পয়লা বৈশাখে ফিরে আসে ছোটবেলার স্মৃতি
আমরা বলতাম ‘আমলা বৈশাখ’! আমাদের পয়লা বৈশাখের একলা আকাশে সন্ধ্যার মেঘমালার মতো ছেয়ে থাকে ‘আমপাতা জোড়া জোড়া’! বুকের ভিতর সেই কাঁচা মিঠে সুবাস। হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড় নেমে আসে। বাগানের ধুলোয় ঝাপসা হয়ে যায় দিগন্তিকা। টুপটাপ আম পড়ে, ‘মাটির পরে’। এবার বৃষ্টি হবে। আম্রপল্লব ছুঁয়ে ধরার বুক ভিজিয়ে দেবে আকাশের অশ্রু। সোঁদা গন্ধে ভেসে আসবে সিপিয়া রংয়ের স্মৃতি। আমাদের ছাতিমতলা।
আমাদের কৈশোর কেটেছে আমের শহর মালদায়। বাবানেই, আমাদের ৩ ভাইবোনকে নিয়ে মায়ের তখন খুব কষ্টের সংসার। আমাদের পাড়ায় ছিল অনাথ রায়ের আম বাগান। গরমের ছুটির নিরালা দুপুরে আমরা সেখানে আম চুরি করতাম। এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণ লোপাট। বাগানের আম গাছের ছায়ায় বসে গো গ্রাসে চোরাই আম খেয়ে, রাস্তার কলে হাত মুখ ধুয়ে, বুক ফুলিয়ে বাড়ি ঢুকতাম। এক বার পয়লা বৈশাখে আমার দাদা কী মনে করে কে জানে, একটা চোরাই আম নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল, আর হাতে নাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল মায়ের কাছে। মায়ের সে কি বকা! দাদা বলেছিল, ‘আমার সব বন্ধুরাই তো করে মা’! মা বলেছিলে, ‘ওরা বড়লোক, ওরা চুরি করলে লোকে বলবে সখে করেছে। আর আমরা গরিব, তাই তুমি চুরি করলে লোকে বলবে অভাবে স্বভাব নষ্ট’! একথা শুনে আমার সদা বিন্দাস দাদার মুখটা বৈশাখী মেঘের মতো ধূসর হয়ে গিয়েছিল। ওর দুই চোখ থেকে টপটপ জল ঝরছিল, ঘন ঘোর বর্ষার মতো।
এই আমবাগানেই এক পয়লা বৈশাখে ‘দেখা হল দু’জনার’! আমার আর সুস্মিতার। তখন বিকেল। রাস্তায় হালখাতার ভিড়। নতুন কাপড়ের সুবাস বাতাস ময়। পথে ঘাটে সব মানুষের হাসিহাসি মুখে শুভ নববর্ষ চিকচিক করছে। সুজন কাকুর বইয়ের দোকানে রবিঠাকুরের গান বাজছে, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’। আমি আর সুস্মিতাই শুধু ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। আম বাগানের পাতায় পাতায় বৈশাখের বদলে চিরবসন্ত। ঝরা আম পাতার বনে পা ফেললেই মর্মরধ্বনি, আমাদের উন্মুখ ভালবাসার। আমের ছায়া সরিয়ে আমার খুব কাছে এসেছিল সুস্মিতা, সে দিনই প্রথম। কাঁপা কাঁপা হাতে আমি ওর হাত ধরেছিলাম। ঠিক তখনই পাড়ার চায়ের দোকানের মধুদা আমাদের দেখে ফেলেছিল। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সুস্মিতা বলেছিল, ‘যাই রে’। কাঁপা কাঁপা গলায় আমি বলেছিলাম, ‘আর একটু’। সুস্মিতা বলেছিল, ‘মা বকবে’। আমাকে রিক্ত নিঃস্ব করে দিয়ে সুস্মিতা চলে গেল। আমার দুই চোখে তখন বৃষ্টি নামল, কয়েক পশলা রিমঝিম।
প্রায় প্রতি দিন গরমের বিকেলে এই আম বাগানে বসে মোহন সুরে বাঁশি বাজাত স্বভাব-রাখাল শ্যামলদা। ও পড়ত কলকাতা মেডিকেল কলেজে। আমাদের পাশের বাড়ির বাণীদির সঙ্গে গোপন প্রেম ছিল শ্যামলদার। এক বার গরমের ছুটিতে মালদা এসে শ্যামলদা খবর পেল বাণীদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। শ্যামলদা আর কলকাতা ফিরল না, বাঁশি বাজানো ছেড়ে দিল। সারা দিন আনমনে বোবা হয়ে বসে থাকত ওই আমবাগানে। সবাই ওকে ডাকত ‘আম পাগলা’ বলে। কেউ ওর ধারে কাছে যেত না। আমি গিয়েছিলাম শুধু, এক বার পয়লা বৈশাখে। সটান শ্যামলদার সামনে গিয়ে সেদিন আমি বলেছিলাম, ‘তুমি আর বাঁশি বাজাও না কেন’? শ্যামলদা ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল আমার দিকে, পলকহীন। ওর দুই চোখ জুড়ে আমি তখন বাণীদিকে দেখতে পেলাম। কে যেন গাইছে ‘হারিয়ে গেছে মোর বাঁশি, আমি কোন সুরে ডাকি তোমারে’! তখনই চরাচর কালো করে ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। অনেক দিনের পর, শ্যামলদা উথালপাথাল স্নান করল সেদিন, এক বুক টাপুরটুপুর নিয়ে।
গরমের ছুটির ফি দুপুরে আমার দিদি যেত বাণীদিদের বাড়িতে। বাণীদির বাল্যবিধবা পিসিমনির ডাকে। ওই সময় পাড়ার সদ্য শাড়ির মেয়েদের নিয়ে ‘কাঁচা আমের আসর’ বসাত পিসিমনি। বাড়ির বাঁধানো উঠোনের একটা পিলারে হেলান দিয়ে বসে, দুই পায়ে বঁটি চেপে ধরে, বাকল ছাড়িয়ে, পিসিমনি আধখানা চাঁদের মতো আমের টুকরোগুলি তুলে দিত মেয়েদের হাতে। মেয়েরা তাতে সর্ষের তেল আর নুন মাখিয়ে ভাগ করে খেত সবাই। এক মুখ আম নিয়ে পুরনো দিনের গপ্পো বলত পিসিমনি। এক বার পয়লা বৈশাখে আম কাটতে কাটতে পিসিমনির মাথাটা এলিয়ে পড়ল আচমকা। ওর শিথিল দুই হাত থেকে খসে পড়া আধকাটা আমটা গড়িয়ে গেল উঠোনে। ঠিক যে ভাবে মানিকবাবুর পথের পাঁচালিতে ইন্দির ঠাকরুনের হাত থেকে পড়ে যাওয়া জলের ঘটি গড়িয়ে পড়েছিল সর্বজয়ার নিকনো উঠোনে। শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে আমার দিদি সে দিন ঝমঝমিয়ে কেঁদেছিল সারাটা দুপুর।
আমার পরবাসের পয়লা বৈশাখে, আমার হৃদয়পুরের আম বাগানে এমনি করে ‘বর্ষাআসে, বসন্ত’! রিনিঝিনি নুপুরের বারিধারায় ভিজতে থাকে আম পাতার দল, ভিজতেই থাকে। জল পড়ে পাতা নড়ে, স্মৃতিগুলি মনে পড়ে!