঠামোগত পদ্ধতির মধ্য দিয়ে, বিশেষত, বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামতের উপরে ভিত্তি করে।’’ তবে, সেই কাঠামোগত পদ্ধতি সকলে মানছেন কি না, তা নিশ্চিত করাই অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
পদ্মজা সুরেশ, নৃত্যশিল্পী
প্রায় একই কথা শোনা গেল নৃত্যশিল্পী পদ্মজা সুরেশের বয়ানে। স্বাধীনতার অর্থ তাঁর কাছে দু’রকম। প্রথমটি ‘ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন’, যা আদতে অকপটে নিজের মনের কথা ব্যক্ত করা। যে মনের ভাব প্রকাশে থাকবে না কোনও শঙ্কা, বা যে বক্তব্য প্রভাবিত হবে না অন্যের ভাবনা চিন্তার দ্বারা। দ্বিতীয়টি হল, নিজের ইচ্ছেমতো জীবন বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা। পদ্মজার কাছে অন্যের শর্তাধীন বা বুড়ো বয়সের ভয়ে বাঁচা নয়, নিজের শর্তে জীবনে বাঁচারই অপর নাম স্বাধীনতা। নিজের কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনতার প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, যে দিন দেশের সমস্ত শিশু ভারতীয় ধ্রুপদী সংস্কৃতিতে সহজ ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে, যে দিন সমস্ত শিল্পী নিজের লিঙ্গ, জাতি, ধর্মপরিচয় নির্বিশেষে শুধু নিজের কৃষ্টি ও সৃষ্টির জন্য পরিচিতি পাবে, সে দিনই বলা যাবে কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনতার ছোঁয়া লেগেছে। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও রকম বৈষম্য ছাড়া সরকারের কাছ থেকে শিল্পকর্মের জন্য সহায়তা পাওয়া ও ভারতের মন্দিরগুলিতে ব্রিটিশ জমানার আগের মতো সহজে নৃত্যপ্রদর্শন করতে পারাও স্বাধীনতার পরিচায়ক।’’
লীনা গঙ্গোপাধ্যায়, দেবী কর, মধুরা পালিত এবং রিমি নায়েক
লীনা গঙ্গোপাধ্যায়, প্রযোজক ও মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন
প্রত্যেক দিন হাতেকলমে নারী-স্বাধীনতার বাস্তব চিত্রের সম্মুখীন হয়ে থাকেন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। ‘‘মেয়েদের মধ্যে স্বাধীনতাবোধ আগের চেয়ে অনেক বেশি তৈরি হয়েছে, তা বুঝতে পারি বেশ। কমিশনে আগে মাসে যতগুলো কেস আসত, এখন দিনে ততগুলো আসে। আমরা ভাবি, শহরের মেয়েরা বুঝি বেশি লড়াকু। কিন্তু আদতে গ্রামের খেটে খাওয়া মেয়েরা কিন্তু অনেক নির্ভীক। তাঁদের হারানোর কিছু নেই,’’ বললেন লীনা। তাঁর নিজের জীবনও সংগ্রামের। অনেক দায়িত্বের মধ্যগগনে শিক্ষকতা ছেড়ে প্রযোজনার অনিশ্চিত পেশা বেছে নিয়েছিলেন লীনা। ‘‘তার জন্য আমাকে অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয়েছে। তবে নিজের উপরে বিশ্বাস ছিল। আর অদম্য মনের জোর।’’
দেবী কর, শিক্ষাবিদ
শহরের এক নামী স্কুলের ডিরেক্টর দেবী কর নিজের প্রতিষ্ঠানে কিছু যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছেন। তার মধ্যে একটা, ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ডের শিরোপা বন্ধ করে দেওয়া। শুধুমাত্র পরীক্ষার ফলকে কখনও গুরুত্ব দেননি তিনি। ‘মেয়েদের মধ্যে প্রথম বা দ্বিতীয়’ কথাটা শুনলে খুব অখুশি হতেন। তবে নিজের ব্যক্তিগত বা কর্মজীবনে তেমন বাধার সম্মুখীন হননি। তাঁর বক্তব্যে উঠে এল স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ, ‘‘কেউ বাইরে কাজ করছেন বলেই সাংঘাতিক স্বাধীন, আর ঘরে কাজ করলে তাঁর কোনও স্বাধীনতা নেই, এমনটা মনে করি না আমি। আসল স্বাধীনতা অনেক দায়িত্ববোধ এনে দেয়। সেটা বোঝা জরুরি। আমাদের মতো জায়গায় যাঁরা আছেন, তাঁদের সেই দায়িত্ব পালনের সুযোগও বেশি।’’ তবে সমসময়ে দাঁড়িয়ে বাক্স্বাধীনতা নিয়ে সংশয় রয়েছে তাঁর, ‘‘কয়েক বছর আগেও যে ভাবে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারতাম, সেটা এখন পারি কি? বিশেষ করে, এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। এই স্বাধীনতাহীনতা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সত্যি।’’
মধুরা পালিত, সিনেম্যাটোগ্রাফার
শুধু বাংলায় নয়, সারা দেশেই মহিলা ডিওপি-র সংখ্যা হাতেগোনা। পেশার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই লিঙ্গবৈষম্যকে সঙ্গী করে কাজে নেমেছিলেন মধুরা পালিত। তাঁর কাছে স্বাধীনতার অর্থ এখন স্পষ্ট হলেও প্রশ্ন অন্য জায়গায়। ‘‘এখন নিজের জন্য যে জায়গা তৈরি করেছি, তাতে নিজের শর্তে বাঁচতে পারি। কিন্তু আমাদের দেশের ক’জন মহিলা সেটা পারেন?’’ কান চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মানিত এই সিনেম্যাটোগ্রাফারকেও প্রথম প্রথম শুনতে হয়েছিল, ‘মেয়ে হয়ে ৮০ জনের টিম সামলাতে পারবে?’ ‘কুড়ি ঘণ্টা ধরে শুট করতে পারবে?’ কাজ দিয়েই এই সব প্রশ্নচিহ্নের জবাব দিয়েছেন মধুরা। ‘‘আজও যখন কোনও প্রত্যন্ত গ্রামে শুটিং করতে যাই, শর্টস পরার আগে দু’বার ভাবতে হয়। সত্যিকারের পূর্ণ স্বাধীনতা কি আমরা সত্যিই পেয়েছি?’’ প্রশ্ন তাঁর।
রিমি নায়েক, ডিজ়াইনার
ফ্যাশন ডিজ়াইনার ও অন্তপ্রনিয়র রিমি নায়েকের কাছে স্বাধীনতার অর্থ স্বনির্ভর হওয়া। ‘‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখনও মহিলাদের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। তা থেকে মুক্তি পাওয়াই আমার কাছে স্বাধীনতা,’’ বললেন রিমি। ছোটবেলা থেকেই লড়াই শুরু তাঁর। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে বেছে নিয়েছিলেন পছন্দের পেশা। কর্মক্ষেত্রেও সম্মুখীন হয়েছেন বিবিধ বাধার। তাঁর কর্মচারীরা প্রায় সকলেই পুরুষ, তাই একজন মহিলার কাছ থেকে নির্দেশ নেওয়ার বিষয়টা তাঁরা ভাবতে পারতেন না। সেই প্রতিবন্ধকতা গত ১৪ বছরে পার করেছেন রিমি। তিনি জানালেন, ‘‘আমার পেশাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিই। এটা যে নিছক শখ নয় তা এখনও অনেকেই বুঝতে চান না। যথেষ্ট ‘সেক্সিস্ট’ মন্তব্যের মোকাবিলা করতে হয়। জীবন ও কর্মক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত নিই, সেগুলো নেওয়াই এক এক সময় যুদ্ধ করার সমান হয়ে ওঠে।’’
তবে আশার আলো দেখাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের সাফল্য। স্বশাসিত হওয়ার এই স্বাধীনতার লড়াইটুকুই আমাদের পথ দেখাবে আগামীর।