চুল-দাড়ি নিয়েই নির্দ্বিধায় শাড়ি পরছেন পুষ্পক। ছবি: ইনস্টাগ্রাম
গত বছর পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে তাঁর মা লাল লিপস্টিক পরে গিয়েছিলেন বলে আত্মীয়দের কটুক্তি শুনতে হয়েছিল। প্রতিবাদে নিজের লিপস্টিক পরা একটা ছবি পোস্ট করেছিলেন ইনস্টাগ্রামে। সেই ছবি ছেয়ে যায় নেটমাধ্যমে। দেশজুড়ে বহু মানুষ অভিনন্দন জানান কলকাতার ছেলে পুষ্পক সেনকে। মেকআপ করে সেজেগুজে বহুদিন থেকেই ছবি দিতেন পুষ্পক। তবে তাঁর লিপস্টিক পরা ছবি নেটমাধ্যমে ছেয়ে যাওয়ার পর থেকেই বাড়তে থাকে তাঁর অনুগামীদের সংখ্যা। সম্প্রতি তাঁর একটি জামদানি শাড়ি পরা ছবি নিয়ে ফের হইচই পড়ে গিয়েছে নেটদুনিয়ায়। কেমন লাগছে তাঁর? ফ্যাশন নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য পুষ্পক এখন ইতালির ফ্লোরেন্সে। সেখানে বসে জানালেন আনন্দবাজার ডিজিটালকে।
ছেলে হয়ে শাড়ি-মেকআপে আপনি স্বচ্ছন্দ। নেটমাধ্যমে তো শোড়গোল পড়ে গিয়েছে!
একটা শাড়ি পরতে ইচ্ছে হয়েছিল। পরে দেখলাম আমার দারুণ মানাচ্ছে, তাই ছবি দিয়েছিলাম। কে কী ভাববে, সেটা ভেবে কিছু করিনি। তবে আমি কৃতজ্ঞ, আমার সাজ এত লোকের ভাল লেগেছে। তাঁরা আমায় অভিনন্দন জানিয়েছেন। ভেবে ভাল লাগছে যে, এতজন আমার সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পেরেছেন। এতেই আমি খুশি।
পাঁচ বছর আগে হলেও এই ধরনের ছবি পোস্ট করলে অভিনন্দনের বদলে কটুকথাই বেশি শুনতে হত।
সে তো এখনও শুনতে হয়। কত মিম, কত হাসি-ঠাট্টা। আমার কিন্তু এদের সৃজনশীলতা দেখে মজাই লাগে। তবে ঠিকই বলেছেন, এখন অনেকের কাছে আমি অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পেরেছি, সেটা খুবই আনন্দের। আগে হলে এত সহজে মানুষ আমায় হয়তো মেনে নিতেন না। এখন সময় বদলাচ্ছে। কিছু মানুষ এখনও খারাপ কথা বলেন। সেগুলো পড়ে আমি ভেঙে পড়ি না। কারণ সকলকে আমার যেমন পছন্দ হয় না, তেমন বাকিদেরও আমায় অপছন্দ হতে পারে। আর খারাপ কথা না শুনলে বুঝব, নতুন কিছু করছি না। আর পাঁচজনের মতো গতে বাঁধা পথেই হাঁটছি।
আপনি অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা। নিজের কার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন?
চারপাশে যে অসাধারণ মহিলাদের রোজ দেখি, তাঁরাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। মা-ঠাকুমা-বান্ধবীরা। নেটমাধ্যমে এমন অনেক প্রভাবী পুরুষ রয়েছেন, যাঁরা মেকআপ বা ফ্যাশনের ভিডিয়ো করে ইউটিউবে বিখ্যাত। আমার কাছে কিন্তু তাঁদের চেয়েও বড় অনুপ্রেরণা, পাড়ার নাটকের মেকআপ কাকু। যিনি কোনও খ্যাতি-পরিচিতি ছাড়াও এই ধরনের চমৎকার কাজ প্রত্যেক দিন করে যাচ্ছেন।
লাল লিপস্টিক, স্কার্টে স্বচ্ছন্দ পুষ্পক।
সাজগোজের শখ কি ছোট থেকেই?
তা বলতে পারেন। তবে কলেজে উঠে সকলেরই কম-বেশি পাখনা গজায়। আমারও তাই হয়েছিল। মনে হয়েছিল নিজের মতো সাজি। সেটা যে কখন আমার জীবনধারাও হয়ে গেল, বুঝতে পারিনি। বাড়িতে মা-বাবা-ঠাকুমা-জেঠু সকলে রয়েছেন। তবে মা আমার সবচেয়ে বড় সমালোচক। প্রথম যখন লিপস্টিক পরে ছবি পোস্ট করেছিলাম, মা বলেছিলেন লাইনটা ঠিক হয়নি। পোশাক-আশাক ইস্তিরি না করা থাকলে মা বলেন, তুমি কি এ ভাবে বেরবে? বাড়ির লোক, বন্ধুবান্ধব সকলের কাছ থেকেই আমি ভরসা পেয়েছি।
এখন আপনি নেটমাধ্যমে বিখ্যাত। জীবন কতটা বদলে গিয়েছে?
আমি এমন নতুন কিছু করছি না যে বলতে পারব, বিপ্লব করছি। আমার আগে এই ধরনের সাজগোজ করে, মেকআপ করে বহু পুরুষ নেটমাধ্যামে নিজেদের ছবি দিয়েছেন। তাঁরাই পথ তৈরি করে দিয়েছেন। তাই আমি এখন সহজেই নিজের মতো সাজতে পারি। শাড়ি-গয়না আমার ভাল লাগে, আমি পরি। মনে করি না তাতে আমার পৌরুষ নষ্ট হচ্ছে। আমার পৌরুষ এত পলকা নয়, যে একটা শাড়ি পরলে সেটা টলে যাবে। শাড়িটা খুলে ফেললে আমি আবার আর পাঁচটা বাসে-ট্রেনে যাতায়াত করা ছেলের মতোই। যাঁরা সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে তাঁরা ফেসবুকে যতই বড় বড় কথা বলুক না কেন, আসলে নারী-বিদ্বেষী। আমার সাজকে খারাপ বলা মানে তো নিজের মা-বোনকে ছোট করা।
ফ্যাশন নিয়ে পড়াশোনা করছেন। ভবিষ্যতেও কি এই নিয়েই কাজ করবেন?
অবশ্যই। আমি মানুষকে নিজের মতো বাঁচতে অনুপ্রেরিত করতে চাই। সব সময় আর্থিক ভাবে সাহায্য করাটাই তো আসল না। কেউ যদি আমায় দেখে মনে করেন, তাঁরা একা নন, তাঁদের মতো আরও অনেকে রয়েছেন, সেটাও বেঁচে থাকার জন্য খুব বড় সাহায্য।