পাভলভ মানসিক হাসপাতাল। —ফাইল চিত্র।
বছরের পর বছর মানসিক হাসপাতালের ঘেরাটোপে পড়ে থাকাটাই ভবিতব্য ধরে নিয়েছিলেন ওঁরা। ডাক্তারদের মতে, ওঁরা রোগমুক্ত। তবু পরিবারের অনাদরে বাতিল, পরিত্যক্ত দশায় অবসাদে তলিয়ে যাচ্ছিলেন অনেকেই। মানসিক হাসপাতালের সেরে ওঠা সেই আবাসিকদের জন্য হঠাৎই আশার ঝিলিক। ২০১৭ সালের মানসিক স্বাস্থ্য আইন মেনে সুস্থ আবাসিকদের স্বেচ্ছায় মুক্তির পথ খুলছে সরকারি হাসপাতালে। গত কয়েক দিনে পাভলভ মানসিক হাসপাতাল থেকে ‘ডিসচার্জ সার্টিফিকেট’-এ নিজে সই করে জীবনের পথে ফিরেছেন জনা সাতেক আবাসিক।
রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমের মতে, এ ভাবে সুস্থ আবাসিকেরা মুক্ত হলে মানসিক হাসপাতালগুলিতে গাদাগাদিও কমবে। শুধু পাভলভেই ২৫০ জনের জায়গায় ৬৩২ জন আবাসিক আছেন। ১৬৮ জন সুস্থ হয়েও হাসপাতালে পড়ে। তাঁদের মধ্যে ৮০ জন ষাটোর্ধ্ব। বহরমপুরে ৪০০ জনের জায়গায় আছেন ৪৭৫ জন, পুরুলিয়ায় ২০০ জনের জায়গায় ২৩৪। পাভলভের মেডিক্যাল সুপার মাসুদ হাসান আলির কথা শুনে সুস্থ হওয়া মনোরোগীদের নিজের দায়িত্বে স্বেচ্ছামুক্তি চালু করার সুপারিশ করেন রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপার্সন, বিচারপতি জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য। পাভলভ ছাড়া লুম্বিনী পার্ক, বহরমপুর, পুরুলিয়াতেও এই নির্দেশ পৌঁছেছে।
সম্প্রতি কমিশনের সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠকে বসেন স্বাস্থ্যকর্তারা। তাঁরা বলছেন, ‘‘অনেক সময়ে অকারণে বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদেরও পুলিশের মাধ্যমে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সম্পূর্ণ সুস্থ ব্যক্তির ভাষা বুঝতে না-পেরেও মনোরোগী ভেবে হাসপাতালে পাঠানো দস্তুর।’’ তা ছাড়া, ডাক্তারদের মত, মনোরোগও বাড়ে-কমে। বেশির ভাগই বাড়িতে ওষুধ খেয়ে সুস্থ থাকেন। তাই অনন্তকাল হাসপাতালে রাখার যুক্তি নেই।
কমিশনের চেয়ারপার্সনও বলছেন, ‘‘মনোরোগীরা সুস্থ হওয়ার পরে হাসপাতালে ফেলে রাখা মানবাধিকার লঙ্ঘন।’’ ২০১২ সালে পাভলভ থেকে স্বেচ্ছামুক্তির জন্য হলফনামা দিয়ে হাই কোর্টে মামলা লড়েছিলেন অসমের শিবসাগরের যুবক হাসান। মানসিক হাসপাতালের সুস্থ আবাসিকদের পুনর্বাসনে সমাজকল্যাণ দফতরের সহায়তায় একটি জীবন-সহায়তা কেন্দ্রও গড়ে উঠেছে। তবু নানা টানাপড়েনে অনেককে বাড়ি ফেরানো এখনও কঠিন। মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে পাভলভের উপদেষ্টা অনন্যা চক্রবর্তী সুস্থ হয়ে ওঠা আবাসিকদের পুনর্বাসনে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়ার কথা বলেন। জ্যোতির্ময় বলেন, ‘‘সুস্থ হয়ে ওঠা প্রবীণ আবাসিকদের রাখার জন্য কয়েকটি বৃদ্ধাশ্রমেও কথা বলা চলছে।’’
কমিশনের চেয়ারপার্সনের বক্তব্য, ‘‘অনেক সময়েই মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করানোর সময়ে ২০১৭ সালের মানসিক স্বাস্থ্য আইন মানা হচ্ছে না। সরকারি আইনজীবীকে না জানিয়ে পুলিশ কাউকে ভর্তি করাতে একতরফা মামলা করছে। এটা বন্ধ করতে দরকারে বিচার বিভাগ, পুলিশের সঙ্গেও বসব। ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে কাউকে ভর্তি করা হলেও সেই আবাসিককে পরীক্ষা করে তাঁকে রাখার বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই সিদ্ধান্ত নেবেন।’’
পাভলভ থেকে নিজে সই করে সদ্য মুক্ত, নৈহাটির রজত সরকার বলছিলেন, “অনেক আগেই বুঝেছিলাম, বাড়িতে একা ভালই থাকতে পারব। তবু কেউ নিতে আসেনি বলে পাভলভে পড়েছিলাম।” জেঠুর থেকে চাবি নিয়ে বাড়ি ঢুকে যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রাক্তনী এখন চাকরির খোঁজ করছেন।
সুস্থ হওয়া মনোরোগীদের অধিকার নিয়ে সক্রিয় একটি মঞ্চের কর্ণধার রত্নাবলী রায়ের কথায়, ‘‘সেরে ওঠা মনোরোগীরা মূল স্রোতে ফিরবেন, এটাই স্বাভাবিক। আশা করব, অন্য মানসিক হাসপাতালগুলিতেও কমিশনের সুপারিশ গুরুত্ব পাবে।’’