—প্রতীকী চিত্র।
বাজারচলতি প্যাকেটজাত ফলের রস কিংবা দুধে মেশানোর পাউডার আমরা কিনে থাকি... মনে করি এগুলো বাচ্চাদের জন্য ভাল। টিফিনে প্যাকেটের কেক, বিস্কিট, চিপস হামেশাই দেওয়া হয়। কিন্তু পণ্যগুলো আদৌ স্বাস্থ্যসম্মত কি না, তা নজর করা হয় না। অধিকাংশ প্যাকেটজাত খাবারে নানা ধরনের প্রিজ়ারভেটিভ এবং অ্যাডিটিভ থাকে, যেগুলো শরীরের জন্য ক্ষতিকর। দীর্ঘ দিন ধরে এ জাতীয় খাবার খেতে থাকলে শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধে।
অনেক সংস্থাই দাবি করে তাদের প্রডাক্ট ‘আসল ফলের রস’, ‘ভরপুর পুষ্টি’, ‘গ্রোথ হবে’... কিন্তু সেই দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্টও। সম্প্রতি শীর্ষ আদালত রায় দিয়েছে, বিজ্ঞাপন দেওয়ার আগে একটি ডিক্ল্যারেশন ফর্ম পূরণ করতে হবে সংস্থাগুলোকে। সেখানে জানাতে হবে, বিজ্ঞাপনী দাবিগুলো কতটা সত্যি। সম্প্রতি একটি সংস্থা ‘হেলথ ড্রিংক’-এর তকমা হারিয়েছে। কারণ তাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সুগার কনটেন্ট থাকত। তেমনই একটি পট্যাটো চিপস প্রস্তুতকারক সংস্থা প্রতিরোধের মুখে পড়ে, পাম অয়েলের পরিবর্তে সানফ্লাওয়ার অয়েল ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে। খাদ্যপণ্যে প্রিজ়ারভেটিভ, রঙের ব্যবহার এবং প্যাকেটের লেবেলে বিভ্রান্তিকর তথ্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে যাচ্ছেন সমাজকর্মী রেবন্ত হিমতসিঙ্গকা। এর জন্য বহুজাতিক সংস্থাগুলো তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও ঠুকেছে। কিন্তু রেবন্তের বক্তব্য হল, “কোনও পণ্য কেনার আগে ভাল করে লেবেল পড়া দরকার। সংস্থাটি খাদ্যে কী কী মিশিয়েছে তা জানা খুব জরুরি। উপকরণের তালিকা খুঁটিয়ে দেখে তবেই পণ্য কেনা উচিত।” তাঁর আন্দোলনের মূল কথাই হল ‘লেবেল পড়েগা ইন্ডিয়া’।
লেবেল পড়া কতটা জরুরি?
একই কথা বলছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড বায়ো-কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক প্রশান্তকুমার বিশ্বাস। তাঁর কথায়, “প্যাকেটজাত খাবার যাতে বেশি দিন ভাল থাকে, সে কারণেই প্রিজ়ারভেটিভস বা অ্যাডিটিভস দেওয়া থাকে। এর একটা মাত্রা থাকে। বিদেশে এই মাত্রাগুলো খুব কম, কিন্তু আমাদের দেশে মাত্রাগুলো অনেক সময়ে বেশি হয়।”
সাধারণ মানুষ বুঝবেন কী করে কোনটা প্রিজ়ারভেটিভ? প্যাকেটগুলোয় আইএনএস (ইন্টারন্যাশনাল নাম্বারিং সিস্টেম ফর ফুড অ্যাডিটিভস) কোড দেওয়া থাকে। সেই কোড দেখে বুঝতে হবে কোন কোন রাসায়নিক দেওয়া আছে। এই অ্যাডিটিভসের মধ্যে ফুড কালারও পড়ছে। প্যাকেটে আইএনএস ২১১, ২২৮... এই রকম নম্বর থাকে। অনেক সময়ে আইএনএস-এর বদলে ‘ই’ দিয়ে নম্বর লেখা থাকে। সেটা হল ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড। আইএনএস/ই যা-ই থাকুক না কেন, কেমিক্যালের কোড নম্বর একই হবে। “এই নম্বরগুলো যদি আমরা নেটে সার্চ করে দেখি তা হলেই বুঝতে পারব কোনটা ক্ষতিকর, কোনটা নয়। যে খাবার আমাদের শরীরে রোজ যাচ্ছে, তার দোষগুণ জেনে নেওয়া প্রয়োজন,” মন্তব্য অধ্যাপক বিশ্বাসের।
রাসায়নিক ও তার ক্ষতিকর দিক
চকলেট, বিস্কিট, কেক, বোতলবন্দি পানীয়, ইনস্ট্যান্ট নুডলস, ব্রেকফাস্ট সিরিয়ালস (ফ্লেভার্ড), সস, তেল... যা যা আমরা নিয়মিত খেয়ে থাকি, সেগুলোর প্যাকেট খুঁটিয়ে দেখতে হবে। কয়েকটি ক্ষতিকর প্রিজ়ারভেটিভের কথা বললেন প্রশান্তকুমার বিশ্বাস, যা আমাদের অজান্তেই শরীরে প্রবেশ করে—
তবে সব প্রিজ়ারভেটিভ ক্ষতিকর নয়। পণ্যে আইএনএস লেখা আছে মানেই সেটা খারাপ বলা যাবে না। ন্যাচারাল ফুড ফ্লেভারও কোডের আওতায় পড়ে।
শিশুরা বেশি প্রভাবিত
দীর্ঘ দিন ধরে খাওয়ার ফলে প্যাকেটজাত পণ্যে থাকা অল্প পরিমাণ রাসায়নিকও ক্ষতি করতে পারে। এই ক্ষতির পরিমাণ শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। শিশু চিকিৎসক ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “শিশুদের মধ্যে সহনক্ষমতা কম, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। তাই ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি। প্রিজ়ারভেটিভ যেমন রোগের কারণ, তেমনই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। বাচ্চাদের প্যাকেটজাত খাবার একেবারে দেওয়া বন্ধ করতে পারলে সবচেয়ে ভাল।” কৃমি থেকে নার্ভের সমস্যার উৎপত্তির কারণও ক্ষতিকর অ্যাডিটিভস। জুভেনাইল ডায়াবিটিস আমাদের দেশে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডায়াটিশিয়ান কোয়েল পালচৌধুরী এর জন্য মূলত প্যাকটজাত খাবারে থাকা প্রিজ়ারভেটিভস, আর্টিফিশিয়াল সুইটনার, ফ্লেভারকে দায়ী করছেন। বাচ্চাদের কথা ভেবে প্রিজ়ারভেটিভসের মাত্রা ঠিক করা হয় না। সবটাই হয় অ্যাডাল্টদের কথা ভেবে।
নানা রোগের উৎস
প্রিজ়ারভেটিভস আমাদের স্বাভাবিক মেটাবলিক সিস্টেমকে নষ্ট করে। সাধারণ খাবার থেকে যে পুষ্টি আমরা পাই, তা ব্যাহত হয় এ জাতীয় উপাদান শরীরে যাওয়ার ফলে। প্যাকেটের ভাজাভুজিতে অতিরিক্ত নুন থাকে, যা হার্টের পক্ষে খারাপ। কম বয়সে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের এটি একটি কারণ বলে মত বিশেষজ্ঞদের। “ডায়াবিটিস তো বটেই লিভার, হার্ট, কিডনি এবং ক্যানসারের জন্যও এগুলো দায়ী। এগুলো সবই লাইফস্টাইলজনিত অসুখ। কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাটের বেসিক মেটাবলিজ়ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এর ফলে। প্রোটিন বিপাকে বাধা দিচ্ছে, প্রোটিন ভেঙে প্রোটিয়োলাইসিস হয়ে যাচ্ছে,” বললেন ডায়াটিশিয়ান।
সমাধান কোন পথে
চিকিৎসকদের মতে, প্যাকেটজাত খাবার পুরোপুরি বর্জন করার চেষ্টা করতে হবে। মুড়ি, চিঁড়ে, খই, সুজি, ছাতু, ছোলা, বাদাম জাতীয় খাবারে ফিরে যেতে পারলে সবচেয়ে ভাল। শিশুদের খাদ্যাভ্যাস বদলানোর দিকে জোর দিতে হবে। টিফিনে কেক, বিস্কিট, প্যাটিস ধরিয়ে দেওয়া থেকে মা-বাবাকেও বিরত থাকতে হবে। কেন প্যাকেটজাত খাবার ক্ষতিকারক, সেটা ওদের বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন। তবে সবচেয়ে আগে অভিভাবককে সচেতন হতে হবে। অ্যাক্টিভিস্ট হেমন্তের কথায়, ‘‘আমরা যদি এ জাতীয় জিনিস বর্জন করি, তা হলে সংস্থাগুলোও বাধ্য হবে ক্ষতিকারক উপাদান বাদ দিতে।’’
যে কোনও অভ্যেস এক দিনে ছাড়া কঠিন, তবে চেষ্টা করলে এক দিন নিশ্চয়ই তা সম্ভব।