খুদে কম কথা বলে চিন্তা? ছবি: সংগৃহীত।
মনখারাপ অন্বেষার মায়ের। মেয়ের বয়সি আর পাঁচটি শিশু যখন সকলের সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে, তখন তাঁর সন্তানের মুখ দিয়ে যেন কোনও কথাই বার হয় না। বাড়িতে যদি বা কিছু কথা বলেও মেয়ে, বাইরে গিয়ে একেবারে চুপ। রাগের মাথায় মেয়েকে বকাবকিও করেছেন বাড়ি আসতেই। তবে তার পর থেকে নিজের মনও খারাপ। কেন যে তাঁর মেয়েটা কথাই বলতে চায় না!
এমন সমস্যা থাকে বহু শিশুরই। আর তাদের নিয়ে চিন্তার অন্ত থাকে না অভিভাবকদেরও। কারও সমস্যা, সন্তান বড্ড কম কথা বলে। কারও আবার অভিযোগ, কোনও অনুষ্ঠানে বা কারও বাড়িতে গেলে একেবারেই চুপ হয়ে যায় শিশু। এমন সমস্যার সমাধান কী ভাবে হবে?
মনো-সমাজকর্মী মোহিত রণদীপের কথায়, শিশুর কম কথা বলা, মিশতে না পারার পিছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। এখন বহু বাড়িতেই খুদের সঙ্গে কথা বলার লোকের অভাব। মা-বাবারা এতটা ব্যস্ত থাকেন যে, ঠিক মতো কথা বলতে পারেন না। ঠাকুমা, দাদুও থাকেন না বহু বাড়িতে। ফলে শিশু কার সঙ্গে কথা বলবে? পাশাপাশি খুদেকে খাওয়াতে বা বায়না ভোলাতে অনেক বাবা-মা হাতের কাছে মোবাইল দিয়ে দিচ্ছেন। এই সমস্ত কিছুর ফলে খুদের কথা বলার পরিসর কমছে। অনেক সময় বাবা-মায়েরা সন্তান বাইরে কার সঙ্গে মেলামেশা করবে, সে বিষয়েও দাঁড়ি টানছেন। ফলে একা থাকা, মোবাইলে ডুবে যাওয়া, সমবয়সি বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশার অভাবে শিশুরা অনেক সময়ই নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে, কথা কম বলছে।
শিশুরা কথা কম বললে অভিভাবকদের কী করণীয়, এই ব্যাপারে পরামর্শ দিলেন পেরেন্টিং কনসাল্ট্যান্ট পায়েল ঘোষ। তিনি বলছেন, ৫টি বিষয় অভিভাবকদের মাথায় রাখা প্রয়োজন।
১. কোনও শিশু কম কথা বলতে পারে, সে অন্তর্মুখীও হতে পারে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সে কোনও কিছু দেখে না বা বোঝে না। বরং অনেক সময় সে চুপচাপ থেকে আশপাশের জিনিস গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। এ ক্ষেত্রে সকলের সামনে বাবা-মা যদি অন্য শিশুর সঙ্গে তার তুলনা করেন, তা হলে সে আরও নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারে। তার মনে হীনম্মন্যতা তৈরি হতে পারে।
২. শিশুরা কম কথা বললেও দেখা যাবে, গুটি কয়েক বন্ধু হয়তো রয়েছে, যাদের সঙ্গে সে কথা বলে। খুদেকে কথা বলায় উৎসাহ দেওয়ার জন্য সেই বন্ধুদের বাড়িতে ডেকে তাদের খেলাধুলোর পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া যায়। আবার বাইরে খেলাধুলো করানো যেতে পারে।
৩. খুদেকে পড়াশোনার বাইরের কোনও বিষয় শেখার জন্য ভর্তি করে দেওয়া যেতে পারে। যাতে শিশু তার সমবয়সি আরও অনেকের সঙ্গে মিশতে পারে। নাচ, আঁকা, খেলা বা পছন্দের যে কোনও জিনিসই হতে পারে। কাজের প্রয়োজনেই সে ধীরে ধীরে জড়তা কাটিয়ে কথা বলায় উৎসাহী হবে।
৪. সন্তান কম কথা বললে, ধৈর্য ধরতে হবে বাবা-মাকেও। হয়তো সে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। তাকে থামিয়ে না দেওয়া বা ভুল বললে তখনই শুধরে না দেওয়াটাও অভিভাবকদের অভ্যাস করতে হবে। হতেই পারে, কথা বলায় জড়তা রয়েছে, উচ্চারণ স্পষ্ট নয়, কিন্তু যখন সে বলতে চাইছে তখনই তাকে বাধা না দেওয়াই ভাল। পরে তাকে আলাদা ভাবে উচ্চারণ শেখানো যেতে পারে। বিশেষত বাইরের লোকজনের সামনে খুদে কথা বলার চেষ্টা করলে তাকে না থামানোই ভাল।
৫. সমালোচনার বদলে উৎসাহ এ ক্ষেত্রে কার্যকর হবে। হয়তো পারিবারিক অনুষ্ঠানে সকলের সামনে খুদে ছড়া বলতে চাইছে না বা নাচ করতে চাইছে না। তাকে সেখানেই বকাবকি করা বা ‘তুমি কিছু পারো না’ জাতীয় কথা বলা উচিত নয়। সে রাজি না হলে তার ইচ্ছাকেও মর্যাদা দিতে হবে। বরং আলাদা ভাবে এ নিয়ে খুদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন বাবা –মা। তবে জোর না করে অন্য ভাবে তাকে বললে, এক সময় মন বদল হতেও পারে।
বন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠান হোক বা পারিবারিক অনুষ্ঠান, খুদেরা অনেক সময় বাইরে গিয়ে একেবারে চুপ করে যায়। কিছুতেই তার মুখ থেকে কথা বার করা যায় না। একটা আড়ষ্ট ভাব চেপে বসে। মনো-সমাজকর্মী মোহিত বলছেন এর পিছনে সামাজিক-উদ্বেগ কাজ করতে পারে। হয়তো এত লোকের উপস্থিতির তার ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে, কোনও কথা বললে বাকিরা যদি কিছু বলে। মোহিতের কথায়, ছোট থেকে অন্যদের সঙ্গে মেলামেশার অভাব এর কারণ হতে পারে। বাবা-মায়েরা যদি কার সঙ্গে মিশবে, কার সঙ্গে নয়, তা নিয়ে বেশি হস্তক্ষেপ করেন, তা হলেও সমস্যা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তাকে জোর না করে, সমবয়সিদের সঙ্গে খেলাধুলোর গণ্ডি বাড়াতে হবে। মোহিত বলছেন, ‘‘সন্তানের ছোটখাটো পারায় উৎসাহ দেওয়া ও খুদের সঙ্গে কথা বলার সময় বৃদ্ধি এ ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের সহায়ক হয়ে উঠবে। বকাবকি বা প্রকাশ্য সমালোচনায় শিশু নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারে।’’