শিশুকে পড়াশোনায় কী ভাবে উৎসাহ দেবেন অভিভাবকরা? —প্রতীকী ছবি।
ঘড়ি ধরে পড়তে বসায় কারই বা আগ্রহ থাকে? তবে খুদে দুষ্টুমি করুক বা বায়না, তাদের পড়তে বসাতে হবেই। কিন্তু তা বলে বকাঝকা করাটা সমস্যার সমাধান নয়। বরং বাবা-মায়ের উৎসাহেই শিশুর পড়াশোনায় আগ্রহ তৈরি হতে পারে। আবার অভিভাবকদের কিছু ভুলই তাদের পঠনপাঠনে অনাগ্রহীও করে তুলতে পারে।
মনোসমাজকর্মী মোহিত রণদীপের বক্তব্য, ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার বাড়তি চাপ, অভিভাবকদের প্রত্যাশা, মেজাজ হারিয়ে বকুনি দেওয়ার কারণে শিশু পঠনপাঠনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষের পরামর্শ, শিশুর ভুলের কড়া সমালোচনা না করে, কথার কৌশলেই তাকে পড়ায় উৎসাহিত করে তোলা যেতে পারে। যিনি পড়াবেন, তাঁকে ধৈর্য ধরে কাজটি করতে হবে।
১. পড়াশোনার একটি রুটিন করে দেওয়া দরকার। পায়েলের পরামর্শ, পড়তে বসার আগে শরীরচর্চা খুব জরুরি। এ বিষয়ে গাফিলতি চলবে না। খুদে সন্ধ্যা থেকে টিভি দেখে, এদিক-ওদিক ঘুরে বেশি রাতে পড়তে বসলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তার পড়াশোনায় মন থাকবে না। মোহিত বলছেন, ‘‘টিভি, মোবাইলে কার্টুন, রিলস, গেম্স চলমান জিনিস। সে সব দেখে পড়তে বসলে, বইয়ের স্থির ছবিতে কিছুতেই মনোসংযোগ করা সম্ভব হবে না। তার চেয়ে বরং শিশু ছোটাছুটি করে খেললে দৈহিক অস্থিরতা কমবে। তার পর পড়তে বসলে মন দেওয়া সহজ হবে।
২. পড়তে বসার আগেই স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার এ দিন কী কী পড়বে। পায়েল বলছেন, ‘‘তার মধ্যে আঁকাও থাকতে পারে। কোনটার পর কোন বিষয়ের কাজ করতে হবে, সেটা জানা থাকলে, শিশু বুঝবে এটাই শেষ পড়া। তার মনে পড়া শেষ হওয়ার আনন্দ কাজ করবে। তাঁর কথায়, পড়াশোনার উদ্দেশ্য একটি চিন্তাশীল মন তৈরি করা। পড়াশোনায় যেন আনন্দ থাকে। এ ক্ষেত্রে যিনি সুন্দর ভাবে পড়াতে পারেন, তাঁকেই দায়িত্ব দিলে ভাল। সকলের কিন্তু ধৈর্য ধরে বুঝিয়ে, গল্প করে পড়ানোর ক্ষমতা থাকে না। মা সারা দিন কাজের পর সন্তানকে পড়াতে বসিয়ে দ্রুত মেজাজ হারিয়ে ফেলতে পারেন। অভিভাবক যদি সন্তানকে পড়ানোর দায়িত্ব নেন, তাঁদের এগুলি মাথায় রাখতে হবে।
৩. ছোট থেকে বড়, পঠনপাঠনে উন্নতি তখনই সম্ভব, যখন কেউ পড়াশোনায় নিজে থেকেই আগ্রহী হয়ে উঠবে। মোহিত মনে করেন, পড়ানোর পদ্ধতি এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূ্র্ণ। এমন ভাবে শিশুর সামনে পাঠ্য বিষয়বস্ত উপস্থাপন করতে হবে, যাতে সে আগ্রহী হয়। খুদের ছোট ছোট সাফল্যকে উৎসাহ দিতে হবে। সমালোচনার চেয়ে প্রশংসা এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি কার্যকর।
৪. অন্যের সঙ্গে তুলনা করলে সমস্যা হতে পারে। পায়েল বললেন, ‘‘তুমি পারছ না কেন? অন্যরা পারে, এমন তুলনা কখনও তাকে উৎসাহ জোগাবে না। বরং সমালোচনা করতে হবে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে। বলতে পারেন, কালকে তুমি একটি বানান ভুল করেছিলে। আজ ৩টি বানান ভুল হল। দেখ আমার কিন্তু পড়তে অসুবিধা হচ্ছে। পরের বার কি তুমি এমন ভাবে লিখতে পারে, যাতে একটা বানানও ভুল না হয়।’’ কিংবা বোঝান, ‘‘অঙ্ক যদি অভ্যাস না করো, মাথা খুলবে না। বুদ্ধি কমে যাবে। সেটাই কী চাইছ তুমি।’’
৫. পড়ার ফাঁকে বিরতিতে জোর দিচ্ছেন পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট। তাঁর পরামর্শ, ২০ মিনিট পড়ার পর ৫ মিনিট বিরতি প্রয়োজন। তবে সে সময় তাকে কার্টুন দেখার ছাড়পত্র দেওয়া যাবে না। বরং সেই সময়টা গল্প করা যেতে পারে। পাশাপাশি, পড়ানোর সময়ে মোবাইল দেখা, মেসেজ পাঠানো, রান্না করা বা অন্য কোনও কাজই করা যাবে না। এতে শিশুর মনও চঞ্চল হয়ে উঠবে।
খুদকে পড়াশোনায় আগ্রহী করে তুলতে হলে কিছু ভুলের দিকে অভিভাবকদের খেয়াল রাখা দরকার বলে মনে করেন মোহিত ও পায়েল।
মোহিতের কথায়, ‘‘আগে ৪-৫ বছর থেকে শিশুদের পড়াশোনা শুরু হত। এখন আড়াই বছরের শিশুকে দিয়েও লেখানোর চেষ্টা হয়, যখন তার ঠিক করে পেনসিল ধরার ক্ষমতাই হয়নি। পড়াশোনা বোঝা হয়ে ওঠা কাম্য নয়। অভিভাবকদের বুঝতে হবে, যে প্রত্যাশা সন্তানের কাছে করছেন, তা আদৌ বাস্তবসম্মত কি না। পাশাপাশি, মোবাইল দেখার সময়টা সীমাবদ্ধ করতে হবে। মনোসংযোগ নষ্ট হয়, এমন বিষয়গুলিকে সরানো প্রয়োজন। পায়েলের পরামর্শ, পড়াশোনা খুদের কাছে কখনও যেন ভীতিপ্রদ না হয়ে ওঠে। পরীক্ষায় এত নম্বর পাওয়ার চাপ শিশুমনে খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।