করোনা জন্ম দিচ্ছে নানা মানসিক সংকটের। ছবি: সংগৃহীত
আবার ফিরে আসছে দুঃসময়ের স্মৃতি। লকডাউন। কাজ না থাকা। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়দের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ভয়ঙ্কর স্মৃতি। একটা প্রায় থমকে যাওয়া জীবন। এবং তারই সঙ্গে আসছে হঠাৎ হঠাৎ ভয়।
এক অনলাইন পোশাক বিপণির মানবসম্পদ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মৃণ্ময় বসু (নাম পরিবর্তিত)। ২০২০ সালে লকডাউনের সময় উত্তর কলকাতার বাসিন্দা মৃন্ময়ের তীব্র অর্থ সঙ্কট দেখা দেয়। কোম্পানি বন্ধ হয়নি ঠিকই, কিন্তু বেতন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কোম্পানির তরফে চাল কেনার খরচ হিসেবে হাজার দু’য়েক টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল মাসে। পরিবারের একমাত্র উপার্যনকারী মৃণ্ময়ের সেই দিনগুলির কথা মনে পড়লে এখনও আতঙ্ক হয়। তাঁর কথায়, ‘‘এখন কোম্পানি আবার আগের অবস্থায় ফিরেছে। কিন্তু আবার বাড়ছে করোনা। মনে পড়ছে গত বছরের কথা। মনে পড়লেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। সব সময় যে মনে পড়ছে, তাও নয়। এমনিই শরীর খারাপ লাগছে।’’
মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, চিকিৎসার পরিভাষায় একে ‘প্যানিক অ্যাটাক’ বলা হয়। করোনার আতঙ্ক ফিরে আসার এই সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। ‘‘বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকেরই এমন হচ্ছে। উদ্বেগ থেকে দম আটকে আসছে। শরীর খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে, কোনও সাহায্য ছাড়াই মারা যাব। শরীর খারাপ কেন লাগছে, তা নির্ণয় করতে যাওয়ার ভাবনা শরীরকে আরও খারাপ করে দিচ্ছে’’, বলছেন অনুত্তমা।
গত বছর লকডাউনের আগে পর্যন্ত দিল্লির এক ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতেন স্বর্ণাভ রায় (নাম পরিবর্তিত)। লকডাউনে চাকরি চলে যায়। উত্তর ২৪ পরগনায় নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি। শুরু করেন অ্যাপক্যাব চালাতে। প্রথম দিকে সেখানেও যাত্রী হত না। ‘‘এখন বাজার আগের চেয়ে ভাল হয়েছে। যাত্রী আসছেন। কিন্তু আবার করোনার জন্য সব বন্ধ হয়ে যাবে না তো? তা হলে বউ, ছেলে-মেয়েদের কী হবে? খাব কী?’’ সংশয় নিয়ে কথা বলতে বলতেই হাত কাঁপতে লাগল স্বর্ণাভর। গাড়ি থামিয়ে বললেন, ‘‘পিঠে আর কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা করছে। আগে এ রকম ছিল না। এখন হয়। কেন জানি না।’’ শুধু কি পেশা বদলে গাড়ি চালানোর জন্যই এই ব্যথা। সেটা যেমন হতে পারে, তেমনই মানসিক চাপের কারণেও পেশী এবং স্নায়ুর ব্যথা হতে পারে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসক সঞ্জয় গর্গ।
কেন এই ভয়, তা নির্ণয় করার দায়িত্ব নিজে নেবেন না।
‘‘হালে এক রোগী এসেছিলেন। কথা বলতে বলতেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। ‘প্যানিক অ্যাটাক’-এর পরিমাণ তীব্র ভাবে বেড়ে গিয়েছে, সেটা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি’’, বলছেন সঞ্জয়।
যাঁদের এমন সমস্যা হচ্ছে, তাঁরা সব সময় হাতের কাছে এক জন চিকিৎসকের ফোন নম্বর রাখুন। কোনও সমস্যা হলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, তাঁর পরামর্শ নিন। নিজে নিজে রোগ নির্ণয় করতে যাবেন না। এমনই পরামর্শ অনুত্তমার। ‘‘টিকা এসে গেলেই সব সমস্যা কেটে যাবে, এমন একটা বিশ্বাস অনেকের হয়েছিল। দেখা গেল, সেটা সত্যি হল না। এই অতিমারির সঙ্গে আরও বহু দিন কাটাতে হবে, এমন ভাবনা থেকেই অনেকের মধ্যে ভয়টা জন্ম নিচ্ছে’’, বলছেন অনুত্তমা। কিন্তু তা বলে টিকা নেবেন না, এমন ভাবনা থেকে বিরত থাকতে বলছেন তিনি। ‘‘সংক্রমণ ঘটলেও বড় ক্ষতি বা চরম বিপদের আশঙ্কা অনেকটা কমিয়ে আনা যায় টিকা নিলে। এটা মনে রাখতেই হবে।’’ বলছেন অনুত্তমা।
মা মারা গিয়েছেন বছর পাঁচেক আগে। কোভিডে বাবাকে হারিয়েছেন দক্ষিণ কলকাতার চৈতালি ধর (নাম পরিবর্তিত)। ক্রমে সেই শোক কাটিয়ে উঠছিলেন। এখন করোনার বাড়বাড়ন্তে আবার উদ্বেগ বাড়ছে। ‘বাবাকে হারিয়েছেন। এ বার কি তাঁর নিজের পালা’? এমন প্রশ্ন সারাক্ষণ পাক খায় মনে। আর নজর রাখেন খবরে। মনে হয়, যে কোনও মুহূর্তে মারা যেতে পারেন। ‘প্যানিক অ্যাটাক’ থেকে বাঁচতে করোনার সংবাদ সরাসরি দেখা বা পড়া এড়িয়ে চলুন। পরামর্শ সঞ্জয়ের। ‘‘মনোবিদের পরামর্শ নিন। মন ভাল রাখার থেরাপি করান। যাঁদের এই ‘প্যানিক অ্যাটাক’-এর ইতিহাস আছে, তাঁরা সাবধান থাকুন’’ বলছেন সঞ্জয়।
অনুত্তমার পরামর্শ, ‘‘এখনই মারা যাব— এমন একটা উপসংহারে পৌঁছে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন। প্রচণ্ড উদ্বেগ হলে লম্বা শ্বাস নিন। আর ইন্টারনেট দেখে নিজের রোগ নির্ণয় আর চিকিৎসা করতে যাবেন না।’’